নবাবগঞ্জ থানা ক্যাম্প আক্রমণ (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)
নবাবগঞ্জ থানা ক্যাম্প আক্রমণ (নবাবগঞ্জ, ঢাকা) পরিচালিত হয় দুবার – ২৮শে অক্টোবর ও ৪ঠা নভেম্বর। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব শহীদ হন।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ খান মজলিশ, মোহাম্মদ শাহজাহান ও সুবেদার রাহাত আলীর পরিকল্পনা মোতাবেক ২৮শে অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রথমবার মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণের পূর্বে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর অনেক সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তাদের নিকট থেকে ১৯টি অগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে ৫টি গ্রুপে ভাগ করে আক্রমণ চালানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ ক্যাম্পের দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে গ্রেনেড চার্জ করে। বাকি ৪টি গ্রুপের একটি যন্ত্রাইল, একটি দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের সামনে, একটি নবাবগঞ্জ বাজার এলাকায় এলএমজি ও অন্যান্য মাঝারি ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কভার দেয়ার জন্য এবং ৪র্থ গ্রুপটি ক্যাম্পের দেয়ালের পাশাপাশি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে সহায়তা দেয়ার জন্য রাখা হয়। এ-সময় নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকসেনা ক্যাম্পে প্রায় ৩ শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে গেটে পাহারারত সেন্ট্রিকে হত্যা করেন। অতঃপর ভেতরে অবস্থানরত হানাদার সৈন্যদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করেন ও অস্ত্র দ্বারা গুলি চালান। পাকিস্তানি সৈন্যরা পাল্টা গুলি করে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের এ অতর্কিত আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এ-যুদ্ধে শ্রীনগর থানার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব শহীদ হন। যুদ্ধে আব্দুল মতিন চৌধুরী (২নং সাব-সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), শওকত হোসেন আঙ্গুর (নবাবগঞ্জ থানা কমান্ডার), নূরুল ইসলাম খান (নবাবগঞ্জ পশ্চিমাঞ্চলের কমান্ডার), মোহাম্মদ শাহজাহান (নবাবগঞ্জ থানা সেকেন্ড- ইন-কমান্ড), সুবেদার রাহাত আলী (আগলা), আনোয়ার হোসেন (কাশিমপুর), শাহজাহান (সিংহড়া), শাহ মো. আবু বকর সিদ্দিক (গালিমপুর), কে এস আলম পোকরাজ (কলাকোপা), নাজিমউদ্দিন (কান্দামাত্রা; যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত), দেওয়ান আব্দুর রফিক (মহব্বতপুর), আব্দুল মোতালেব (শ্রীনগর), নজরুল, শাকিল, বাবন, হাফিজ, হাসান মোল্লা, দারাজউদ্দিন (দিঘির পাড়) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার এসে আহত পাকিস্তানি সৈন্যদের তুলে নিয়ে যায় এবং নিহত ১০ জনকে নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে কবর দেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃস্থানীয় কমান্ডারগণ নবাবগঞ্জ থানা পাকিস্তানি বাহিনীর নবাবগঞ্জ হাইস্কুল ক্যাম্প পুনরায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ঠা নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সাদাপুর ব্রিজের পূর্ব পাশে মাইন পুঁতে সার্বক্ষণিক পাহারা দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৫ জনের একটি গ্রুপ হানাদারদের ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেয় এবং ঐদিন সকাল ৮টায় আক্রমণ চালায়। এর পরপরই উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে একটি জঙ্গি বিমান এসে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়লে আরো ২টি জঙ্গি বিমান এসে পাকসেনাদের পক্ষে যোগ দেয়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে স্থান পরিবর্তন করে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেন।
অন্যদিকে কাশিমপুর কবর স্থানে অবস্থানরত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ হানাদার বাহিনীর ওপর প্রচণ্ডভাবে গুলি চালাতে থাকে। এ-সময় কমান্ডার আমির হোসেন সম্মুখ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। চিকিৎসার্থে ডাক্তারের কাছে নেয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর গ্রামবাসীর সহায়তায় সহযোদ্ধারা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনকে বক্তারনগরে নিজবাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর হেলিকপ্টার গানশিপে করে হতাহত সৈন্যদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
নবাবগঞ্জ হাইস্কুল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখল যুদ্ধে আমির হোসেন (বক্তারনগর), মো. শাহজাহান (মাঝির কান্দা), এ টি এম এ ডা. হান্নান (মৃধাকান্দা), মো. নাসির উদ্দিন পান্নু (মাঝির কান্দা), মো. রফিক দেওয়ান (মহব্বতপুর), ছাহের উদ্দিন (মাধবপুর), মো. হাবিব (লক্ষ্মীপ্রাসাদ), আব্দুল মান্নান (দাউদপুর), আফিলউদ্দিন আপেল (রাধাকান্তপুর), কালীপদ মাস্টার (নতুন বান্দুরা), মো. আরমান সিকদার (পুরাতন বান্দুরা), আব্দুল করিম (হাসনাবাদ), মো. শুকুর আলী (হাসনাবাদ), আব্দুল ওয়াহেদ (চর তুইতাল), মো. আজাদ (বারুয়াখালী), মো. আনোয়ার হোসেন (বড় রাজপাড়া), তাপস সাহা (কলাকোপা), আব্দুস সালাম (কলাকোপা), আব্দুল হামিদ (চর তুইতাল), ফিলিপ কোড়াইয়া (তুইতাল), ইপিআর সদস্য মো. আলাউদ্দিন, এ কে মীর আমান, মীর কাসেম (কলাকোপা), এ কে মীর জামান (কলাকোপা), মো. হানিফ (মাঝির কান্দা), সমর গোস্বামী (কলাকোপা) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। [মো. আনোয়ার হোসেন ও আব্দুল মালেক সিকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড