You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | নগরীপাড়া গণহত্যা (লাকসাম, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

নগরীপাড়া গণহত্যা (লাকসাম, কুমিল্লা)

নগরীপাড়া গণহত্যা (লাকসাম, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ২৮শে নভেম্বর। এদিন পাকিস্তানি সেনারা মুদাফ্ফরগঞ্জ ইউনিয়নের নগরীপাড়া গ্রামের কর্মকার বাড়িতে হামলা চালায়। স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় তারা নির্মম গণহত্যা চালিয়ে কর্মকার বাড়ির পাঁচটি পরিবারের ১০ জন পুরুষকে হত্যা করে।
কর্মকার বাড়ির নিরীহ মানুষদের ‘অপরাধ’ ছিল- তারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তাছাড়া এ বাড়িতে আরতি বালা নামে এক ষোড়শীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে রাজাকার বাহিনীর প্রধান বরুড়ার আরিবুর রহমানের। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে রাজাকার আরিবুর তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে কর্মকার বাড়িতে হানা দিয়ে আরতি বালাকে তুলে নেয়ার হুমকি দেয়। নগদ টাকার বিনিময়ে সে-যাত্রায় আরতি বালার পরিবার রক্ষা পায়। পরবর্তীতে ২৮শে নভেম্বর ১২- ১৫ জন রাজাকার এবং একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকার বাড়িতে ঢুকে ফাঁকা গুলি করে। রাজাকার বাহিনী ছিল কালো পোশাকধারী এবং তাদের কয়েকজন ছিল মুখোশ পরা। গুলির আওয়াজ শুনে উমেশ চন্দ্র কর্মকারের স্ত্রী ঊষা রাণী দরজা ফাঁক করে ঘাতক বাহিনীকে দেখতে পান। তিনি স্বামীকে ঘুম থেকে জাগানোর সঙ্গে-সঙ্গেই বর্বর রাজাকারের দল উমেশ চন্দ্রকে টেনে-হিঁচড়ে উঠানে নিয়ে আসে। এ- সময় উমেশ চন্দ্রের পিতাসহ অন্যদেরও রাজাকাররা ঘর থেকে বের করে এনে চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে এবং রাইফেলের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করতে থাকে। পাশাপাশি রাজাকারদের কয়েকজন ঘরের ভেতর নারীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে এবং আরতি বালাকে তুলে নিয়ে আর্মি-ক্যাম্পে হস্তান্তর করে। সেখানে রাতভর তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চলে। ঐ রাতেই ১০ জন পুরুষকে বাড়ির অনতিদূরে একটি বটগাছের কাছে নিয়ে হাত বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থলেই ৯ জন মারা যান। আর একজনের একটি হাত দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। রাত তিনটার দিকে আরতি বালাকে পাশবিক নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাড়ি যাওয়ার জন্য বলা হয়। আরতি বালা তার বাড়িতে যেতে চাইলে বর্বররা তাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। শেষ রাতে আরতি বালা বাড়ি ফিরে আসে। সকালে মৃতদেহগুলোর পাশে কিছু সংখ্যক লোক জড়ো হয় এবং ভুবন চন্দ্র কর্মকারকে জীবিত অবস্থায় দেখে। আহত ভুবন চন্দ্র তার ৮-৯ বছরের ছেলে মানিকের নিকট পানি খেতে চান। কিন্তু মৃতদেহগুলোর সামনে লোকজনের সমাগম দেখে পার্শ্ববর্তী পুলের ওপর থেকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে। আতঙ্কগ্রস্ত লোকজন প্রাণভয়ে ছুটে পালায়। মানিকের আর পানি নিয়ে আসার সুযোগ হয়নি। অবশেষে রাজাকার বাহিনী রাস্তার পাশে (লাকসাম-নগরীপাড়া মুদাফ্ফরগঞ্জ-চিতোষী সড়কের সংযোগ স্থল) গর্ত খুঁড়ে প্রথমে জীবিত ভুবন চন্দ্রকে রেখে তার ওপর অন্য ৯টি মৃতদেহ ফেলে মাটিচাপা দেয়। আহত ভুবন চন্দ্র কর্মকার তাকে মাটিচাপা না দেয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করলেও পাষণ্ড রাজাকাররা তাতে কর্ণপাত করেনি। নগরীপাড়া গণহত্যায় যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং যাদের একই কবরে চাপা দেয়া হয়েছে, তারা হলেন- রাধাকৃষ্ণ কর্মকার (৬০), নিত্যানন্দ কর্মকার (২৮) (পিতা রাধাকৃষ্ণ কর্মকার), অমূল্য কর্মকার (১৮) (পিতা রাধাকৃষ্ণ কর্মকার), পেয়ারী মোহন কর্মকার (৪৫) (পিতা নব কর্মকার), রমেশ কর্মকার (৩০) (পিতা নব কর্মকার), যাদব কর্মকার (৭২) (পিতা প্রতাপচন্দ্র কর্মকার), উমেশ কর্মকার (৪০) (পিতা যাদব কর্মকার), ভুবন কর্মকার (৩৫) (পিতা যাদব কর্মকার), ক্ষেত্রমোহন কর্মকার (৩১) (পিতা যাদব কর্মকার) এবং অটলবিহারী কর্মকার (৩০) (পিতা অশ্বিনী কর্মকার)।
স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- গণহত্যায় নিহতদের উত্তরাধিকারীকে নগদ ২০০০ (দুই হাজার) টাকা অনুদান দেন। পরবর্তীতে কোনো সরকারই গণহত্যায় নিহতদের বিধবা স্ত্রী এবং অসহায় সন্তানদের কোনো অনুদান কিংবা ভাতা প্রদান করেনি বলে ঊষা রাণী ও সাধনবালা জানান। এছাড়া নগরীপাড়া গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন বা ফলক নির্মাণে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে গণকবরটি অবহেলিত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। [ইমন সালাউদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড