You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নবাবগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর)

নবাবগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর) পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য এবং সরকারি চাকরিতে উর্দুভাষীদের আধিপত্য ও বাঙালিদের ওপর তাদের অত্যাচারের কারণে নবাবগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ৭০-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- বিরামপুর রেলস্টেশনে এক জনসভায় ভাষণ দেন। তাতে প্রায় ৫০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। তারা ৭০-এর নির্বাচনে নবাবগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডলকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করে। কিন্তু নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণে সারা দেশের মতো অত্র অঞ্চলের জনগণের মনেও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চের নির্ধারিত পার্লামেন্ট অধিবেশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একচ্ছত্রভাবে স্থগিত করলে এর প্রতিবাদে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তার ঢেউ নবাবগঞ্জে এসেও লাগে ৷ উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়, সরকারি আদেশ অমান্য করা হয় এবং জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তান সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। ২রা মার্চ নবাবগঞ্জের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। একটি বিশাল মিছিলও সেদিন শহর প্রদক্ষিণ করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে।
৮ই মার্চ নবাবগঞ্জ স্কুল মাঠে সর্বস্তরের জনগণ একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করে। এলাকায় লাঠিসোঁটা, তীরধনুক, বল্লম, তরবারি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহের ধুম পড়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে ডা. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল এমএনএ, নবাবগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শফিউদ্দিন সরদার, সহ-সভাপতি মো. শাহ্ জলিলুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল জলিল মণ্ডলের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ- নেতারা এলাকার যুবসম্প্রদায়কে সংগঠিত করতে শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে ছাত্রলীগ নেতা মো. শামছুল আরেফিন (ডাগু), মো. মকবুল হোসেন, শাহ্ মো. মাহফুজুর রহমান প্রমুখ নবাবগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে তীরধনুক ও লাঠিসোঁটা নিয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। এতে সহযোগিতা করেন মো. আফছার আলী, নুর মোহাম্মদ প্রমুখ। ১১ই মার্চ উপজেলার আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও সেনাসদস্যবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য এগিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে অসহযোগ কর্মসূচিও অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে স্কুল বন্ধের কর্মসূচি জোরালোভাবে পালিত হয়। ১২ই মার্চ ফুলবাড়ি, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও বিরামপুর থানায় গণপ্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে। ১৩ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত জনগণ সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করে চলে।
২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডে ঢাকাসহ দেশব্যাপী অগণিত বাঙালি, বাঙালি পুলিশ, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য এবং ইপিআর সদস্য নিহত হন। এই বেদনাদায়ক ঘটনার সংবাদ নবাবগঞ্জে এসে পৌঁছলে সর্বস্তরের জনগণ স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার পরদিন থেকে ছাত্র-যুবকরা এলাকা ছেড়ে যেতে শুরু করে। তাদের অনেকেই হিলি বর্ডার পার হয়ে দিনাজপুর সদরের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ করে। এভাবে তারা বর্ডারের ইয়ুথ রিসিপশন কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট সেন্টারগুলোতে চলে যায়।
২৬শে মার্চের পর থেকে উপজেলায় হানাদার বাহিনীর আগমন প্রতিহত করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা নবাবগঞ্জ থানায় প্রবেশের কয়েকটি বড় রাস্তার মুখে বড়বড় গাছ কেটে ফেলে রাখে। ভাদুরিয়া বাজারের পূর্বদিকে বিরামপুর রেলস্টেশনের সন্নিকটস্থ ত্রিমণি ও দিকসোঁও নামক স্থানে গাছ ফেলে রাখা হয়। এর সঙ্গে আফছার আলী বিএসসি (দুধেগাছি) এবং আরো অনেকে যুক্ত ছিলেন। সে-সময় রেডিওর সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। এ সংবাদে সকলে স্তম্ভিত হয়ে যায়। আকাশবাণী কোলকাতা, নয়াদিল্লি ও সান্ধ্যকালীন বিবিসি-র খবর ছাড়া আর কোনো উৎস থেকে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো খবরাখবর পাওয়া যেত না। পার্শ্ববর্তী পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, পলাশবাড়ী ও হিলিতে পাকসেনা ও বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআরদের মধ্যে খণ্ড যুদ্ধ চলার খবর লোক মারফত জানা যেত৷
২৮শে মার্চ দুপুরবেলা ঘোড়াঘাট থেকে বাঙালি ইপিআরদের দুটি জিপ এসে দাউদপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে পরমানন্দপুর (পর্দার পাড়া) গ্রামের বড় রাস্তার ওপর দাঁড়ায়। জিপ থেকে দুজন সেনা নেমে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে থাকেন এবং পাকবাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। এ খবর পেয়ে দাউদপুর বাজারের অনেক দোকানদার চিড়া, মুড়ি ও বিস্কুট নিয়ে সেখানে যায় এবং তাঁদের সেগুলো দেয়। অতঃপর বিকেল তিনটার দিকে তাঁরা বিরামপুরের দিকে চলে যান। পরে জানা যায় যে, পলাশবাড়ী, ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জে খণ্ডযুদ্ধ শেষ করে তাঁরা এপথ দিয়ে বিরামপুর হয়ে ফুলবাড়ি যাচ্ছিলেন।
৩০শে মার্চ দুপুরের পর দাউদপুর হাইস্কুল মাঠে এক বিশাল জনসভা হয়। সভায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ প্রায় দু-তিন হাজার লোক উপস্থিত হয়। সভায় থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মো. আব্দুল জলিল মণ্ডল, ছাত্রনেতা ফিরোজ কবির (হেয়াতপুর), মকবুল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী এবং আরো দু-একজন জোরালো ভাষায় বক্তৃতা দেন। মো. আব্দুল জলিল মণ্ডল পাকিস্তান সরকারের কড়া সমালোচনা করে স্থানীয় জনসাধারণকে সর্বদা সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। দাউদপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মালে মোহাম্মদ দেশের পরবর্তী পরিস্থিতি ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানান।
মার্চ মাসের শেষ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী বিরামপুর বন্দর এলাকায় বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকসরকারের একজন সেনাধ্যক্ষ খিজির হায়াত খান বিরামপুরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। তার সঙ্গে বিরামপুরের বিহারিরা একাত্মতা ঘোষণা করে। এখান থেকেই খিজির হায়াত খান বাঙালি নিধনের নীলনকশা প্রণয়ন করে। তার নির্দেশে পার্বতীপুর থেকে জয়পুরহাট পর্যন্ত রেললাইনের উভয় পার্শ্বে ৫ মাইলের মধ্যে অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে দাউদপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মালে মোহাম্মদ স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে অসহায়ত্ব জ্ঞাপন করেন। এতে জনগণ শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।
এদিকে বিরামপুরে পাকবাহিনী ও তাদের লোকজনদের অত্যাচারের মাত্রা দিনদিন বাড়তে থাকে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতোই বিরামপুরের পাকসেনারা রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটি গঠন করে। এসব খবর নবাবগঞ্জে এসে পৌঁছলে পাকিস্তানপন্থীদের অনেকেই বিরামপুরের রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকে। অপরদিকে, স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন দেশ রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধারে সঙ্গে যোগযোগ বৃদ্ধি করতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে দাউদপুর- বিরামপুর রাস্তার বেপারীটোলা নামক স্থানে ছাত্র-জনতার সহায়তায় রাস্তা ও গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এপথ দিয়ে দুজন বাঙালি সেনাসহ একজন পাকিস্তানি সেনা অফিসার যাওয়ার সময় কাটা রাস্তায় তাদের গাড়ি আটকে যায়। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাকে হত্যা করে এবং বাঙালি সেনাদ্বয়কে নিরস্ত্র করে তাদের মো. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল এমএনএ-এর নিকট হস্তান্তর করে। উল্লেখ্য যে, মো. আব্বাছ উদ্দিন নামে এ অঞ্চলের একজন সাহসী ব্যক্তি প্রথমে একাই পাক অফিসারকে ঘায়েল করেন, পরে বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, নবাবগঞ্জ এলাকা ছিল এর ৬নং সেক্টরের অধিভুক্ত। এর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম। ৬নং সেক্টর ৫টি সাব-সেক্টরের বিভক্ত ছিল। সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল রংপুর জেলার (বর্তমান লালমনিরহাট জেলার) বুড়িমারিতে।
১৫ই এপ্রিলের পর পাকবাহিনী বিরামপুর ডাকবাংলোয় একটি স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখান থেকে তারা নবাবগঞ্জে অপারেশন চালাত। ১৮ই এপ্রিল নবাবগঞ্জে জনতা কর্তৃক পাকবাহিনীর নায়েক সুবেদারকে হত্যা করার পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী নবাবগঞ্জে প্রবেশ করে এবং নবাবগঞ্জ থানায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া ভাদুরিয়া অঞ্চলের জামের চড়ায় তাদের একটি ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে ঘোড়াঘাট ও নবাবগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা অপারেশন চালাত। হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদার স্কুলেও পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে তারা হাকিমপুর ও নবাবগঞ্জে হত্যাকাণ্ড চালাত।
১০ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ১৭ই এপ্রিল সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চতর যুদ্ধকৌশল রপ্ত করার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে গমন করেন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ নাগাদ নবাবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতি লক্ষ করে স্বাধীনতাবিরোধীরা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় পত্নীচরের অবাঙালিরা। তারা স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও তাদের সম্পদ লুট করতে থাকে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাকিস্তানপন্থীদের বাড়িতে আস্তানা গেড়ে তারা এসব কর্মকাণ্ড চালাত।
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল নজিবর রহমান এবং সদস্য ছিল মোজাফফর হোসেন, কায়তুল্লাহ প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য হলো- মো. সাপু মিয়া (বল্লভপুর), মো. আতাউল্লা (ঐ), আব্দুল হান্নান (ঐ), ভাদু মিয়া (ঐ), মো. আজাহার আলী (ঐ), জালাল উদ্দিন (ঐ), মমতাজ উদ্দিন (ঐ), আতাউর রহমান (ঐ), এন্তাজ আলী (ঐ), মো. বছির উদ্দিন (ঐ), ইসমাইল হোসেন (ঐ), আতাবুর রহমান (ঐ), আবুল হোসেন মাস্টার (ঐ), মো. আব্দুস ছামাদ (খয়ের গুনি), মো. হান্নান (ঐ), মো. রেজাউল ইসলাম (ঐ), মো. আমজাদ আলী (ঐ), মো. বদিউজ্জামান (ঐ), মো. বেলাল বিশ্বাস (হরিল্যাখুর), মো. শান্তি বিশ্বাস (ঐ), টুকু বিশ্বাস (ঐ),মহসীন আলী (পশ্চিম খোদাইপুর), মো. আবুল হোসেন (বেড়ামারিয়া), আক্কাছ আলী মণ্ডল (মতিহারা), মো. আলেফ উদ্দিন (তিখুর), মো. তইজ উদ্দিন (নন্দনপুর), মো. মোজাফ্ফর হোসেন (চকদলু), মো. আ. ছালাম (হরিপুর), মো. লুৎফর রহমান (হরিপুর), মো. ফেকু মিয়া (হরিপুর), মো. আব্দুর গাফ্ফার (হেয়াতপুর), মো. এন্তাজ আলী (হেয়াতপুর), মো. আব্দুল ওহাব (হেয়াতপুর), মো. আ. খালেক (হেয়াতপুর), মো. ফরজান আলী (হেয়াতপুর), মো. আ. হান্নান (হেয়াতপুর), মো. কছির উদ্দিন প্রধান (জিয়া কাঠাল), একরামুল হক (হেয়াতপুর), এমাজ উদ্দিন (হেয়াতপুর), আলেম উদ্দিন (হেয়াতপুর), নিজাম উদ্দিন (দাউদপুর) প্রমুখ।
যুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নির্যাতন ও গণহত্যায় সাহায্য করেছিল, তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন হলো— মো. আবুল হোসেন (বল্লভপুর), মো. ইলিয়াস উদ্দিন (দ্বারিয়া), আব্বাছ উদ্দিন (মতিহারা), হাবিবর রহমান খান (বিনোদনগর), নেজাম উদ্দিন (দাউদপুর) প্রমুখ।
নবাবগঞ্জে পাকবাহিনীর সহায়তায় শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার এবং অবাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। কোনো বাঙালিকে সামনে দেখলেই তারা গুলি করে হত্যা করত। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত। পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তারা খয়েরগনি, প্রাণকৃষ্ণপুর, আন্দলগ্রাম, কপালদাঁড়া ও গরিবপাড়ায় অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অর্থ-সম্পদ লুট করে এবং নারী অপহরণ ও নারী-শিশুদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। তাদের পৈশাচিক বর্বরতার শিকার হন খয়েরগনি, চকদলু, গরিবপাড়া, কপালদাঁড়া, খোসলামপুর, প্রাণকৃষ্ণপুর, আন্দলগ্রাম ও জগন্নাথপুর গ্রামের অসংখ্য মা-বোন, সম্ভ্রম হারান অনেক কুলবধূ। তারা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক, বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থককে খুঁজে-খুঁজে নির্যাতন চালাত। পাকবাহিনীর কাছে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে প্রাণভয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৩০শে নভেম্বর (১৩ই অগ্রহায়ণ) রাতে পাকবাহিনী দাউদপুর বাজার ঘেরাও করে ১৪০ জন লোককে ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ফজরের নামাজ আদায়ে মসজিদে আসা রোজাদাররাও ছিলেন। ভোরবেলা তাদের নিয়ে হানাদার বাহিনী বিরামপুর অভিমুখে রওনা দেয়। পথে বেপারীতলা গ্রামের পূর্বদিকে শড়ের বিলের ধারে তাদের জড়ো করে। সেখানে আরো কয়েকজনকে ধরে এনে তাদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ধৃতদের কয়েকজন হলেন- ডা. আব্বাছ উদ্দিন আহমেদ, খন্দকার অছিম উদ্দিন, খিতাব উদ্দিন মুন্সী (মনিরামপুর), আব্দুস ছালাম বিশ্বাস, আফাজ উদ্দিন চৌধুরী, নাজির উদ্দিন খলিফা, গোফফার আলী, শমসের আলী মণ্ডল, জোনাব আলী চৌধুরী, আব্দুল জোব্বার চৌধুরী, আজগর আলী, অমল ধর কর্মকার, টুটু বাবু, মোশারফ হোসেন, মো. আহাদ আলী হাজী, মো. ইউসুফ আলী, আলেফ উদ্দীন, ডা. রজিব উদ্দিন প্রমুখ। তবে এদের হত্যা না করে অজ্ঞাত কারণে এদিন বিকেলে সকলকে ছেড়ে দেয়া হয়।
পাকবাহিনী এ উপজেলায় চারটি গণহত্যা চালায়- চকদল গণহত্যা, খয়েরগনি গণহত্যা, কাতলমারী গণহত্যা এবং চড়ারহাট-আন্দল গণহত্যা। ২৩শে এপ্রিল চকদলুতে ১৯ জন, ২০শে জুলাই খয়েরগনিতে প্রায় অর্ধশত, ১৫ই সেপ্টেম্বর কাতলমারীতে ১৯৫ জন এবং ১০ই অক্টোবর চড়ারহাট-আন্দল গ্রামে শতাধিক জনকে হত্যা করা হয়। বিরামপুরে বহু পাকা ইঁদারা ছিল। পাকসেনারা বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালিয়ে যাদের ধরে আনত, তাদের রাতের বেলা হত্যা করে ঐসব ইঁদারায় ফেলে দিত। ইঁদারাগুলো বর্তমানে ব্যবহারের অযোগ্য। এছাড়াও পাকসেনা ও তাদের দোসররা নানাভাবে এলাকার মানুষদের ওপর নির্যাতন চালাত।
নবাবগঞ্জ উপজেলায় দুটি গণকবর রয়েছে— চকদলু গণকবর ও চড়ারহাট গণকবর। ২৩শে এপ্রিল চকদলু গণহত্যায় শহীদদের চকদলু গণকবরে এবং ১০ই অক্টোবর চড়ারহাট-আন্দল গণহত্যায় শহীদদের চড়ারহাট গণকবরে সমাহিত করা হয়। ১৫ই সেপ্টেম্বর কাতালমারী গণহত্যায় শহীদদের নিকটস্থ যে কূপগুলোতে ফেলা হয়, সেগুলো পরবর্তীকালে ভরাট করা হয়। ফলে কূপগুলো আর পূর্বের অবস্থায় নেই।
জুন মাসের প্রথম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকেন। নবাবগঞ্জের অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজ এলাকায় এসে আশুড়ার বিলের শালবন ও অন্যান্য স্থানে আত্মগোপনে থেকে গেরিলা তৎপরতা শুরু করেন। সেসময় পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল বলাহার ও ভাদুরিয়া ক্যাম্প। সেখান থেকে তারা হিলির ডাঙ্গাপাড়া, বিরামপুর, ফুলবাড়ি, নবাবগঞ্জ প্রভৃতি ক্যাম্পে যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহ করত। সেই সরঞ্জাম নিয়ে একটি গরুর গাড়ি একবার বলাহার থেকে বিরামপুরের দিকে রওনা করে। এ খবর পেয়ে নবাবগঞ্জের দুই প্লাটুন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাশেম চিশতীর নেতৃত্বে বিজুলবাজার এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। উভয় পক্ষে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। এ যুদ্ধ বিজুলবাজার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
জুলাই মাসের ৩ তারিখ গরিবপাড়ায় একটি গেরিলা যুদ্ধ হয়। পাকসেনারা তাদের বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ ক্যাম্পের মধ্যে চলাচলের সময় রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলোতে লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালাত। এ থেকে গ্রামবাসীদের মুক্ত করার জন্য ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মো. মোছফার রহমানের নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের প্রতিরোধ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর শত্রুপক্ষ পরাস্ত হয়।
গরিবপাড়া যুদ্ধ-এ সেদিন ৬ জন রাজাকার নিহত হয়, দুজন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকি পাকসেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়।
আগস্ট মাসের ৫ তারিখ রাতে দাউদপুরের উত্তরে হালুয়াঘাটের বড় ব্রিজটি মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিরামপুর থেকে পাকসেনাদের যানবাহন দাউদপুরে প্রবেশ করতে না পারে। ব্রিজের পাশে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হলেও তাদের প্রতি গ্রামবাসীদের আস্থা বেড়ে যায়। এরপর থেকে নবাবগঞ্জ এলাকাবাসী প্রতিগ্রামে নৈশকালীন পাহারার ব্যবস্থা করে। বিশেষ করে মহিলাদের সম্মান রক্ষা, চুরি-ডাকাতি বন্ধ করাসহ পাকবাহিনীর আগমন সম্পর্কে পূর্বসতর্ক হওয়ার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়।

১০ই আগস্ট ঘোড়াঘাট থানার কলাবাড়িতে একটি যুদ্ধ হয়। এর আগের দিন পাকসেনারা স্থানটি দখল করে নিলে সুবেদার মেজর রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভোররাতে অতর্কিতে হামলা করেন। প্রায় দুঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা কলাবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে নবাবগঞ্জের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে কাটলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের আব্দুল খালেক ডাঙ্গাপাড়ায় অবস্থিত পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে গিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি ভাদুরিয়া ইউনিয়নের পুঁটিহার গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ শালখুরিয়া গ্রামের বছিরউদ্দিনের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা বহরুল্লাহ ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গোপনে গ্রামে আসেন। কিন্তু শান্তি কমিটির লোকেরা এ খবর পেয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি সেক্টর কমান্ডার নূরুজ্জামানের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। একই দিনে বেড়ামালিয়া গ্রামের ইউপি সদস্য কেরামত মাস্টারকেও হত্যা করা হয়। এদুটি হত্যাকাণ্ড এবং মতিহার গ্রামের কুখ্যাত দালাল আব্বাছ আলীর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে অপরেশন চালান। অপরেশনে ৩ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। প্লাটুন কমান্ডার সামসুল আরেফিন, ডা. মোফাজ্জল হোসেন এবং রেজানুল হকের নেতৃত্বে এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হন। আব্বাছ আলী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ ঘটনার পর দালালরা আর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ওপর আঘাত করার সাহস দেখায়নি।
নবাবগঞ্জের দু-একটি গ্রামে রাজাকারদের প্রভাব ছিল। পাকসেনাদের সহায়তায় তারা বিভিন্ন গ্রামে লুঠতরাজ চালাত। ডিসেম্বর মাসের ২-৩ তারিখের মধ্যে তারা আজমপুর, ঈশ্বরপুর ও জাতেরপাড়া গ্রামসহ আরো কয়েকটি গ্রাম লুণ্ঠন করে। প্রত্যেক গ্রাম থেকে গরু-ছাগল, থালা- বাসন, চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি নিয়ে যায়। একই মাসের প্রথম সপ্তাহে পলাশবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেজাউল করিমকে একদল রাজাকার ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখ বিরামপুর রেললাইনের পূর্বপাশে মোহাম্মদপুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে চরকাই-জগরুপাড়ার ছবেদ আলীর পুত্র আবুল কাশেম শহীদ হন।
ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে পাকসেনারা ডাঙ্গাপাড়া, বিরামপুর, ফুলবাড়ী ও নবাবগঞ্জের ছোটছোট ঘাঁটিগুলোকে সরিয়ে এনে ভাদুরিয়া বাজারে একটি শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। ৫ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌধভাবে এ ঘাঁটি আক্রমণ করে। কিন্তু পরিস্থিতি পাকবাহিনীর অনুকূলে থাকায় এদিন ৫-৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ৫৫ জন সদস্য শহীদ হন। পরের দিন ৬ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করলে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে যায়। এদিনের যুদ্ধে ৮২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তাদের ৮টি ট্যাংক ধ্বংস হয়। ভাদুরিয়া বাজার যুদ্ধ-এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ৬ই ডিসেম্বর নবাবগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
৬ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হলেও এর পাশে অঞ্চলগুলোতে তখনো যুদ্ধ চলছিল। ৭ই ডিসেম্বর বিকেলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কয়েকটি বিমান পার্বতীপুর থেকে দক্ষিণে পাঁচবিবি পর্যন্ত রেললাইনের ওপর বেপরোয়া বোমা বর্ষণ করে পাকবাহিনীর অবস্থান তছনছ করে দেয়। ৯ই ডিসেম্বর রাত্রে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহর ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করে ফুলবাড়ির মোহনপুর ঘাট পার হয়ে বিরামপুরের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় বিরামপুর বর্ডার এলাকায় পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে অবিরাম গোলাগুলি চলছিল। এতে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহর বিনা বাধায় নবাবগঞ্জের উপকণ্ঠে চলে আসে। ১০ই ডিসেম্বর দুপুরের পর ট্যাংক বহর ও পদাতিক ডিভিশনের যোদ্ধারা দাউদপুর বাজারে প্রবেশ করে। এদিন ছিল হাটবার। মিত্রবাহিনী আসার কারণে হাট বসেনি। তবে চারপাশের গ্রামগুলো থেকে দলে-দলে লোকজন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে দাউদপুর বাজারে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহর দেখতে আসে। সন্ধ্যার আগে মিত্রবাহিনীর যোদ্ধারা বাজার থেকে লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলেন। কারণ, তারা জানান ভাদুরিয়া ও দারোগার বাগান এলাকায় পাকবাহিনীর কতিপয় সৈন্য মিত্রবাহিনীর গতিরোধ করে আছে। যে- কোনো সময় গোলাগুলি শুরু হতে পারে। তা-ই হয়েছিল। এদিন বিকেল ৩টার দিকে মিত্রবাহিনীর একটি পদাতিক দল দাউদপুর হয়ে ঘোড়াঘাটের দিকে রওনা দিয়েছিল। তাঁরা ভাদুরিয়া স্কুল অতিক্রম করার সময় স্কুলঘরে লুকিয়ে থাকা পাকসেনারা পেছন থেকে তাঁদের আক্রমণ করে। ফলে উভয় পক্ষে সেখানে যুদ্ধ হয়।
মিত্রবাহিনীর কথামতো দাউদপুর বাজারের লোকজন দ্রুত সরে যায়। পরের দিন থেকে মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। মিত্রবাহিনীর ক্যাম্প ছিল দাউদপুর হাইস্কুলে। তাঁদের আরেকটি গ্রুপ নবাবগঞ্জ থেকে পূর্বদিকে কাঁচদহ ঘাটে অবস্থান করছিল। তাঁরা নদীতে রাবার বেলুন-ব্রিজ নির্মাণ করে যানবাহন পারাপারের ব্যবস্থা করেন। পাকবাহিনীর গোলা ভাদুরিয়া থেকে কাঁচদহ ঘাট পর্যন্ত এসে পড়তে শুরু করে। এতে কাঁচদহ ও দীঘিপাড়া গ্রামের বহু মানুষ হতাহত হয়। ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মিত্রবাহিনী ভাদুরিয়া অতিক্রম করে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত যেতে সক্ষম হয়। ওদিকে কাঁচদহ ঘাটের মিত্রবাহিনী করতোয়া নদী অতিক্রম করে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ-মিঠাপুকুর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর যেসব সেনা দারোগার আমবাগানে অবস্থান নিয়েছিল, তারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে মিত্রবাহিনী নির্বিঘ্নে ঘোড়াঘাট হয়ে গোবিন্দগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। তবে ৬ই ডিসেম্বর নবাবগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হলে এ অঞ্চলের মানুষ ঐদিন থেকেই ঘরে ফিরতে শুরু করে।
নবাবগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আবু বকর সিদ্দিক (পিতা মো. আব্দুল গফুর, কাশিয়ারি), সুজাত আলী (পিতা মো. বরকেত আলী, নির্শা), আসাদুজ্জামান (পিতা মো. বানু মণ্ডল, হেলেঞ্চা), জহর আলী (ভাদুড়িয়া), নজরুল ইসলাম (পিতা মো. মোবারক আলী, রণজয়পুর), আব্দুল খালেক (পিতা কফিল উদ্দিন, ঘুরণপুর), ফারায়েজ আলী (পিতা ফজর উদ্দিন), আবুল কাশেম (পিতা ছবেত আলী ফকির, চরকাই), মকবুল হোসেন (পিতা মনছুর আলী, মোয়াপুকুর, বিরামপুর), সৈয়দ আলী (পিতা মফিজ উদ্দিন, ঐ), মোহাম্মদ আলী (পিতা মনসুর আলী, ঐ), আব্দুল জব্বার (পিতা আব্দুর রহমান মোল্যা (বিরামপুর), আফসার আলী (পিতা কলিমুদ্দিন, পূর্ব বইদর, দাউদপুর), মো. হাসান (পিতা মো. মনসুর রহমান, মোয়াপুকুর, বিরামপুর), কর্নেল মার্ডি (পিতা সাম মার্ডি, মালারপাড়া নবাবগঞ্জ), মোজাম্মেল হোসেন (পিতা কছিম উদ্দিন, দাউদপুর), গোলজার রহমান (পিতা খিজির উদ্দিন, হাশারপাড়া), আজাহার আলী (পিতা কিনাতুল্যা মণ্ডল, শালঘরিয়া), কৈলাশ চন্দ্র (খোষলামপুর), আলতাফ হোসেন (পিতা আফান উদ্দিন, বড়মাগুরা), মিজানুর রহমান (পিতা খয়ের উদ্দিন, হরিল্যাপুর), শহিদুল ইসলাম (পিতা মো. আব্দুর রহিম মণ্ডল, ফতেপুর মাডাষ), আবুল কাশেম (পিতা বরতুল্ল্যা, শালখুরিয়া), তোফাজ্জল হোসেন (পিতা কামাল উদ্দিন, বেড়ামালীয়া), মোসলেম উদ্দিন (পিতা ইসহাক আলী, আন্দলগ্রাম), আফতাব উদ্দিন (পিতা হাজী সাকাতুল্ল্যাহ, ঐ), মাহবুবুর রহমান (পিতা তছির উদ্দিন, পলাশবাড়ী), নজরুল ইসলাম (পিতা মোবারক আলী, রঞ্জয়পুর), আসাদুজ্জামান (পিতা বানু মোহাম্মদ মণ্ডল, হেলেঞ্চা), আমিনুল ইসলাম (পিতা খাজের উদ্দিন, বড়মহেশপুর), জহুর আলী (পিতা আহাদ আলী, ঐ), আবুল খালেক (পিতা কফিল উদ্দিন, শাল্টিমুরাদপুর), আবু বক্কর সিদ্দিক (পিতা আ. গফুর খন্দকার, কাশিপাড়া), আবু বক্কর সিদ্দিক (পিতা বদিউজ্জামান, খয়েরগুনি), সামছুল হক (পিতা শফির উদ্দিন, ঐ), নুর মোহাম্মদ (পিতা ইছার উদ্দিন, খয়েরগুনি), নুর মোহাম্মদ (পিতা মেছের আলী, দেওগাঁ), আব্দুরস সামাদ (পিতা দারাজ আলী, দাউদপুর), এ বি এম আফসার আলী (পিতা কলিম উদ্দিন, পূর্ব বৈদাহার), খাইরুল বাশার (পিতা মনির উদ্দিন, উত্তর মুরাদপুর), মমতাজুল ইসলাম (পিতা খেতাব উদ্দিন হেয়াতপুর)। এছাড়া আন্দলগ্রামের একজন অজ্ঞাতনামা অপ্রকৃতিস্থ মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।
নবাবগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা সদরে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামফলকসহ স্মৃতিস্তম্ভ। চড়ারহাটের গণহত্যাস্থলে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া একই স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চড়ারহাট শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়। ভাদুরিয়া স্কুল ও কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সরণী। [মাসুদুল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!