নবগ্রাম-ডোনারকান্দির যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর)
নবগ্রাম-ডোনারকান্দির যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় ১৪ই মে। এটি ছিল একটি অসম যুদ্ধ। কালকিনি উপজেলার পশ্চিম প্রান্তে নবগ্রাম এবং গৌরনদী উপজেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ডোনারকান্দিতে এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় সাধারণ জনগণ ঢাল, সড়কি, লেজা, বল্লম, তীর-ধনু, রামদা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এ-যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে একজন অফিসারসহ চারজন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনিল চন্দ্র মল্লিক (নবগ্রাম) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
ঘটনার দিন সকালে মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুট মিলস্ ক্যাম্প থেকে পাকসেনাদের একটি দল গৌরনদী উপজেলার ইল্লা গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে সমরসিং গ্রামের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে এগুতে থাকে। পথে তারা গান্ধী মাস্টার ও চিত্ত মজুমদারের বাড়িতে আগুন দেয় এবং জুড়ান ধর, নীলকণ্ঠ বকসী, মদন রুদ্র, বীরেন মাঝি, লক্ষ্মী গোস্বামী, রাধাবল্লভ পোদ্দারসহ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা বাকাই বাজারে এসে স্থানীয় দোসরদের নিয়ে পশ্চিম পাশের পালবাড়ি খালের সাঁকো পার হয়ে তিনটি দলে ভাগ হয়ে তিন দিকে তিনটি হিন্দুপ্রধান গ্রাম শশিকর, নবগ্রাম ও ডোনারকান্দির দিকে অগ্রসর হয়। একটি দল ডাসার স্কুলের নিকটস্থ ব্রিজ পার হয়ে ধামুসা, খিলগ্রাম ও আড়ুয়াকান্দি দিয়ে শশিকরে ঢোকে। যাওয়ার পথে তারা ধামুসা ও খিলগ্রামে একটি গণহত্যা চালায়, যা স্থানীয়ভাবে ধামুসা গণহত্যা নামে পরিচিত। এছাড়া তারা দুজন যুবতী নারী সুমতি বেপারী ও তার ভাইয়ের নববিবাহিতা স্ত্রী বেরসীকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের বাঁচানোর জন্য তাদের কাকা হরিহর বেপারী পেছন থেকে অনুরোধ জানালে সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর হানাদাররা শশিকরের দিকে চলে যায়।
হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় দলটি ডাসার হয়ে তাদের দোসর ইসাহাক সিকদারকে সঙ্গে নিয়ে নবগ্রামে ঢোকে। সেখানে তারা অবিনাশ হালদারের বাড়ি লুট করে এবং সিদ্ধেশ্বর হাওলাদারের বাড়িতে আগুন দেয়। এরপর তারা পার্শ্ববর্তী খাল পার হয়ে পশ্চিম দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। তা দেখে গ্রামের লোকজন খালের সাঁকো ভেঙ্গে ফেলে এবং এক জায়গায় জড়ো হয়ে শোরগোল করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এতে হানাদার বাহিনী ঘাবড়ে যায়। তারা আর সামনে না গিয়ে আলিসাকান্দির কাজেম সিকদারের বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফিরে যায়। যাওয়ার সময় বিরাট চন্দ্র বাইন (পিতা নগেন্দ্রনাথ বাইন) নামে একজন যুবককে গুলি করে হত্যা করে।
হানাদারদের তৃতীয় দলটি ডোনারকান্দি যাওয়ার পথে বাকাইর ঠাকুরবাড়িতে আগুন দেয় এবং গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগুতে থাকে। এ দলে ছিল একজন অফিসারসহ চারজন পাকসেনা। তারা মাঝে-মাঝে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। তাদের গুলিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, তুলসী বৈদ্য এবং যোগেন বাইন নামে তিনজন গ্রামবাসী নিহত হন। নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা ভয়ে পশ্চিম দিকের বিল এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এমতাবস্থায় নবগ্রামের অনিল চন্দ্র মল্লিক, প্রফুল্ল কুমার হাওলাদার, রাজেন্দ্র বাড়ৈ, কৌশিক ঠাকুর, গোকুল মণ্ডল, কুমুদ মল্লিক, অনিল তালুকদার, ধীরেন ভক্ত, গুণধর বৈদ্য, ডোনারকান্দির দেবেন বাড়ৈ, পুলিন বাড়ৈ, পরান সরকার, কালীপদ বালা, অনিল চৌধুরী, সতীশ বিশ্বাস, রমণী সরকার, শান্তি বিশ্বাস, সুবল বিশ্বাস, পীড়ারবাড়ির চিত্তরঞ্জন বলসহ ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ঢাল, সড়কি, কাতরা, বল্লম, লেজা, রামদা ইত্যাদি নিয়ে হানাদারদের আক্রমণ করেন। এতে হানাদাররা ভয় পেয়ে গ্রামের দক্ষিণ পাশে ফসলের ক্ষেতে নেমে পড়ে। একদিকে তিলক্ষেত এবং অন্যদিকে ধানক্ষেত থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় দুদিক থেকে অস্ত্র চালাতে থাকেন। হানাদাররাও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তারা নতুন কাটা ডোনারকান্দি- মাগুরা খালের ওপর চলে আসে। অনিল মল্লিক, চিত্তরঞ্জন বল, কৌশিক ঠাকুর, গোকুল মণ্ডল, প্রফুল্ল হাওলাদার, দেবেন বাড়ৈ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধারাও ঢাল-সড়কি নিয়ে রাস্তার ওপর উঠে আসেন। তাঁদের ধাওয়া খেয়ে পাকসেনারা খালের জলে পড়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা লেজা-বল্লম-সড়কি প্রভৃতি দিয়ে তাদের কোপাতে থাকেন। এতে চারজনেরই মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে একজন পাকসেনার ছোড়া একটি গুলি অনিল মল্লিকের ঊরু ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর মৃত্যু হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী মিলে হানাদারদের লাশগুলো বিলের মধ্যে একটি উঁচু ভিটায় ফেলে রাখে এবং তাদের রাইফেল, পোশাক ও হেলমেটগুলো খুলে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে এ রাইফেলগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।
নবগ্রাম-ডোনারকান্দির যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী শশিকর গ্রাম থেকে মনোজ কুমার রায়, হরলাল বাড়ৈ, বিশ্বেশ্বর বিশ্বাস, রাজেন বাড়ৈ, অখিল মিস্ত্রী, সুনীল, অনিল, রবি, মঙ্গলসহ আরো অনেকে অংশ নেন। এ-যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া এবং সহযোদ্ধাদের লাশ উদ্ধারের জন্য পরের দিন পাকসেনাদের একটি বড় দল অভিযানে আসে। কিন্তু ডোনারকান্দি যাওয়ার পথে এলাকার নাম ‘বাকাই’-এর স্থলে ভুলে ‘বাকাল’ হয়ে যাওয়ায় তারা এখানে না এসে আরো দক্ষিণে বাকালের দিকে যায় এবং চৌদ্দমাদা নামক স্থানে মাঠে কর্মরত কয়েকজন কৃষককে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেখানে যাওয়ার পথে রামসিদ্ধি নামক গ্রামের কৃতী ছাত্র স্বপন বোসসহ অনেক নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। [গণেশ হালদার ও দুলাল সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড