নগরবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি (বেড়া, পাবনা)
নগরবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি (বেড়া, পাবনা) পাবনা জেলার বেড়া উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়।
পাবনা জেলার বেড়া থানার নগরবাড়িতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের পর পাকবাহিনী পাকিস্তানপন্থী লোকদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। এদের সহযোগিতায় পাকসেনারা আশপাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে এনে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর কখনো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কখনো গুলি করে হত্যা করত। নগরবাড়ি ক্যাম্পকে তারা বধ্যভূমিতে পরিণত করে। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ে তারা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নগরবাড়ি ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়। তারা হাজার-হাজার নারী-পুরুষকে ধরে পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন শেষে যমুনা নদীর তীরে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দিত। যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী পাবনাকে উত্তরবঙ্গের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে। পাবনা ছিল ভারতের সীমান্ত থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি দূরে অবস্থিত। আর পাবনার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল বেড়ার নগরবাড়িতে। বেড়া সদরে প্রচুর হিন্দু লোকের বসবাস ছিল। হিন্দুরা এখানে বেশি নির্যাতনের শিকার হন। রাস্তায় কোনো লোক দেখলেই হানাদাররা আইডেন্টিটি কার্ড চাইত। হিন্দু না মুললমান এটা নিশ্চিত হবার জন্য কাপড় খুলে পরীক্ষা করত। পাকসেনাদের মদতে বেড়া থানায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে দালাল নুরু মিয়া, আলহাজ্ব এন্তাজ উদ্দীন, পিরু মিয়া, আসাদ প্রমুখ। এ সকল দালাল গ্রামের পর গ্রাম, বিশেষ করে হিন্দুপ্রধান এলাকায় নির্বিচারে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। তাদের হাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের শতশত মানুষ নিহত হন। বহু নারীকে এরা পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। ৮ মাস ধরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নগরবাড়ী ও এর পাশের এলাকায় ব্যাপক নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
নগরবাড়ি ক্যাম্পে শুধু বেড়া নয়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা নারী-পুরুষদেরও হানাদাররা নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ যমুনা নদীতে ফেলে দিত। কখনো ধরে এনে হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে শরীরের ওপর নাইট্রিক এসিড ঢেলে দিত। মুহূর্তেই সারা শরীর গলে সব হাড় বের হয়ে যেত। এসব বিকৃত লাশ নদীতে ছুড়ে ফেলা হতো। অনেক সময় মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে অর্ধমৃতদেরও নদীতে নিক্ষেপ করা হতো। মেয়েদের ওপর পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন শেষে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী বেড়া থানার বিভিন্ন গ্রামের শতশত নারী- পুরুষকে নগরবাড়ির টর্চার সেলে এনে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। ১৩ই সেপ্টেম্বর বাহিনীর সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, গোলাম সরোয়ার সাধন, আলমগীর কবির স্বপন, নজরুল ইসলাম সাচ্চু এবং আব্দুর রাজ্জাক শাফি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের গ্রুপ লিডার জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম পাকবাহিনীর ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে প্রাণে বাঁচলেও সাধন, স্বপন, সাচ্চু ও শাফিকে নগরবাড়ি ঘাটের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজাকার ও পাকসেনারা মিলে সারাদিন তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানোর পর সন্ধ্যার দিকে আধমরা অবস্থায় হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। ফলে তাঁদের সলিল সমাধি ঘটে। নগরবাড়িতে কোনো গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কারণ এখানে অগণিত মানুষকে হত্যা করলেও লাশগুলো যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। এখান থেকে কতলোকের মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। [মো. ছাবেদ আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড