নগরকান্দা হত্যাকাণ্ড (নগরকান্দা, ফরিদপুর)
নগরকান্দা হত্যাকাণ্ড (নগরকান্দা, ফরিদপুর) সংঘটিত হয় ৩০ ও ৩১শে মে এবং ১লা জুন। তিনদিন ধরে পাকসেনারা কোদালিয়া, ঈশ্বরদী, ঝাটুরদিয়া, চুড়িয়ার চর, বাগাট, নগরকান্দা বাজার, খাড়দিয়া, কুমারকান্দা, আলমপুরা, বাউসখালী, সোনাতুন্দী, বলভদীণ্ডা, নগরকান্দা, রথখোলা, গোপালকরদী, আটকাহনীয়া, বনগ্রাম, গোয়ালদী, মেহেরদিয়া, পুড়াপাড়া, ঘুনাপাড়া, চাঁদহাট, বাগাট, পোড়াপাড়া, ঘোনাপাড়া, চুড়িয়ার চর প্রভৃতি গ্রামে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পলায়নরত নর-নারী-শিশুদের হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনদিনে তারা ২ শতাধিক লোককে হত্যা করে। এছাড়া লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে।
২৯শে মে চাঁদহাট যুদ্ধ-এ পাকবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর তারা এ নারকীয় তাণ্ডব চালায়। মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, নগরকান্দা, কাশিয়ানী চতুর্দিক থেকে শতশত পাকসেনা গুলি করতে-করতে নগরকান্দা থানার বিভিন্ন গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। তারা যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে। তারা হেলিকপ্টার থেকে শেলিং করে মানুষ হত্যা করে।
কোদালিয়ার ঘটনা সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী। কোদালিয়ায় অনেক ব্যবসায়ীর বসবাস। তাদের মালামাল বাড়িতে রাখা ছিল। বাইরের কিছু ব্যবসায়ীও সেখানে নিজেদের সম্পদ গচ্ছিত রেখেছিল। পাকসেনারা এসব মালামাল লুণ্ঠন করে। তারপর অনেক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ৫০-৬০টি বাড়িঘর পুড়ে ভস্মীভূত হয়। এরপর গ্রামবাসীকে মাঠে জড়ো করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ভাগে বয়স্ক পুরুষ, দ্বিতীয় ভাগে শিশু-কিশোর এবং তৃতীয় ভাগে মহিলাদের রাখা হয়। মহিলাদের কারো কোলে শিশু ছিল৷ বয়স্ক পুরুষদের চাঁদহাট যুদ্ধে নিহত পাকসেনাদের লাশ ও লুটের সামগ্রী বহনের কাজে নিয়োজিত করা হয়। শিশু-কিশোরদের বিলের ওপারে নিয়ে বন্দুকের মুখে বসিয়ে রাখা হয়। এরা গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়। অনেক অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটি সত্ত্বেও বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা হয়। এরপর মাদ্রাসার মাঠে নারী ও পুরুষদের হত্যা করে লাশের স্তূপ করা হয়। গুলিতে কারো মাথা, কারো হাত উড়ে যায়। এদিন এক সঙ্গে ১৮ জন মহিলাসহ ২ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়।
সেদিনের নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হলেন- কোদালিয়ার রহিমুন্নেসা, হামিদা, ফিরোজা বেগম, কলি, ফুলজান বেগম, আফজাল মিয়া, রাবেয়া খাতুন, নূরজাহান বেগম, আকরামুন্নেসা, সুফিয়া বেগম, চেলা বেগম, পারভীন আক্তার, আমেনা বেগম; আশফরদির খোরশেদ মিয়া, হানিফ মিয়া, গফুর আলী মীর, মোহাম্মদ আলী মীর, বাদশা মীর, জব্বার আলী মীর, ফেলু শেখ, আজাহার মোল্লা; কানফরদীর আবদুল মালেক মাতুব্বর, আবদুল বারেক মাতুব্বর; ঈশ্বরদীর আবদুল মাজেদ, মাজু খাতুন, আবদুস সালাম, ফুলজান, আলেকজান; কাইচালের রোমন মিয়া, আবদুস সাত্তার মিয়া, ধলা মিয়া; জগদিয়াবালিয়ার ক্ষুদিরাম মণ্ডল, যাদব সরকার; দহিসারার ইসমাইল মোল্লা; চাঁদহাটের মোতালেব মোল্লা, রতন মাতুব্বর, মনসুর তালুকদার; বাগাটের আইয়ুব আলী, রতন মাতুব্বর, মালেক মাতুব্বর, আমজেদ মুন্সী, মঞ্জু রানী; ব্রাহ্মণডাঙ্গার সদু রাজবংশী ও মোহন মিয়া। কোদালিয়ায় শহীদদের দুটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামে শহীদদের বিচ্ছিন্নভাবে কবর দেয়া হয়। কোদালিয়া গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [আবু সাঈদ খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড