You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে নবাবগঞ্জ উপজেলা (ঢাকা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে নবাবগঞ্জ উপজেলা (ঢাকা)

নবাবগঞ্জ উপজেলা (ঢাকা) ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ- সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের কথা থাকলেও পাকিস্তানের শাসকচক্র জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। তারা বাঙালির ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। অতঃপর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অনমনীয় আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ করে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বধীনতার লক্ষ্যে বাঙালিদের পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো নবাবগঞ্জের আপামর জনতা স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয় এবং মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৭শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মিছিল শেষে নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশের আয়োজন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে আবু মোহাম্মদ সুবিদ আলী এমপিএ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার হারুন-উর- রশীদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশ শেষে সুবিদ আলী এমপিএ পিস্তলের গুলি ছুড়ে নবাবগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। এদিন তাঁরা নবাবগঞ্জ থানায় উত্তোলিত পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনে নবাবগঞ্জ উপজেলার ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন- ও দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদ অধিকতর ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতার পক্ষের নেতৃবৃন্দ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও সহায়ক কমিটি গঠন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ পরিচালনা এবং তৎসংক্রান্ত সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে আবু মোহাম্মদ সুবিদ আলী এমপিএ, খন্দকার হারুন-উর-রশীদ (১৯৭৩ সালে ঢাকা ২-এর এমপি), আবদুল হামিদ খান মজলিশ (উপজেলা ন্যাপ সভাপতি), জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (ন্যাপ নেতা), আজিজুর রহমান ফকু (ন্যাপ নেতা), আব্দুল ওয়ারিশ খান (আওয়ামী লীগ নেতা), ইয়াহিয়া চৌধুরী পিন্টু (নবাবগঞ্জ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান), সিদ্দিকুর রহমান ওরফে সিদ্দিক মাস্টার (নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), আব্দুল মান্নান (আওয়ামী লীগ নেতা), খন্দকার আবুল হাশেম (আওয়ামী লীগ নেতা), দেওয়ান ফয়েজ আহমেদ (আওয়ামী লীগ নেতা), মাহমুদা চৌধুরী (ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী), আব্দুল আজিজ মোড়ল (আওয়ামী লীগ নেতা), মুন্সি আব্দুল আজিজ, বাচ্চু দেওয়ান, ডা. হাসমত আলী (আওয়ামী লীগ নেতা), মীর মাহাবুব আলী (ঢাকা জেলা ন্যাপ সম্পাদক ও দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক), ডা. মতিউর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা), গহের আলী, জানে আলম চৌধুরী, সুধীর কুমার হাজরা, খন্দকার সাইফুল ইসলাম, ডা. ননী মুখার্জী, মলিন চন্দ্র, সিরাজ আহমেদ (আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার), ডা. সোহরাব হোসেন, ডা. আরজ খান, আব্দুল জলিল (আওয়ামী লীগ নেতা), দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি বোরহানউদ্দিন খান, জিএস মো. সুলতান সিকদার, সাবেক ভিপি বিল্লাল হোসেন, সাবেক জিএস হাবিবুর রহমান হাবিব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে এঁরাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান (সিদ্দিক মাস্টার)- এর নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। নায়েক সুবেদার মো. আমজাদ আলীর নেতৃত্বে বড় রাজপাড়ায় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একই সময় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ-এর সাংগঠনিক তৎপরতায় নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে যেমন কাশিমপুর, দিঘীর পাড়া, বক্সনগর, যন্ত্রাইল, চূড়াইন, গালিমপুর, পাড়াগ্রাম, আগলা, কোমরগঞ্জ, আলগীচর-বলমন্তচর, শোল্লা-সিংহড়া, কৈলাল, বাহা, কামারখোলা এবং পশ্চিমাঞ্চলের বান্দুরা, কলাকোপা (পোদ্দার বাড়ি), নয়নশ্রী-দেওতলা, রাহুৎহাঁটি, বারুয়াখালী, শিকারীপাড়া, পাঞ্জিপ্রহরী, বক্তারনগর, হাসনাবাদ, নয়নগরসহ বেশকিছু এলাকায় একাধিক সহায়ক কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয় এবং যুবকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে খন্দকার হারুন-উর-রশীদ, বদিউজ্জামান, মো. মোস্তফা, সিদ্দিক মাস্টার, মো. সাচ্চু, বুলু, শাহাদাতসহ অনেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর ২৬শে মার্চ শতশত ঢাকাবাসী পায়ে হেঁটে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা- সৈয়দপুর-তুলসীখালি-মরিচা-টিকরপুর-নবাবগঞ্জ-মৈন্ট পথে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঢাকা ত্যাগ করে। এসব ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত পলায়নপর পথচারীদের খাবার এবং সেবা- যত্নে নবাবগঞ্জবাসী আত্মনিয়োগ করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে নবাবগঞ্জ ছিল ২নং সেক্টরের অধীন। এরিয়া কমান্ডার ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরী এবং সহকারী কমান্ডার আব্দুল মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে এ এলাকার – যুদ্ধ পরিচালিত হয়। উপজেলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন শওকত হোসেন আঙ্গুর (আন্ধারকোঠা, নবাবগঞ্জ)। পরবর্তী সময়ে তিনি নবাবগঞ্জ পূর্ব জোনের দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর নূরুল ইসলাম খান (রাহু হাঁটী) নবাবগঞ্জ পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধকালীন কমান্ডার এবং সিদ্দিকুর রহমান খান (নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক) -মুজিব বাহিনী-র ঢাকা সদর দক্ষিণের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মোহাম্মদ শাহজাহান (বর্ধনপাড়া), কমান্ডার রাহাত আলী (আগলা কালুহাটী), কমান্ডার কাজী মোশারফ হোসেন চিনু (মহব্বতপুর), মেজর (অব.) গিয়াস (শুরগঞ্জ), কমান্ডার লুৎফর রহমান মোল্লা (করপাড়া), কমান্ডার বদিউজ্জামান বদি (বেনুখালী), কমান্ডার শাহ মো. আবু বকর সিদ্দিক (গালিমপুর) প্রমুখ গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে হরিরামপুর, দোহার, শ্রীনগর, সিরাজদিখান ও নবাবগঞ্জ এলাকায় একটি আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে ওঠে। তাঁর নামানুসারে এ বাহিনী ‘হালিম বাহিনী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। নবাবগঞ্জ উপজেলায় এ বাহিনীর তৎপরতা ছিল। হালিম বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল হরিরামপুরের ইব্রাহিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, বয়রা- সুতালড়ি এবং নবাবগঞ্জের সোনাবাজু গ্রামে। এ সকল কেন্দ্ৰে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
২৬শে মার্চের পর মজিদ মিয়া (বেনুখালী); শাহ মো. আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ তাঁদের পারিবারিক বন্দুক নিয়ে কয়েকজন পাকসেনাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা-কর্মী ও সদস্য তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মী ও ছাত্র- যুবকরা বাঁশের লাঠি, সড়কি, বল্লম, যুতি, টেটা, রামদা প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে।
৯ই মে রবিবার পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল নবাবগঞ্জ উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দিন আহমেদ (কলাকোপা) এবং সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ ওরফে সোনা মিয়া (চেয়ারম্যান, বক্সনগর) পাকিস্তানি সেনাদের ঢাকা থেকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুপ্রবেশের পর পাকিস্তানি বাহিনী নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকিস্তানী বাহিনী নবাবগঞ্জে প্রবেশ করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। নবাবগঞ্জ উপজেলা শান্তি কমিটি ও পাকিস্তানিদের অন্যান্য সহযোগী বাহিনী গঠনের মূলে ছিল বড় রাজপাড়া গ্রামের মাহতাবউদ্দিন খান (চেয়ারম্যান, কলাকোপা)। সে ১৯৭০ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে এতদঞ্চল (ঢাকা ১, ২, থেকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয় তার নির্দেশে নবাবগঞ্জ উপজেলায় শান্তি কমিটি ও অন্যান্য সহযোগী কমিটি ও বাহিনী গঠন করা হয়। প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে এর সদস্য মনোনীত হয়।
ডা. শফিউদ্দিন আহমদ এমবিবিএস (পিতা ছরদেশ আলী, ছোট রাজপাড়া)-কে সভাপতি, আব্দুল জব্বার বেপারী (পিতা মোহাম্মদ আলী বেপারী, সমসাবাদ)-কে সহ-সভাপতি, সিরাজউদ্দিন আহমেদ ওরফে সিরাজ মাস্টার (পিতা মো. ইসমাঈল, কলাকোপা)-কে সাধারণ সম্পাদক এবং মোফাজ্জল হোসেন ওরফে মবজেল মাস্টার (পিতা মো. আলমাছ উদ্দিন, সাদাপুর)-কে সহ-সাধারণ সম্পাদক করে উপজেলা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যরা ছিল— তমিজ উদ্দিন (চেয়ারম্যান, জয়কৃষ্ণপুর, কুঠুরী), কাজী ইয়াকুব আলী (মহব্বতপুর, চেয়ারম্যান, বান্দুরা), পিপি দারোগা তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (পাঞ্জিপ্রহরী), বশির উদ্দিন ওরফে বাঁশি মিয়া (তুইতাল), ইউনুছ খান ওরফে তোতা মিয়া (দাউদপুর), মহিউদ্দিন আহমেদ ওরফে সোনা মিয়া (বক্সনগর), বোরহান উদ্দিন খান ওরফে চিনু মিয়া (আউনা), মাওলানা আহমদউল্লাহ পাঠান (দুর্গাপুর), মতি মিয়া (বক্সনগর), পাচু মিয়া (যন্ত্রাইল), আশ্রাব খলিফা (যন্ত্রাইল), ডা. সিরাজুল ইসলাম (আলগীচর) প্রমুখ।
নবাবগঞ্জে আলবদর বাহিনীর নেতৃস্থানীয়রা হলো— মাওলানা আহমদ উল্লাহ পাঠান (দুর্গাপুর), হাফেজ মো. হাবিবুল্লাহ (কাশিমপুর), হাফেজ আনসারী (কাশিমপুর), বদর পাঠান (দুর্গাপুর), জাহের আলী (যন্ত্রাইল), শহীদুল ইসলাম (চুড়াইন) প্রমুখ।
নবাবগঞ্জে কুখ্যাত রাজাকাররা হলো- মতিউর রহমান (কাশিমপুর), সিরাজুল ইসলাম (সমসাবাদ), কালু মেম্বার (কাশিমপুর), সোহরাব মিয়া (কাশিমপুর), নান্নু মিয়া (কাশিমপুর), তাহের খলিফা (যন্ত্রাইল) প্রমুখ।
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ৯ই মে নবাবগঞ্জে প্রবেশ করেই কয়েকটি স্থানে নির্মম হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তারা ৯ই মে মতিলাল সাহা নামক এক গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। ১০ই মে পাকিস্তানি বাহিনী নবাবগঞ্জের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামসমূহে এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে তাদের সহযোগী আশরাফ খলিফা, তাহের খলিফা, সিরাজউদ্দিন মাস্টার প্রমুখ স্বাধীনতাবিরোধী কলাকোপার হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর চড়াও হয় এবং গণহত্যা চালায়। কলাকোপা গণহত্যায় ১১ জন গ্রামবাসী শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। নিহতদের লাশ মুক্তিযোদ্ধা তাপস সাহা ও তাঁর পিতা সুবল সাহা (সুবল ফকির) দেওয়ানজী বাড়ির ভেতরে গণকবর দেন। এ-সময় বাগহাটির মো. আলতাফ ও আলহাদিপুরের মোন্নাফ সিকদার ব্রজনিকেতনে লুটতরাজ করে। গণহত্যার পর পাকিস্তানি বাহিনী কলাকোপা বাজারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
একই দিনে পাকসেনারা তাদের কমান্ডার বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে বাগমারা বাজারে লুণ্ঠন শেষে অগ্নিসংযোগ করে বাজারের অধিকাংশ দোকান-পাট পুড়িয়ে দেয় এবং বাজারের ডা. মঙ্গল চন্দ্র সাহাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শান্তি কমিটির নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ ওরফে সোনা মিয়া ও তার সহযোগীরা পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে বক্সনগর জেলেপাড়া আক্রমণ করে এবং গণহত্যা চালায়। বক্সনগর জেলেপাড়া গণহত্যায় জেলে সম্প্রদায়ের ১২ জন লোক শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
৩০শে সেপ্টেম্বর দোহার থানা হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাকসেনারা ইক্রাশী ও কাচারীঘাটে আক্রমণ চালায়। আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তারা হাসনাবাদ পালপাড়া ও খ্রিস্টান পল্লীতে গণহত্যা চালায়। হাসনাবাদ গণহত্যায় ১২ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
১৩ই নভেম্বর গোল্লা মিশনের পাদ্রী ফাদার উইলিয়াম পি ইভান্স (আমেরিকা) নদীপথে নৌকাযোগে বক্সনগর গীর্জায় প্রার্থনা অনুষ্ঠানে যাবার প্রাক্কালে নবাবগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুল মাঠ সংলগ্ন ইছামতি নদীর তীরে তাঁকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানী বাহিনী নবাবগঞ্জ উপজেলার পূর্বাঞ্চল বাগমারা, দিঘীর পাড়, যন্ত্রাইল (নদীর অপর পাড়), বক্সনগর, বর্ধনপাড়া, পাঠানকান্দা, কোমরগঞ্জ, আগলা, নোয়াদ্দা, গালিমপুর, আন্ধারকোঠা, টিকরপুর, ছাতিয়া, গোবিন্দপুর, চূড়াইন, দুর্গাপুর এবং পশ্চিমাঞ্চলের কলাকোপা, সাদাপুর, মাঝিরকান্দা, বান্দুরা, মোলাশীকান্দা হাসনাবাদ খ্রিস্টান পল্লী, মৌলভীডাঙ্গী, নয়ানগর, নতুন বান্দুরা, নয়নশ্রী, দাউদপুর, বারুয়াখালি ও শিকারীপাড়ার গ্রাম এবং বাজারগুলোতে লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ-সময় তারা অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। পাকবাহিনীর এসব নারকীয় তাণ্ডবলীলায় তাদের ব্যাপকভাবে সহায়তা করে দুর্গাপুরের মাওলানা আহমদউল্লাহ পাঠান, তদীয় পুত্রদ্বয় বাহালুল পাঠান ও বদর পাঠান, চূড়াইনের নূরুল আমিন, জালালপুরের আদম আলী, বক্সনগরের মহিউদ্দিন, কাশিমপুরের মতিউর রহমান প্রমুখ।
পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের হামলায় নবাবগঞ্জের বিভিন্ন জনপদে যন্ত্রাইলে আবুল কাশেম, নিমাই বেপারী, অজ্ঞাতনামা এক পাগল, কৈলালে রবী চৌধুরী, বকুল চৌধুরী, আগলায় রওশন সিকদার, আব্দুর রহমান, মঙ্গল, আকরাম আলী, একাব্বর বেপারী, তিলামুদ্দিন, জেহের আলী, গোবিন্দ ঘোষ, আব্দুস সাত্তার, নাসির উদ্দিন ও ৩ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি, বেনুখালিতে আবুল কাশেম, মুন্সিনগরে আবেদ আলী মাঝি, নাওপাড়ার দাগু মাতবর, যোগাইসহ কতিপয় কিষাণ শহীদ হন।
নবাবগঞ্জ উপজেলায় নবাবগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুল ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। উপজেলার কলাকোপা দেওয়ানজী বাড়ি, বক্সনগর জেলেপাড়া এবং হাসনাবাদে গণকবর রয়েছে।
নবাবগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে বান্দুরার যুদ্ধ, গালিমপুরের যুদ্ধ, বাহ্রা-কোমরগঞ্জ যুদ্ধ আগলার যুদ্ধ, নবাবগঞ্জ থানা ক্যাম্প আক্রমণ সৈয়দপুর আগলা-আন্ধারকোঠা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ১৪ই আগস্ট বান্দুরায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর কমান্ডারসহ ৬ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ-যুদ্ধে নবাবগঞ্জ পশ্চিমাঞ্চলের কমান্ডার নূরুল ইসলাম খান, দোহারের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেনের নেতৃেত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন।
২৩ থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গালিমপুরে যুদ্ধ হয়। প্রায় ৫ দিনব্যাপী এ- যুদ্ধে ক্যাপ্টেন জাফরসহ ৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম (বেনুখালি) শহীদ হন। গালিমপুর যুদ্ধের খবর বিবিসি-, নয়াদিল্লী ও <আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আওয়াল (সোনাহাজরা), কমান্ডার বদিউজ্জামান, হাবিলদার নাসির খান, ফ্লাইট সার্জেন্ট ওমর আলী, হারুন- উর-রশীদ, কমান্ডার শওকত হোসেন আঙ্গুরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন।
গালিমপুরের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ২৯শে সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে ৫টি লঞ্চযোগে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা বাহ্রা-কোমরগঞ্জে পৌঁছলে তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। বাহ্রা-কোমরগঞ্জ যুদ্ধে বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং তাদের বহনকারী একটি লঞ্চ ধ্বংস হয়। অপর পাকসেনারা ৪টি লঞ্চযোগে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
অক্টোবর মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের সঙ্গে আগলার যুদ্ধ হয়। রক্তক্ষয়ী এ-যুদ্ধে ৬-৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকিস্তানিরা পালিয়ে যাবার সময় কয়েকজন বেসামরিক মানুষকে হতাহত করে। কমান্ডার শওকত হোসেন আঙ্গুর, সুবেদার রাহাত আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২৮শে অক্টোবর প্রথমবার আব্দুল মতিন চৌধুরী (২নং সাব সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড), শওকত হোসেন আঙ্গুর (নবাবগঞ্জ থানা কমান্ডার), নূরুল ইসলাম খান (নবাবগঞ্জ পশ্চিমাঞ্চলের কমান্ডার), মোহাম্মদ শাহজাহান (নবাবগঞ্জ থানা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), সুবেদার রাহাত আলী (আগলা) প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর নবাবগঞ্জ থানা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অতর্কিত আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব (শ্রীনগর) শহীদ হন।
৪ঠা নভেম্বর দ্বিতীয়বার মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর নবাবগঞ্জ থানা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে হেলিকপ্টার ও গানশিপ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন শহীদ হন।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আগলা-আন্ধারকোঠা নদী পারাপার ঘাটে খণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে থানা কমান্ডার শওকত হোসেন আঙ্গুরের গ্রুপ এবং গ্রুপ কমান্ডার শাহ মো. আবু বকর সিদ্দিকের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন।
২৪শে নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী নবাবগঞ্জ ঘাঁটি ত্যাগ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তারা ঢাকার পথে গোয়ালখালি পর্যন্ত পৌছতে কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁধার সম্মুখীন হয়। খারশুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁধায় কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। নদী পারাপারে কোনো নৌকা না থাকায় পাকবাহিনী গোয়ালখালি ও ডাকপাড়া গ্রামে আটকা পড়ে। চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘেরাও করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধ সৈয়দপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক শহীদ হন।
নবাবগঞ্জ উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সবকটি যুদ্ধেই পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে ২৪শে নভেম্বর নবাবগঞ্জ উপজেলা থেকে পালিয়ে যায় এবং এদিনই নবাবগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আমির হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা বাবর আলী, বক্তার নগর)।
মুক্তিযুদ্ধে নবাবগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আমির হোসেন, বীর প্রতীক (৪ঠা নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নবাবগঞ্জ থানা ক্যাম্প আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ), আব্দুর রহীম (বেনুখালি; ২৬শে সেপ্টেম্বর গালিমপুরের যুদ্ধে শহীদ), ওমর ফারুক (পাড়াগ্রাম; সৈয়দপুরের যুদ্ধে শহীদ), সৈয়দ হোসেন (ছোট রাজপাড়া; কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), ফয়েজ আলী বেগ (পাঞ্জিপ্রহরী, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মোতালেব (শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ ; ২৮শে অক্টোবর নবাবগঞ্জ থানা পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ), ইস্রাফিল খান (শাহবাদ; ভারতে ট্রেনিং এ যাওয়ার পথে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক শহীদ), মাহাবুবুর রহমান (শাহাবাদ), সুজাউদ্দিন খান (শাহাবাদ), আনোয়ার হোসেন (শাহাবাদ), মুসলেমউদ্দিন ওরফে ধনু বেপারী (মাঝিরকান্দা; কলাকোপা যুদ্ধে শহীদ), রেভারেন্ড ফাদার উইলিয়াম ইভান্স (আমেরিকান নাগরিক; মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী, নবাবগঞ্জ ঘাটে শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নবাবগঞ্জ চৌরঙ্গীতে ‘নির্মিত হয়েছে’ স্বাধীনতা ভাস্কর্য। উপজেলা সদরে নবাবগঞ্জ বাজার সংলগ্ন এলাকায় নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স। বর্ধনপাড়ায় শহীদ সৈয়দ হোসেন স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ এবং বর্ধনপাড়া পালবাড়ি থেকে ছোট রাজপাড়া পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সৈয়দ হোসেন সড়ক। শিকারীপাড়া তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী কলেজ ক্যাম্পাসে নির্মিত হয়েছে বিজয়স্তম্ভ। চুড়াইন ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ একটি ভাস্কর্য রয়েছে। নবাবগঞ্জ শহীদ মিনার থেকে কাশিমপুর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা বাবুল স্মরণী। [মো. আনোয়ার হোসেন ও আব্দুল মালেক সিকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড