You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নড়িয়া উপজেলা (শরীয়তপুর)

নড়িয়া উপজেলা (শরীয়তপুর) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ অঞ্চল থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. এম এ কাশেম এমএনএ এবং আলী আহ্মদ খান এমপিএ নির্বাচিত হন। তাঁদের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে নড়িয়া অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা হরতাল, ধর্মঘটসহ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। ২৫শে মার্চের কালরাতে যখন অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকবাহিনী এদেশের মানুষের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালাতে থাকে, তখন নড়িয়া অঞ্চলের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে নড়িয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়৷ সংগ্ৰাম কমিটির সদস্য ছিলেন- সাইদুর রহমান মল্লিক, এস এম কামাল উদ্দিন
কিলোমিটার মন্টু, নুরুল ইসলাম খালাসি, সেকান্দার হাওলাদার প্রমুখ। এম এ রেজা, নুরুল হক হাওলাদার, আলমগীর হাওলদার, আমির হোসেন মাস্টার, ছাত্রনেতা সুলতান মাহমুদ সীমন প্রমুখ নড়িয়া উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। মোক্তারের চর, রাজনগর, নশাসন, জপসা, ভোজেশ্বর, ভূমখাড়া, চরআত্রা, নওপাড়া, কেদারপুর, ফতেজঙ্গপুর, ডিঙ্গামানিক, ঘড়িসার, চামটা ও বিঝারী ইউনিয়নের অধিকাংশ হাট-বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ছুটিতে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, ইপিআর ও আনসার সদস্যদের দ্বারা এ-সকল প্রশিক্ষণ পরিচালিত হতো। চামটার নাসির মাস্টার, হোসেন আলী দেওয়ান, নূর মোহাম্মদ সরদার, খলিল শিকদার, মহিউদ্দিন মাস্টার, কাঁলাচান প্রমুখের সহায়তায় ইপিআর সদস্য মতিউর রহমানের পরিচালনায় ৪০-৫০ জন যুবক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখান থেকে বেশকিছু সদস্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যান এবং প্রশিক্ষণ শেষে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রসহ নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। এ-সময় নড়িয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও আগরতলা মামলার আসামি ক্যাপ্টেন শওকত আলী (স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার) আগরতলার মেলাগড় ক্যাম্পে অবস্থান করে প্রশিক্ষণার্থীদের উৎসাহিত করেন। এস এম কামাল উদ্দিন মন্টু, ইউনুস আলী খান মিতালী, জেমস বাবুল, সহিদুর রহমান মল্লিক, নুরুল ইসলাম খালাসী, সেকান্দার হাওলাদার প্রমুখ এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
নড়িয়ায় মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন মো. ইউনুস আলী খান মিতালী, এস এম কামাল উদ্দিন মন্টু, কাজী সামসুল করিম সেলিম, সাবেদ আলী হাওলাদার, সুবেদার জয়নাল (রিজার্ভ ফোর্স), মতিউর রহমান ফকির ও কাজী আবদুল হক (ডিফেন্স ফোর্স)। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন আলমগীর হাওলাদার (পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর কর্নেল), খলিলুর রহমান মোল্লা ও আব্দুর রশিদ শেখ। বৃহত্তর নড়িয়ার দেওয়ান মোহাম্মদ আলী ফরিদপুর ও বরিশালের এক্সপ্লোসিভ গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন (যাঁর নেতৃত্বে ফরিদপুর শহর সংলগ্ন বাখুণ্ডা সেতু ধ্বংস করা হয়)। নড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু ক্যাম্প ছিল এসব ক্যাম্পের কমান্ডাররা হলেন- কাজী সামসুল করিম সেলিম (নড়িয়ার কুণ্ডেশ্বর বাড়ি), মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন মোল্লা, জেমস বাবুল (ভূঁইয়া বাড়ির ক্যাম্প, কেদারপুর), সাবেদ আলী হাওলাদার (প্রাক্তন মেজর, চাকদহের লতিফ সরদারের বাড়ি), রওশন আলী শিকদার (মুখুয্যে বাড়ি, নড়িয়া), সুবেদার জয়নাল আবেদীন (পাঁচআনির বাড়ি, ভোজেশ্বর), মতিউর রহমান ফকির (অস্থায়ী ক্যাম্প), কাজী আব্দুল হক (আলী আহ্মদ মোক্তারের বাড়ি)।
নড়িয়ায় পাকহানাদার বাহিনী কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। মহকুমা শহর মাদারীপুর থেকে এ অঞ্চলে এসে তারা নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আবার মাদারীপুর ফিরে যেত।
আলী আহ্মদ মুন্নীকে সভাপতি করে নড়িয়া থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এখানে পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্প না থাকায় রাজাকার ও আলবদর- বাহিনীর তেমন তৎপরতা ছিল না। গোপনে কতিপয় ব্যক্তি রাজাকার জলিল বেপারীর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়ে মাসোহারা গ্রহণ করত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গিয়াস উদ্দিন মোল্লা, মনজুর আলী লাকুরিয়া, মেজবাহ উদ্দিন মাঝি, আবদুল জলিল বেপারী, আবুল হাসেম বেপারী, ইয়ার বক্স মোল্লা, আবদুল লতিফ বন্দুকসি প্রমুখ।
নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার বাজারে শান্তি কমিটির সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবর পেয়ে পাকবাহিনীর ৫০ সদস্যের একটি দল লঞ্চযোগে ২২শে মে আকস্মিকভাবে ঘড়িসার বাজারে এসে পার্শ্ববর্তী গ্রাম ঝালোপাড়া ও ঘোষপাড়াসহ হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা ঘোষপাড়ার ললিত ঘোষকে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৫শে জুলাই পাকবাহিনী আব্দুল জলিল বেপারী ও গিয়াস উদ্দিন মোল্লার প্ররোচনায় মাদারীপুর থেকে নড়িয়া বাজারে এসে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে তারা হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা নড়িয়ার মুখুয্যে বাড়ি ও কুণ্ডের বাড়ি, কেদারপুরের ভূঁইয়া বাড়ি, চাকদহের লতিফ শিকদার ও মিন্টু হাওলাদারের বাড়ি, ভোজেশ্বরের পাঁচআনীর আলী আমদ মেম্বার, ভট্টাচার্য, কমান্ডার মিতালী, মমিন আলী ও মধু সাহার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এখানে পাকবাহিনীর ক্যাম্প না থাকায় কোনো নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল না। হানাদাররা মাদারীপুর থেকে এখানে এসে নির্যাতন চালাত।
মাদারীপুর মহকুমা শহর থেকে উপজেলা দূরবর্তী হওয়ায় এ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশ নিরাপদ ছিল। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা পালং ও ভেদরগঞ্জ থানা হানাদারমুক্ত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ডামুড্যার যুদ্ধেও অনেকে অংশগ্রহণ করেন। এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্মুখ যুদ্ধ হয়নি। তবে পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসর ও তাদের সমর্থকদের দমন এবং থানা দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি অপারেশন চালান।
২১শে মে ঘড়িসার বাজারে স্থানীয় পাকিস্তানি দালালদের উদ্যোগে শান্তি কমিটির সভা চলছিল। খবর পেয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সভার ওপর অতর্কিতে গ্রেনেড চার্জ করেন। নিমিষেই সভা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এবং শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য আহত হয়। এটি ঘড়িসার বাজার অপারেশন নামে পরিচিত। নড়িয়াকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ২৩শে জুন স্টুয়ার্ড মুজিব, ইউনুস আলী মিতালী, ডা. কাঞ্চন, এস এম কামাল উদ্দিন মন্টু ও রওশন আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে নড়িয়া থানা আক্রমণ করেন। দুঘণ্টা যুদ্ধ চলে এবং থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। নড়িয়া থানা যুদ্ধ-এ পাকবাহিনীর দোসর, পুলিশ ও রাজাকারসহ ৩৫ জন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে ৭টি রাইফেল ও প্রায় ৩৫০ রাউন্ডের গুলি উদ্ধার করেন। একই সময়ে ডা. কাঞ্চনের নেতৃত্বে আলী মুন্সীর বাড়ি অপারেশন করা হয়। এ-যুদ্ধে আলী মুন্সী ও থানার ডিআই ওয়ানসহ তিনজন নিহত হয়। রাজাকার জলিলসহ কয়েকজন দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়। ৫ই সেপ্টেম্বর সুবেদার জয়নাল ও এস এম কামাল উদ্দিন মন্টুসহ প্রায় একশত মুক্তিযোদ্ধা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর চারটার দিকে থানার দক্ষিণ ও পূর্ব-উত্তর কোণ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন। তিন ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি পুলিশ ও পাকবাহিনীর দোসরসহ প্রায় ২৫ জন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নড়িয়া থানা দখল করে নেন এবং এদিনই থানা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল হাসেম কাজী (পিতা শমসের আলী কাজী, পাঁচক), সাইদুর রহমান মোল্লা (পিতা জমির হোসেন মোল্লা, পাঁচক), হারুন অর রশিদ গোরাপী (পিতা তালেবালী গোরাপী, পাঁচক), আলাউদ্দিন বেপারী (পিতা রিয়াজ উদ্দিন বেপারী, পাঁচক), ইউনুস আলী শেখ (পিতা ওয়াহেদ বক্স শেখ, নওগাঁও), সিপাহি আবু তাহের (পিতা আব্দুল হামিদ মেলকার, বিঝারী), আবুল হোসেন (পিতা আমজাদ খান, মগর), সিপাহি মো. সামসুদ্দিন (পিতা ছাবের আলী, চামটা), মতিউর রহমান (পিতা রোশন আলী শিকদার, তেলীপাড়া), সিগনালম্যান সামসুদ্দিন (পিতা আদম আলী ঢালী, মানাখান), সিপাহি সাইদুর রহমান (পিতা আব্দুল কাদের মুন্সী; মানাখান), ওমর আলী খলিফা (পিতা একিন বক্স খলিফা, নড়িয়া), সোনা মিয়া মৃধা (পিতা ইয়াকুব আলী মৃধা, সুরেশ্বর), হাবিলদার ফরহাদ উদ্দিন সরদার (পিতা আহাদ বক্স সরদার, পূর্ব নন্দনসার), আবদুল হাকিম (পিতা ইব্রাহীম লাকরিয়া, বাহের কুশিয়া), মো. আবদুর রহিম (পিতা শহিদ উদ্দিন শিকদার, উত্তরপাড়া), অধ্যাপক আবুল হাসেম মিয়া (পিতা রহমত আলী সেখ, পাঁচগাঁও), মোসলেম উদ্দিন মৃধা (পিতা রিয়াজ উদ্দিন মৃধা, পাঁচগাঁও), ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন (পিতা এস এম আব্দুল ওহাব, কাঠহুগলী), আব্দুল মান্নান রাড়ি (পিতা রিয়াজ উদ্দিন রাড়ী, সোন্ডা), আনসার আলী বেপারী (পিতা রহমত আলী বেপারী, কলারগাঁও), ইরশাদ আলী মিয়া (পিতা আব্দুর রহিম মিয়া, করন হোগলা), হাবিলদার আলী আহম্মদ (পিতা ইউনুছ আলী, নওপাড়া), ইউসুফ হাওলাদার (পিতা জয়গুল হাওলাদার, শিরংগল), মো. আব্দুল হাই (পিতা ইমান আলী কোতোয়াল, চর নড়িয়া), প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম (পিতা মাস্টার মনির উদ্দিন, আটপাড়া), মাইনদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (পিতা শামসুদ্দিন আহম্মদ, কার্তিকপুর), আলা বক্স মিয়া (পিতা ইয়াকুব আলী মিয়া, সালধ), আব্দুস শুকুর মিয়া (পিতা জাবেদ আলী, করন হোগলা), হোসেন আলী (পিতা হাতেম আলী মোল্লা, খীরপাড়া), ইউছুব আলী ফকির (পিতা ওফাজদ্দিন ফকির, বিঝারী), ওয়াজেদ আলী মৃধা (পিতা আলী মৃধা, পাঁচগাঁও), জামাল উদ্দিন মাদবর (পিতা হাতেম আলী মাদবর, পোড়াগাছা), আ ক ম বদিউজ্জামান (পিতা আফছার উদ্দিন, ভুমপাড়া), সিপাহি আব্দুল হামিদ (পিতা আহমেদ আলী সরদার, আনাখণ্ড), সিপাহি মো. সালাউদ্দিন বেপারী (পিতা আব্দুর রহমান বেপারী, তেলীপাড়া), নায়েক জালাল আহমেদ (পিতা মো. ছাদেম আলী বেপারী, বিঝারী), হাবিলদার ফরহাদ হোসেন (পিতা আহাদ বক্স সর্দার, পূর্ব নন্দনসার) ও সিপাহি আবুল কাশেম (পিতা মোজাফফর মীর, রোকন্দপুর)। [আবদুর রব শিকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!