নগরবাড়ি ঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ (বেড়া, পাবনা)
নগরবাড়ি ঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ (বেড়া, পাবনা) সংঘটিত হয় ৪ঠা এপ্রিল থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর স্থল, নৌ ও বিমান আক্রমণের মুখে অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। এখানকার প্রতিরোধযুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন। তবে পাকবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্র ও ত্রিমুখী আক্রমণের সম্মুখে মুক্তিযোদ্ধারা যে বীরত্বের পরিচয় দেন, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে অর্থাৎ ২৭, ২৮ ও ২৯শে মার্চ তিন দিনের প্রতিরোধযুদ্ধে পাবনা জেলায় অনুপ্রবেশকারী শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য বিপ্লবী জনতার হাতে নিহত হয়। প্রতিরোধ পর্বে অভূতপূর্ব এ সাফল্য লাভের পরও পাবনার জনগণ শঙ্কামুক্ত হতে পারেনি। কারণ ঢাকা থেকে নগরবাড়ি হয়ে পাবনায় যে- কোনো মুহূর্তে পাকবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। তাই পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ৩১শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মো. আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ-র নির্দেশে বেড়ায় অবস্থানরত প্রতিরোধযোদ্ধারা নগরবাড়ি ঘাটে আবস্থান নেন। পুলিশ, প্রাক্তন সৈনিক, আনসার, ইপিআর ও প্রায় ৪০০ প্রতিরোধযোদ্ধা নগরবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। ২রা এপ্রিল পাবনা সদর থেকে প্রায় ২০০ প্রতিরোধযোদ্ধা ৮টি জিপ, একটি বড় বাস ও কয়েকটি ট্রাকে করে নগরবাড়ি ঘাটে আসেন। পাকসেনাদের প্রতিরোধ করতে তাঁরা নগরবাড়িতে বাংকার তৈরি করে সামনের দিকে বালুর বস্তা সাজিয়ে দুর্গ গড়ে তোলেন। তাঁদের হাতে তখন ২টি হালকা মেশিনগান, ৭টি শর্টগান, ২টি রকেট লান্সার এবং কিছু রাইফেল আর গাদা বন্দুক ছিল। নগরবাড়ি ঘাটের প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদকে।
এদিকে ঢাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর জেনারেল টিক্কা খান পাবনা, রাজশাহী ও বগুড়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ৫৭ ব্রিগেডকে উত্তরবঙ্গে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবকে। ব্রিগেডিয়ার আরবাব তার বাহিনী নিয়ে ঢাকা থেকে আরিচা-নগরবাড়ি ঘাট হয়ে উত্তরবঙ্গের পথে অগ্রসর হয়। তাঁর নেতৃত্বধীন সেনারা বিমান ও নৌবাহিনীর সাপোর্টে নগরবাড়ি ঘাট দখলের চেষ্টা করে। ৪ঠা এপ্রিল সকাল ১০টায় পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। প্রতিরোধযোদ্ধারাও বাংকার থেকে শত্রুবাহিনীর বিমান লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে বিমান থেকে আক্রমণ করার কারণে সমগ্র এলাকার জনমনে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। পাকবাহিনী কর্তৃক বড় আক্রমণের আশংকায় প্রতিরোধযোদ্ধারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। ৮ই এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে জঙ্গি বিমান থেকে হামলা চালায়। তাদের এ আক্রমণ ছিল ব্যাপক ও তীব্র। দীর্ঘ সময় ধরে তারা বিমান থেকে ঘাটে বোমা নিক্ষেপ ও ব্রাশ ফায়ার করে। কিন্তু তাদের বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার মতো কামান বা ভারী অস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধাদের কাছে না থাকায় তাঁরা এক সময় অসহায় ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। শত্রুপক্ষের বিমান আক্রমণ যে এত তীব্র হতে পারে তা তাঁরা ভাবতে পারেননি। ফলে প্রতিরোধযোদ্ধাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে আরো দুদফা এয়ার রেইড করে। এবারের আক্রমণ পূর্বের চেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল। ২টি বিমান অনেক ওপর থেকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। এদিকে আরিচা ঘাটে প্রচুর পাকসেনার সমাবেশ ঘটে। এক সময় নাগরবাড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকসেনারা কামান, ট্যাংক, গানবোট, বিমান সবকিছু নিয়ে তাঁদের ওপর সর্বগ্রাসী আক্রমণ করবে। এ অবস্থায় নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বাংকারের মধ্যে তাঁরা পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। ১০ই এপ্রিল সকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে স্থল, জল ও আকাশ পথে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করে। ২টি যুদ্ধবিমান মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো মেশিনগানের ব্রাশফায়ার করে। নৌপথে গানবোট থেকে ভারী মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। বিকট শব্দে এসব শেল মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার আঘাতে গোটা নগরবাড়ি ঘাট কাঁপতে থাকে। পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে নগরবাড়ি বাজারের কয়েকটি গুদামে আগুন ধরে যায়। ধোঁয়ায় গোটা এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বাংকারে টিকে থাকা বা বাংকার থেকে পালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমন নাজুক অবস্থায়ও তাঁরা সারাদিন যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও নগরবাড়ির পতন ঘটে। বিমান হামলায় ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে চাটমোহর উপজেলার নিমাইচরা গ্রামের ৩ জন আনসার সদস্য ছিলেন। তাঁরা হলেন- আব্দুস সাত্তার, আমিনুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী। এ-যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। সহযোদ্ধারা হতাহতদের সঙ্গে নিয়ে নিজ-নিজ পজিশন ছেড়ে পশ্চাদপসরণ করেন। নগরবাড়ি ঘাটের নিয়ন্ত্রণ পাকবাহিনীর হাতে চলে যায়। [মো. ছাবেদ আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড