You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নকলা উপজেলা (শেরপুর)

নকলা উপজেলা (শেরপুর) থানা হিসেবে ১৯৩০ সালে গঠিত হয়। এর উত্তরে নালিতাবাড়ী, দক্ষিণে জামালপুর ও ময়মনসিংহ সদর, পূর্বে ফুলপুর ও হালুয়াঘাট এবং পশ্চিমে শেরপুর সদর উপজেলা। নকলা একটি রাজনীতি সচেতন এলাকা। স্বাধীকার আন্দোলনকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যে ঘোষণা দেন, তার প্রভাব নকলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পড়ে। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সারাদেশের মতো নকলা উপজেলার মানুষও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।
২৭শে মার্চ নকলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য এক ছাত্র-গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এদিন গ্রাম থেকে আসা হাজার-হাজার মানুষের সমাবেশ ও মিছিলে নকলা শাহরিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ লোকারণ্য হয়ে যায়। জমায়েতে মুস্তাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের ১১ জন সদস্যকে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়। মুস্তাফিজুর রহমান ছাড়া এ ১১ সদস্যের বাকিরা হলেন- নূরল ইসলাম বিএসসি (বাদাগৈড়), মুহাম্মদ আলী (কবুতরমারী), শাহ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা (মোজাকান্দা), মো. রফিকুল ইসলাম (কলাপাড়া), মো. আব্দুল আজিজ (ফেরুসা), শফিকুল ইসলাম জিন্নাহ (মাউড়া), মো. দুলাল উদ্দিন (পুলাদেশী), মো. শিরাজুল ইসলাম (মাউরা), আব্দুল আজিজ (রিহিলা) এবং মো. ওমর ফারুক (কৃষ্ণপুর)।
সংগ্রাম পরিষদের সভায় চারটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেগুলো হলো- পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা পোড়ানো; মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন; মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থাসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ও গ্রাম থেকে চাল-ডাল-সবজি সংগ্রহ এবং প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ করা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নকলার ছাত্র-জনতা কার্যক্রম শুরু করে।
নকলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও নেতাদের মধ্যে ডা. নাদিরুজ্জামান খান এমপিএ (আওয়ামী লীগ- সভাপতি), শাহ মোজাম্মেল হক (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), আতাউর রহমান (আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি), মো. মিজানুর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা), সিরাজুল ইসলাম বাজু মিয়া (আওয়ামী লীগ নেতা ও শিক্ষক), আলাউদ্দিন তালুকদার (আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি), নজরুল ইসলাম বিএসসি (শিক্ষক ও আওয়ামী লীগ নেতা), মো. মজিবর রহমান হীরা (আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান), মো. মুস্তাফিজুর রহমান (ছাত্রনেতা), মন্মথ দে ওরফে পাচু বাবু (কমিউনিস্ট পার্টির নেতা), মো. রফিকুল আলম (ছাত্রনেতা), মোহাম্মদ আলী (ছাত্রলীগ-এর সভাপতি), ফরহাদ হোসেন (ইপিআর সদস্য), আব্দুল হক চৌধুরী ক্যা (কোম্পানি কমান্ডার), মুনসেফ আলী (মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার) প্রমুখ। নকলার মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষকদের অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে কছিম উদ্দিন মাস্টার, আবুল হোসেন মাস্টার (বিএলএফ- সদস্য ও এর প্রশিক্ষক কমিটির সভাপতি), আবদুল আজিজ মাস্টার, আবু বাক্কার, আবু ইউসুফ, খন্দকার তোফাজ্জল, আজাহার ইসলাম, ইন্তাজ আলী, লুতফুর রহমান, আব্দুল হাকিম মাস্টার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ইউনিয়নভিত্তিক সংগঠকরা হলেন- কছিম উদ্দিন মুন্সী (কিংকরপুর, ১নং ইউনিয়ন), ইউনুছ আলী আকন্দ (চিথলিয়া, ১নং ইউনিয়ন), সিরাজুল ইসলাম (শিক্ষক, মাউড়া, ২নং ইউনিয়ন), কুদরাত আলী মেম্বার (নকলা, ২নং ইউনিয়ন), নবী হোসেন ডাক্তার (নকলা, ৩নং ইউনিয়ন), মহর উদ্দিন (বাদাগৈড়, ৪নং ইউনিয়ন), কফিল উদ্দিন (লাভা, ৪নং ইউনিয়ন), মহিদুল ইসলাম (লাভা, ৪নং ইউনিয়ন), আবদুল বারেক (বানেশ্বর্দী, ৫নং ইউনিয়ন), খন্দকার রফিজ উদ্দিন (কবুতরমারী, ৫নং ইউনিয়ন), বোরহান ডাক্তার (দুধেরচর, ৬নং ইউনিয়ন), আ. ছালাম মাস্টার, (কৈয়াকুড়ি, ৬নং ইউনিয়ন), আব্দুল হাকিম মাস্টার (টালকী, ৭নং ইউনিয়ন), আইয়ুব আলী (চরবসন্তী, ৮নং ইউনিয়ন), মমতাজ উদ্দিন চেয়ারম্যান (বাছুর আলগা, ৯নং ইউনিয়ন), আছাদুজ্জামান (শিক্ষক, ১নং ইউনিয়ন) প্রমুখ। ইপিআর সদস্য আব্দুর রউফ (ফটিয়ামারী, শেরপুর) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ও সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) নূরুল ইসলাম। গ্রামের শিক্ষিত, স্বল্প-শিক্ষিত, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-যুবকরা দলে-দলে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। প্রশিক্ষণের ব্যয় নির্বাহে আওয়ামী লীগের নেতা- কর্মীরা সহায়তা করেন। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রয়োজনের চেয়েও বেশি চাল-ডাল সংগৃহীত হয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণকে আরো উন্নত করার জন্য থানা থেকে রাইফেল আনা হয় ৷ সামগ্রিক প্রশিক্ষণ কাজে ডা. নাদিরুজ্জামান খান এমপিএ, আওয়ামী লীগ সম্পাদক শাহ মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগ নেতা মো. মিজানুর রহমান, নজরুল ইসলাম বিএসসি তত্ত্বাবধান করেন। নকলার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে ভারতের মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুসলিম লীগ নেতারা সীমান্তবর্তী আহম্মদনগর পাকিস্তানি ক্যাম্পে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়। নকলা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন ইত্যাদি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা নকলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯শে এপ্রিল সকাল ৬টায় দুটি ট্রাক ও একটি জিপে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা নকলা থানায় প্রবেশ করে। এদিন কিছুক্ষণ অবস্থানের পর তারা নালিতাবাড়ি রোড ধরে চলে যায়। ১৪ই মে পাকবাহিনী দ্বিতীয়বার নকলায় আসে। ২০শে মে পাকবাহিনী আবার নকলায় আসে। ১লা আগস্ট এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা ও আহম্মদনগর ক্যাম্পের ১৫০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আলবদর ও রাজাকার নিয়ে তারা নকলায় ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল সুবেদার মজিদ (পাঞ্জাবি)। সহযোগিতা ও তথ্য সরবরাহে নিয়োজিত ছিল শান্তি কমিটি। পাকসেনারা ১লা সেপ্টেম্বর ৮ নম্বর চর অষ্টধর ইপিআর হাইস্কুল মাঠে (নারায়ণখোলা) দ্বিতীয় ক্যাম্প স্থাপন করে এ ক্যাম্পে ৩৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ৮০ জন সদস্য ছিল। নকলা থানার দুই ক্যাম্পেই রাজাকার ও আলবদরদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
নকলার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের মধ্যে ডা. আমজাদ হোসেন (নকলা বাজার), ডা. নুর মহম্মদ (পিডিপি- নেতা), আব্দুল কাদের আযাদ (কলাপাড়া), শামসুজ্জামান (জামায়াতে ইসলামী, রাজাকারআলবদরদের প্রশিক্ষক ও সকল প্রকার অপারেশনের নেতা), ডা. আব্দুছ ছাত্তার (জামায়াতে ইসলামী, প্রশিক্ষণ অপারেশন ও পাক ক্যাম্পে খাদ্য সরবরাহকারী), উমেদ আলী (গৌড়দ্বার, মুসলিম লীগ; অফিস তত্ত্বাবধায়ক ও পরিকল্পনাকারী), আশকর আলী মৌলভী (ইসলামী ছাত্র সংঘ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ইউনিয়নে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকবাহিনীর সহযোগিতা করে, তারা হলো- গণপদ্দী ইউনিয়ন: নুরু মিয়া, এডভোকেট ফিরুজ মিয়া, ডা. আব্দুল জলিল, মর্তুজ আলী মেম্বার, আশরাফ আলী, জামাল উদ্দিন; নকলা ইউনিয়ন: মোফাজ্জল চেয়ারম্যান, শামছুদ্দিন শাম, জয়েনদ্দিন, জামাল সরকার, বদিউজ্জমান; উরফা ইউনিয়ন : আব্দুল হালিম চেয়ারম্যান, ডা. আকবর আলী চেয়ারম্যান, শাহাবুদ্দিন, রুস্তম আলী চেয়ারম্যান; কুর্শা বাদাগৈড় ইউনিয়ন: ডা. আমজাদ হোসেন, মহর উদ্দিন মক্কা মেম্বার, গিয়াস উদ্দিন, হানিফ সরকার; বানেশ্বর্দী ইউনিয়ন: মিজানুর রহমান চেয়ারম্যান, বদিউজ্জামান; পাঠাকাটা ইউনিয়ন: আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যান, নঈমদ্দিন চেয়ারম্যান; টালকী ইউনিয়ন: হাবিবুর রহমান চেয়ারম্যান, মো. আবুল কালাম চেয়ারম্যান, রজব আলী সরকার; চর অষ্টধর ইউনিয়ন: সৈয়দ সরকার চেয়ারম্যান, জহির উদ্দিন মাস্টার, মফিজ উদ্দিন মুন্সি, আবু খলিফা (জামায়াত নেতা, ৯নং ইউনিয়ন), জরিফ মণ্ডল প্রমুখ। এদের মধ্যে ডা. নূর মোহাম্মদ, শামসুজ্জামান (শিক্ষক), আব্দুল কাদের আযাদ চেয়ারম্যান, ডা. আ. ছাত্তার, উমেদ আলী, মজিবর রহমান, আশকর আলী মৌলভী বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
মাউড়া গ্রামের কছিম উদ্দিন মাস্টার ও তার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। পাকসেনা ও রাজাকাররা ২৯শে এপ্রিল কছিম উদ্দিন মাস্টারের বাড়িতে হানা দেয়। তারা প্রথমে বাড়ি থেকে অর্থ লুট করে এবং পরে বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়।
১৪ই মে পাকসেনারা ৮ নম্বর চর অষ্টধর ইপিআর নারায়ণখোলা বাজারের আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে যায়। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মহর উদ্দিন মেম্বার ওরফে মক্কা মেম্বার। সহযোগিতা করে ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ সরকার, জহির মাস্টার ও সাংকু সরকার। এদিন সৈয়দ সরকার আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম সরকার এবং তার দুই ভাই গোলাম মোহাম্মদ সরকার ও আবুল হাশেম সরকারকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকসেনারা তিন ভাইকে ট্রাকের মেঝেতে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে নির্যাতন করে। এরপর তাদের বাড়িতে আগুন দেয়। তিন ভাইকে ধান ক্ষেতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের বাড়িতে তিন দফা অগ্নিসংযোগ করে। তাদের অপর দুই ভাইকে আহম্মদনগর নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। এ হত্যাযজ্ঞের পর সরকারদের ছোটো ভাই সিরাজুল ইসলাম (আনন্দমোহন কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পাকবাহিনী পশ্চিম নারায়ণখোলার ইপিআর সদস্য ফরহাদ হোসেনের বাড়িতে যায়। তাকে বাড়িতে না পেয়ে তার এবং তার আত্মীয় মুক্তিযোদ্ধা আক্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
১৪ই মে পাকবাহিনী নকলা হয়ে আহম্মদনগর ফেরার পথে জালালপুর পোদ্দার বাড়ি যায়। এ বাড়ি লুণ্ঠনের পর ধীরেন্দ্র নাথ পোদ্দারকে হত্যা করে।
২০শে মে পাকবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় আওয়ামী লীগের সম্পাদক শাহ মোজাম্মেল হকের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এদিন তারা গৌড়দ্বারে ডা. নাদিরুজ্জামান এমপিএ ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আজিজের বাড়িও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
১লা সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রামগতি প্রসাদ ও শেরপুরের সাকায়েতুল্লাকে অষ্টধর ইপিআর হাইস্কুল মাঠের ক্যাম্পে হত্যা করা হয়।
হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নকলার বিভিন্ন প্রামে হত্যাকাণ্ড চালায়। এসব হত্যাকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ছিল আবুল কাশেম সরকার (নারায়ণখোলা), আবুল হাশেম সরকার (নারায়ণখোলা), মোহাম্মদ আলী সরকার (নারায়ণখোলা), কোরবান আলী (নারায়ণখোলা), নুরল ইসলাম (নারায়ণখোলা), ছোরহাব আলী (পোয়াভাগ), আ. মান্নান (পোয়াভাগ), (বোররচর, ময়মনসিংহ), শাহজাহান আলী (সাজু) (বাজারদী), শাহ বদরুল আলম (মোজাকান্দা), আব্দুল মন্নাফ (দড়িতেঘড়ি), মিজানুর রহমান (দড়িতেঘড়ি), গোলাম মোস্তফা (দড়িতেঘড়ি), ইয়াছিন আলী (দড়িতেঘড়ি), লাল মিয়া (কায়দা), মোজাফফর আলী (জানকীপুর), আব্বাস আলী (হুজুরীকান্দা), আব্দুল হান্নান (জালালপুর), রাম প্রসাদ (নারায়ণখোলা), ধীরেন্দ্র নাথ পোদ্দার (জালালপুর), আব্দুল খালেক (কায়দা), দোস মামুদ আকন্দ (কবুতরমারী), আব্দুর রশীদ (কায়দা), বাসেত আলী (বড়ইতার), মালেকা খাতুন (বড়ইতার), আব্দুস ছালাম (লাভা) প্রমুখ।
নকলার বিভিন্ন গ্রামের হিন্দুপাড়া বা মহল্লার নারীরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হানাদার বাহিনী ৯ নং ইপিআর বালিয়াদী শাহ্পাড়া, বিহারীর পালপাড়া, গণপদ্দী গ্রামের শাহপাড়া এবং চন্দ্রকোনা বাজারের হিন্দু বাড়িতে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর তারা নির্বিচারে লুটপাট করে।
পাকবাহিনী, রাজাকার ও আলবদররা একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত এমন প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এভাবে যাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, তারা হলেন— কছিম উদ্দিন মাস্টার (মাউড়া), ডা. নাদিরুজ্জামান খান এমপিএ (গৌড়দ্বার), মজিবর রহমান হীরা (গৌড়দ্বার), শামছদ্দিন (দড়িতেঘড়ি), যাটু সরকার (বাজারের বাসা, নারায়ণখোলা), ফরহাদ হোসেন (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, নারায়ণখোলা), মো. আক্রাম হোসেন (নারায়ণখোলা), উপেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ (বাদাগৈড়), নিশিকান্ত শৰ্মা (বাদাগৈড়), মো. গিয়াস উদ্দিন (বিহাড়ীরপাড়), মো. উমর আলীর বাড়িসহ আরও ৩৪টি বাড়ি (বরইতার), আক্কাছ আলী মৌলভী (জালালপুর), মুনসেফ মেম্বার (চিথলিয়া), মো. জুলহাস ফকির (ছত্রকোনা), মুহাম্মদ আলী (কবুতরমারী), আফাজ উদ্দিন (পোয়াভাগ), নৈয়ম মণ্ডল (ধনাকুশা), আব্বাস আলী (হুজুরীকান্দা) প্রমুখ। এছাড়া চন্দ্রকোণা বাজারের ২০টি ঘরে আগুন দেয়া হয়।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদ হোসেন ৭ জন সহযোদ্ধা নিয়ে নালিতাবাড়ী সীমান্ত থেকে নকলা এসে রাজাকারদের আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে জালাল উদ্দিন (পিডিপি নেতা ডা. নূর মোহাম্মদের ভাই) ও তার সঙ্গী সালু মিয়া (গরেরগাঁও) নিহত হয়।
ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি ছিল বান্দরকাটা বিওপি। উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল ও ডালু সীমান্ত। বিএসএফ ক্যাপ্টেন বালাজিৎ সিং ত্যাগীর সহযোগিতায় ৪ঠা আগস্ট রাতে বান্দরকাটা বিওপি অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। এখানকার যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার আলী হোসেনের নেতৃত্বে ১২৫ জন, পুলিশের হাবিলদার কোম্পানি কমান্ডার জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০০ জন ও গনি কোম্পানির এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। সার্বিক কমান্ডে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। এ- যুদ্ধে ভারতের মিত্রবাহিনী- কর্তৃক তেলিখালী থেকে আর্টিলারির সাপোর্ট ছিল। সারারাত যুদ্ধের পর ভোর ৬টায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি ক্যাম্প দখল করে নেন। এক পর্যায়ে পলাতক পাকসেনারা আবার ক্যাম্প দখল করার জন্য দুদিক থেকে হঠাৎ আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মিত্রবাহিনীর সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ রচনা করেন। সারাদিন যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে প্রায় ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
৩১শে আগস্ট নারায়ণখোলা বাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সারাদিন ব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধ হয়। নারায়ণখোলা যুদ্ধ-এ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে ১৫ জন পাকসেনা ও ৩৩ জন রাজাকার নিহত হয়। ১লা ও ২রা অক্টোবর সংঘটিত হয় নকলা বাজার যুদ্ধ। এতে ১০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে মনসুর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা নকলা বাজারে রাজাকারদের লক্ষ করে গুলি ছুড়লে হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। পালানোর সময় তারা এলোপাথারি গুলি করতে থাকে। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। এ সময় ইয়াদ আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে দালাল ও রাজাকারদের কয়েকটি বাড়ি আক্রমণ করা হয়।
৭ই ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী পালিয়ে আহম্মদনগর ক্যাম্পে চলে গেলেও রাজাকার ও আলবদর বাহিনী থেকে যায়। এদের অনেকে পরে অস্ত্র ফেলে রাতে পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর নকলাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখে মুক্তিবাহিনী। রাতে ১১৭ জন রাজাকার ৬ নং পাঠাকাটা ইউনিয়ন পরিষদে একত্র হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং ১১০টি অস্ত্র জমা দেয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে লেফটেন্যান্ট আবু তাহের (রামগতি, নোয়াখালি) ও মিত্রবাহিনীর মেজর রানা সিংহ, ইপিআর-এর ল্যান্স নায়েক কোম্পানি কমান্ডার ফরহাদ হোসেন, আব্দুল হক চৌধুরী এবং নকলার অন্য মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন। ৯ই ডিসেম্বর নকলা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
নকলা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আকবর আলী (পিতা হাতেম আলী, কিংকরপুর), ইয়াদ আলী (পিতা সাগির মাহমুদ), সুরুজ্জামান (পিতা সাদেক আলী), দুলাল উদ্দিন (পিতা হাফিজ উদ্দিন, ধুকুড়িয়া), জালাল উদ্দিন (পিতা ছাগির মামুদ, ধনাকুশা), আব্দুর রশিদ (পিতা মিয়ার মামুদ মণ্ডল, উরফা), সুরুজ্জামান (পিতা আয়েতুল্লাহ, লয়খা), জমশেদ আলী (পিতা মামুদ আলী, উরফা), সাহেব আলী ফকির (পিতা কবির শেখ, কুর্শা বাদাগৈড়), হযরত আলী (পিতা মজিদ আলী, কুর্শা বাদাগৈড়), ইদ্রীস আলী (পিতা মামুদ আলী, গৌড়দ্বার), হাসমত আলী (পিতা সমশের আলী, কুর্শা বাদাগৈড়), সুলতান (পিতা সোরহাব হোসেন, কেজাইকাটা), সিরাজুল ইসলাম মঞ্জু (পিতা ময়েজ উদ্দিন সরকার, নারায়ণখোলা), ছায়েদুর রহমান (পিতা তমির শেখ, ধুকুড়িয়া), আনারুল হক (পিতা হাজী ছানাউলাহ, বানেশ্বর্দী), আজিজুল হক (পিতা কছিম উদ্দিন, কবুতরমারী), ওয়াজেদ আলী (পিতা বছির উদ্দিন, কুর্শা বাদাগৈড়) এবং রমিজ উদ্দিন (পিতা আব্বাস আলী, কেজাইকাটা)। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নকলা উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নামফলক, গড়েরগাঁও গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বিদ্যানিকেতন নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। চিথলিয়া গ্রামে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুনসেফ আলীর (কোম্পানি কমান্ডার) নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ৭ নং ইউনিয়নে মুক্তির বাজার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বিদ্যালয় নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লাভা পৌরসভার একটি রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সামসুল হক সড়ক। নকলা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকযুক্ত বেশকিছু ব্রিজ ও সরকারি ভবন মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে উদ্বোধন করানো হয়েছে। নকলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ চলছে। [এ কে এম মহিদুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!