স্থানীয় মুক্তিবাহিনী নবাব্দী বাহিনী (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)
নবাব্দী বাহিনী (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। হরিনগরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নবাব্দী ফকির এর প্রতিষ্ঠাতা। বাহিনীটির পুরো নাম ‘নবাব্দী ফকির বাহিনী’ হলেও স্থানীয়ভাবে এটি ‘নবাব্দী বাহিনী’ নামে সমধিক পরিচিত ছিল। এর সদস্য ছিলেন নবাব্দী ফকিরের ছেলে, মেয়ে ও কয়েকজন স্থানীয় যুবক। নবাব্দী ফকিরের নিজের চেষ্টায় সংগৃহীত কয়েকটি অস্ত্র ও কিছু গোলাবারুদ ছিল এ বাহিনীর যুদ্ধ-সামগ্রী। তবে যুদ্ধ নয়, মানবিক কাজ করাই ছিল এ বাহিনীর মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই পাকসেনা ও তাদের দোসরদের অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য যেসব শরণার্থী দেশ ত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার সময় নানারকম বিড়ম্বনার শিকার হতো, নবাব্দী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সাহায্য করতেন।
নবাব্দী বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ছিল প্রধানত সুন্দরবন এলাকা। শ্যামনগরের সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকা থেকে যেসব শরণার্থী নদীপথে ভারতে যেত, নবাব্দী বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিরাপদে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। বিশেষত হিন্দুরা যাতে রাজাকার ও পাকবাহিনীর আক্রমণের শিকার না হয়, সে-দিকে তাঁরা লক্ষ রাখতেন।
৪ঠা সেপ্টেম্বর নবাব্দী বাহিনী ও পাকিবাহিনীর মধ্যে একটি নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এদিন চুনকুড়ি নদীর প্রবেশমুখে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি গানবোট আক্রমণ করেন। পাকবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। নবাব্দী বাহিনী সীমিত পরিমাণ অস্ত্র দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের পরাস্ত করে। এ-যুদ্ধে হরিনগরের দুজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এ ঘটনার চারদিন পর ৯ই সেপ্টেম্বর পাকসেনারা প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে আসে এবং রাজাকারদের সহায়তায় হরিনগর বাজারে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়, যা হরিনগর গণহত্যা নামে পরিচিত। সেদিনও নবাব্দী বাহিনী প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলা- বারুদের অভাবে সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি।মিজানুর রহমান] নবীগঞ্জ উপজেলা (হবিগঞ্জ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর নবীগঞ্জের ছাত্র, রাজনীতিবিদ এবং স্বাধীনতাকামী মানুষ যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। একই সঙ্গে শুরু হয় সাংগঠনিক কার্যক্রম। ২২শে মার্চ সকালে নবীগঞ্জ ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সহস্রাধিক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা মো. আব্দুর রউফ (চরগাঁও) এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হক চৌধুরী (চরগাঁও)। এ সময় মো. আব্দুর রউফের সঙ্গে ঢাকা থেকে আগত আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ নেতা কামাল আহমেদ পাকিস্তানি পতাকায় আগুন দেন। ঘটনাস্থলে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস ছালাম, ডা. নিম্বরুর রহমান চৌধুরী, আলহাজ্ব হিরা মিয়া, শিক্ষক রামদয়াল ভট্টাচার্য, আব্দুস সোবহান মাস্টার, চারুচন্দ্র দাস, মিহির কুমার রায় মিন্টু, আব্দুল মতিন চৌধুরী, আজিজুর রহমান ছুরুক মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ২৩শে মার্চ নবীগঞ্জ ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে মো. আব্দুর রউফের নেতৃত্বে এখলাছ আহমেদ চৌধুরী, বদরুজ্জামান, ওহিদুর রহমান চৌধুরী, মহিবুর রহমান আহমেদ, মাহমুদ আলী, আবিদুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মন্নান ছানু মিয়া, নজরুল ইসলাম দুলু, মর্তুজা মিয়াসহ শতাধিক ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। দিনারপুরের সাতাইহাল গ্রামে ডা. সিরাজুল ইসলাম (গ্রাম্য ডাক্তার), এনামুল হক, সাহাবুদ্দিন মাস্টার, আজিজুর রহমান, নূর উদ্দিন প্রমুখ ফুলতলি বাজারে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন স্থানীয় —ছাত্রলীগ নেতা হিফজুর রহমান।
২২শে মার্চ পতাকা উত্তোলন এবং ২রা এপ্রিল শেরপুরে নবীগঞ্জের হাজার-হাজার জনতার প্রতিরোধযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭শে মার্চ থেকে সেনাসদস্য শাহ ফজর আলী (মান্দারকান্দি, ১২ নং কালিয়ারভাঙ্গা) নবীগঞ্জে এসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মিলিত হন, ছাত্র-যুবকদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করে দেন এবং গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। ছাত্রনেতা মো. আব্দুর রউফের নেতৃত্বে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ নবীগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য প্রচারণা চালান এবং বিভিন্ন এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। দিনারপুরে ছুটিতে বাড়ি আসা সুবেদার জহুরুদ্দিন (বড়গাঁও) এবং ছাত্রনেতা মাহবুবুর রব সাদী এলাকার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে সিভিল গান ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। সংগ্রাম পরিষদের তরুণ ছাত্রনেতারাও এ বাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীতে নূর উদ্দিনসহ নবীগঞ্জের অনেকে ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
নবীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হক চৌধুরী, মাহবুবুর রব সাদী, মো. আব্দুর রউফ, ডা. নিম্বরুর রহমান চৌধুরী, মাস্টার আব্দুস সোবহান, শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ওরফে বিধুবাবু, আলহাজ্ব হিরা মিয়া, শিক্ষক রামদয়াল ভট্রাচার্য, চারুচন্দ্র দাস, আব্দুল মতিন চৌধুরী, আজিজুর রহমান ছুরুক মিয়া, আব্দুল আজিজ চৌধুরী, আব্দুল মন্নান ছানু মিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ২রা এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি দল সিলেট থেকে অগ্রসর হয়ে শেরপুর ও সাদীপুরের মধ্যবর্তী কুশিয়ারা নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থান নেয়। এ-সময় মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তমএর দলের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ খবরে নবীগঞ্জের আপামর জনতা দেশীয় অস্ত্র লাঠি, বল্লম, তীর- ধনুক, ফিকল ও বন্দুক নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে সকালে নবীগঞ্জ পূর্ব বাজারে জমায়েত হয়। তারা নবীগঞ্জ থেকে শেরপুরের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়। নয়মৌজার আব্দুল মন্নান ছানু মিয়ার নেতৃত্বে একটি বাহিনী এবং দিনারপুর থেকে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে অপর একটি বাহিনী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। হাজারো মানুষের ‘জয় বাংলা” স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এ- সময় পাকিস্তানি বিমান আকাশে চক্কর দেয় এবং পাকবাহিনী পিছু হটে সিলেটের দিকে চলে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর ইউসুফ দুররানী ভাটি অঞ্চলে ঘাটি স্থাপনের জন্য স্থানীয় শান্তি কমিটি-র সঙ্গে আলোচনা করে ১৫ই আগস্ট নবীগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে থানা এবং সিও অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া দিনারপুর হাইস্কুল এবং বাউসা চৌধুরী বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল।
পাকবাহিনী নবীগঞ্জে অনুপ্রবেশের পূর্বেই মে মাসে কুর্শি ইউনিয়নের রাইয়াপুর গ্রামের ইসমাইল মাওলানা এবং নবীগঞ্জ বাজারের বাসিন্দা গুজাখাইর গ্রামের আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথমে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ইউনিয়ন পর্যায়ে তাদের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- নবীগঞ্জের আব্দুল লতিফ চৌধুরী, মাশরুর খান, সঞ্জব আলী প্রমুখ। মাওলানা সামছুদ্দিনকে (সাতাইহাল) সভাপতি এবং তার জামাতা একই গ্রামের মাওলানা গিয়াস উদ্দিনকে সেক্রেটারি করে দিনারপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয়। পাকবাহিনীকে নবীগঞ্জে আসার জন্য তারা উদ্বুদ্ধ করে।
রাজাকার বাহিনী গঠনের পর এ বাহিনী নবীগঞ্জের আদিত্যপুর হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে ব্যাপক লুটপাট শুরু করে। এছাড়া বাউসা ইউনিয়নের চৌধুরী বাজার এবং দিনারপুর হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতন ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়। তাদের সহায়তায় পাকবাহিনী নবীগঞ্জ বাজার, আদিত্যপুর, কানাইপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালায়। মুক্তিযোদ্ধা শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ওরফে বিধুবাবুকে গ্রেফতারের জন্য শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুর রহমান থানার ওসি আবদুল মালেকের সহায়তায় জুন মাসের প্রথমদিকে জমাদারসহ সশস্ত্র ৪ জন পুলিশকে তাঁর বাড়িতে পাঠায়। পুলিশের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে জমাদারসহ ২ জন পুলিশ কনেস্টেবল এবং শ্যামাপ্রসন্নের সহকারী প্রমোদ নিহত হয়। জুন মাসের মাঝামাঝি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. নিম্বারুর রহমান, আবদুস সোবহান মাস্টার এবং আবদুল হক চৌধুরীকে রাজাকারদের পরামর্শে পাকসেনারা গ্রেফতার করে নির্যাতন করে।
১৫ই আগস্ট পাকসেনা ও রাজাকাররা দুটি নৌবহরযোগে নবীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেয়। একটি বহর যায় বানিয়াচংয়ের নজিপুরে এবং অন্যটি আসে নবীগঞ্জে বোয়ালমারি খাল দিয়ে আসার সময় থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আব্দুর রহমান এবং স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী নবীগঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী গয়াহরি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বাসুদেব দাশ ওরফে নারায়ণের বাড়ি আক্রমণ করে তাঁর মা মহামায়া দাশ ও ভাই বীরেন্দ্র দাশকে গুলি করে হত্যা করে। গ্রামে কোনো লোকজন না থাকায় দীর্ঘ সময় পর লাশ দুটি সৎকার না করে বরাক নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। গয়াহরি গ্রাম হত্যাকাণ্ডের পর পাকবাহিনী নবীগঞ্জ বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুল জব্বারের বৃদ্ধ পিতা সাবাজ মিয়াকে তাঁর নিজ বাড়িতে হত্যা করে। এ- সময় পাকবাহিনী ও রাজাকাররা গণহারে গ্রেফতার অভিযান শুরু করে এবং গ্রেফতারকৃতদের নবীগঞ্জ বাজারে নিয়ে গণহত্যা চালায়। নবীগঞ্জ বাজার গণহত্যায় রাজকুমার বণিক (নবীগঞ্জ বাজার), শৈলেন্দ্র বণিক (নবীগঞ্জ বাজার), গজেন্দ্র দেব (নবীগঞ্জ বাজার), উপেন্দ্র দেব (কেলি কানাইপুর), রাইমোহন শীল (কেলি কানাইপুর), উমাকান্ত দাস (গয়াহরি), প্যারি মোহন পাল (হালিতলা)সহ ২২ জনকে বরাক নদীর তীরে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে লাশগুলো রাজাকাররা মাটিচাপা দেয়। হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকবাহিনী স্থানীয় কালিবাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং গোবিন্দ জিউর আখড়ার রথে অগ্নিসংযোগ করে। একই সঙ্গে তারা স্থানীয় জে কে উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটিও ধ্বংস করে। বাজারে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা শেষে পাকবাহিনী নবীগঞ্জ বাজার সংলগ্ন কানাইপুর গ্রামে প্রবেশ করে গণহত্যা চালায়। কানাইপুর গণহত্যায় উপেন্দ্র দেব, হরিপদ দেব, গোবিন্দ দেব ও ললিতমোহনসহ ৮ জন নিহত হয়৷
নবীগঞ্জ বাজার সংলগ্ন আদিত্যপুর একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম। পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার পালিয়ে যায়। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামে ব্যাপক লুটপাট করে। দিনারপুর পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত মামদপুরও একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম। ২১শে নভেম্বর স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী ঐ গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ২ জনকে হত্যা করে। এছাড়া বেশ কয়েকজন নারী ধর্ষণের শিকার হন। বেশ কয়েকজনকে পাকবাহিনী দিনারপুর হাইস্কুল ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরদিন ভোরে তাদের নিয়ে বাহুবলের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে আউশকান্দি-মীরপুর সড়কের কল্যাণপুর নামক স্থানে পুরুষ বন্দিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে। কল্যাণপুর গণহত্যায় কালীপদ চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র চক্রবর্তী, বাণী চক্রবর্তী, সজল চক্রবর্তী, পুলিন চন্দ্র হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়।
নবীগঞ্জ সদরের উত্তর দিকের জন্তরী গ্রামটিও হিন্দু অধ্যুষিত। ১৭ই মে পাকসেনাদের একটি দল শেরপুর থেকে পায়ে হেটে নবীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেয়। জন্তরী গ্রামের কাছে পৌঁছলে তাদের একটি গ্রুপ জন্তরী গ্রামে ঢুকে কালী নমঃশূদ্রের বৃদ্ধা শাশুড়ি, কুটি দেব, হালিতলা গ্রামের ননী শীল এবং মিল্লিক গ্রামের ইরফান উল্লাসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। এ ঘটনা জন্তরী গণহত্যা নামে পরিচিত।
পরবর্তীতে জুন মাসে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনী এ গ্রামটিতে এসে পুনর্বার ব্যাপক লুটপাট চালায় এবং মাতঙ্গিনী নামে এক মহিলাকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া অনেক নারী ও যুবতী ধর্ষণের শিকার হয়।
দিনারপুর ক্যাম্পে পাকবাহিনীর নির্যাতনে সাতাইহাল গ্রামের আজিম উল্লা, মুড়াউড়া গ্রামের ইজ্জত উল্লা, দেওপাড়া গ্রামের তারিণী নমঃশূদ্র, কান্দিগাঁও গ্রামের দরছ মিয়া ও বনগাঁও গ্রামের জনু মিয়া মারা যান। এ ক্যাম্পে অবস্থান করা পাকসেনা ও রাজাকাররা অনেক নারীকে পাশবিক নির্যাতন করে। তাদের নির্যাতনের শিকার মাখনপুর গ্রামের এক হিন্দু মহিলা পাগল হয়ে যান। নবীগঞ্জের কৃতী সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (পিতা দিগেন্দ্র ভট্টাচার্য, জন্তুরী) ২৫শে মার্চ রাতে জগন্নাথ হল গণহত্যায় নিহত হন।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন- সুরেন্দ্র মহালদার (শিবপাশা), কুমুদ রঞ্জন চক্রবর্তী (শিবপাশা), হিরা লাল দাস (শিবপাশা), রসিক লাল সাহা (শিবপাশা), স্নেহলতা চক্রবর্তী (শিবপাশা), হাবিব উল্লা (সালামতপুর), ননী শীল (তামাসপুর), যোগেশ দাস (হালিতলা), মাৎসিনী বৈদ্য (জন্তরী), নয়ন দাস (গয়াহরি), ব্রহ্মলোচন দাস (গয়াহরি), আব্দুল মন্নান (সরিষপুর), মাসুক মিয়া (জালালপুর), মোস্তফা কামাল (কামারগাঁও), তছলিম উদ্দিন (কামারগাঁও), ওয়াছিল মিয়া (দেওতৈল), গোপি চন্দ্র দাস (জগন্নাথপুর), বরদা সুন্দরী নমঃশূদ্র (রমজানপুর), পরন রানী শব্দকর (দরবেশপুর), অধীর শব্দকর (দরবেশপুর), গণেশ চন্দ্ৰ দাস (মুক্তাহার), গৌর চন্দ্র দাস (মুক্তাহার), মীরঙ্গা বালা দাস (মুক্তাহার), অরুণ ভট্টাচার্য (উমরপুর), অশ্বিনী কুমার নাথ (জোতপুর), মন্তাজ উল্লা (পিরিজপুর), কুলীন চন্দ্র রায় হালদার (মমিনপুর), যোগেশ নমঃশূদ্র (দেওপাড়া), নীরাই নমঃশূদ্র (দেওপাড়া), নিহারী চন্দ্র দাস (দেওপাড়া), চিত্তরঞ্জন দাস (কালাভরপুর), মান উল্লা (প্রজাতপুর), আব্দুল বারী (শ্রীমতপুর), মানিক মিয়া (শ্রীমতপুর), ইজ্জত উল্লা (বান্দাউড়া), আলা উদ্দিন (সদরাবাদ), সরুজিনী ধর (ব্রাহ্মণগাঁও), ওয়াহিদ উল্লা (ব্রাহ্মণগাঁও), কালীচরণ বিশ্বাস (লক্ষ্মীপুর), ভক্ত নমঃশূদ্র (লক্ষ্মীপুর), পিনাত আচার্য (সাকুয়া), গোপিকা রঞ্জন পাল (সুজাপুর), পরেশ চন্দ্র দেব (গহরপুর), রাখাল দেব (গহরপুর), আনিছ উল্লা (শতক), সরাফত উল্লা (চৌশতপুর), দরছ উল্লা (কন্দিগাঁও), ছানু মিয়া (বনগাঁও), রশিদ উল্লা (উত্তর রামলোহ), মতুর মহাশ্য দাশ (করিমপুর), জেবাই মহাশ্য দাস (করিমপুর), কাঞ্চন বালা বিশ্বাস (চৌকি), আবু মিয়া (হরিধরপুর), হরেন্দ্র চন্দ্র রায় (পাঞ্জারাই), শান্তিবালা রায় (পাঞ্জারাই) ও ধ্রুব দাস। নবীগঞ্জ বাজার সিও অফিস ক্যম্প এবং দিনারপুর হাইস্কুল ক্যাম্প পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
বরাক নদীর তীরে ভূমি অফিস সংলগ্ন স্থানে ১৫ই আগস্ট পাকবাহিনীর নবীগঞ্জ বাজার গণহত্যায় নিহত ২২ জনের গণকবর রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা শ্যামাপ্রসন্ন দাসগুপ্তের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের দিন নবীগঞ্জ থানা শত্রুমুক্ত করতে আক্রমণ করেন। আক্রমণে থানায় অবস্থানরত রাজাকার ও পুলিশবাহিনীর লোকজন পালিয়ে গ্রামের ভেতরে আশ্রয় নেয় এবং থানায় কর্মরত কয়েকজন পুলিশকে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেফতার করে দ্রুত নবীগঞ্জ ত্যাগ করে। এদিন ক্রসফায়ারে পড়ে সার্কেল অফিসের একজন পিয়ন মারা যায়।
পাকবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২৬শে নভেম্বর মুর্শেদ উজ্জামান রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দিনারপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে ৩ জন রাজাকার ও স্থানীয় ২ দালাল নিহত হয়। ২৮শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বাউসা ইউনিয়নের চৌধুরী বাজারে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে একজন রাজাকার নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। সেখান থেকে বেশকিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ ক্যাম্প তল্লাশি করে একজন মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ উজ্জামান রশিদ। নভেম্বরের শেষদিকে দিনারপুর হাইস্কুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৫ই ডিসেম্বর শতক প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ পরিচালিত হয়। এ- সময় রাজাকার কমান্ডার রাজা কাজী পালিয়ে যায় এবং ক্যাম্পের বাকি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের অনেক অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
৪ঠা ডিসেম্বর পাকসেনারা নবীগঞ্জ থেকে পালিয়ে সিলেট চলে যায়। এ সময় নবীগঞ্জ থানায় রাজাকাররা অবস্থান করে। ৫ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন গনু এবং আবদুর রশীদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল থানা আক্রমণ করে। থানা থেকে প্রতিরোধমূলক গোলাগুলি শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধা চা শ্রমিক ধ্রুবজ্যোতি দত্ত নিহত হন। এমতাবস্থায় ৬ই ডিসেম্বর ৪নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহবুবর রব সাদী তাঁর দল নিয়ে নবীগঞ্জ থানা আক্রমণ করে এটিকে শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এছাড়া নবীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন, মাহবুবুর রব সাদী প্রমুখ ছোটলেখা চা-বাগান ও দিলকুশা চা-বাগান অপারেশনে ভূমিকা রাখেন। ৬ই ডিসেম্বর নবীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরউদ্দীন আহম্মেদ, বীর প্রতীক (পিতা মো. তমিজউদ্দীন আহমেদ, সাতাইহাল) ও মাহবুবুর রব সাদী, বীর প্রতীক (পিতা দেওয়ান মো. মামুন চৌধুরী, বনগাঁও)।
নবীগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— ধ্রুবজ্যোতি দত্ত (চা- বাগান শ্রমিক; ৫ই ডিসেম্বর নবীগঞ্জ থানা যুদ্ধে শহীদ), মাসুক মিয়া (জালালপুর, আউশকান্দি), গোপেন্দ্ৰ চন্দ্ৰ দাশ (পিতা গিরীন্দ্র চন্দ্র দাশ, সোনাপুর, বড়ভাকৈর), মান্নান (সরিসপুর, ৮নং নবীগঞ্জ ইউনিয়ন), আজিম উল্লা (সাতাইহাল, গজনাইপুর), ইজ্জত উল্লা (মুড়াউড়া, গজনাইপুর) ও ওয়াছিদ মিয়া (দেওতৈল, আউশকান্দি; গুদিগ্রাম ক্যাম্প যুদ্ধে শহীদ)।
১৫ই আগস্ট পাকবাহিনী কর্তৃক নবীগঞ্জ বাজার গণহত্যায় নিহত ২২ জনের স্মরণে বরাক নদীর তীরে ভূমি অফিস সংলগ্ন স্থানে নবীগঞ্জ গণকবর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। নবীগঞ্জে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক অনদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুবজ্যোতি দত্তের নামে নবীগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে পশ্চিমে থানার দিকের সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ধ্রুব সড়ক। [মাহমুদ সেলিম রেজা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড