You dont have javascript enabled! Please enable it!

ধুপইল-পঁয়তারপাড়া গণহত্যা (লালপুর, নাটোর)

ধুপইল-পঁয়তারপাড়া গণহত্যা (লালপুর, নাটোর) সংঘটিত হয় ২৯শে মে। এদিন লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত ধুপইল-পঁয়তারপাড়া ও দিলালপুর এলাকাগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায়। এতে ২শ থেকে ৩শ মানুষ নিহত হয়।
ধুপইল-পঁয়তারপাড়া ও দিলালপুর ওয়ালিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। নাটোরের কুখ্যাত রাজাকার হাফেজ আবদুর রহমানের উদ্যোগে হানাদার বাহিনী এ গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালায়। তাদের অন্যা সহযোগীরা ছিল- মো. গোলজার হোসেন, বাঁশবাড়িয়ার ইয়াদ আলী (জামায়াত সদস্য), ময়েজ সরকার, গলেহার মুক্তি (জামায়াত সদস্য), মজের উদ্দিন সরকার (শান্তি কমিটি) প্রমুখ। সেদিন গভীর রাতে (ফজরের আজানের কিছু পূর্বে) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দালালদের সহযোগিতায় ফুলবাড়ি প্রাইমারি স্কুল থেকে দয়রামপুর পর্যন্ত অর্জুনতলা, ধুপইল-পঁয়তারপাড়া, চাঁইপাড়া ও দিলালপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এসব গ্রাম মূলত লালপুর-বাগাতিপাড়া সীমান্তে অবস্থিত। মাঝখানে শুধু বড়াল নদী। দালালরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বুঝিয়েছিল যে, এসব গ্রামে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শেষে কৃষকদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকে। পাকসেনারা দালালদের কথামতো নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষদের জোর করে তুলে আনে। তাদের হঠাৎ আক্রমণে কেউ-কেউ মাঠ, বাড়ি বা রাস্তার দিকে ছুটতে থাকে। যাকে যেখানে পাওয়া যায়, তাকে সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আসা হয়। এরপর বড়াল নদীর তীরে সবাইকে উলঙ্গ করে পরিধানের কাপড় দিয়ে হাত বেঁধে গুলি করলে প্রায় সবাই ঘটনাস্থলে নিহত হয়। গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দালালরা। সেদিন এ গ্রামগুলোয় ২শ থেকে ৩শ মানুষকে হত্যা করা হয়৷ বেশিরভাগ লাশই বড়াল নদীতে ভাসিয়ে দেয় ঘাতক বাহিনী। তাই অনেকেরই পরিচয় জানা যায়নি।
লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যার সময় ধনেশ্বর মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি এক পাকিস্তানি সেনার কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নেয়। কিন্তু ফায়ার করতে না জানায় সে বাঁচতে পারেনি। দৌড়ে পালাতে গেলে তাঁকে প্রথমে পায়ে গুলি করা হয়। পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লে ধনেশ্বর মণ্ডল সঙ্গে-সঙ্গে মারা যান। সেদিন অনেকগুলো লাশ এসিড ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল ঘাতক-দালালরা। কাউকে-কাউকে জবাই করে ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে তারা। হানাদাররা চলে যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয়রা কিছু লাশ কবরস্থ করে। সেদিন গণহত্যায় যারা নিহত হন, তাদের মধ্যে ৩৩ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- ছইর প্রামাণিক (পিতা রূপলাল প্রামাণিক, ধুপইল), মফিজউদ্দিন (পিতা পাঁচু প্রামাণিক, ধুপইল), ওমর আলী বিশ্বাস (পিতা জহির উদ্দিন বিশ্বাস, ধুপইল), সুরাত আলী (পিতা আরজ আলী, ধুপইল), সাজেদুর রহমান (পিতা আজাহার আলী প্রামাণিক, দিলালপুর), সফের উদ্দীন (পিতা মছের মণ্ডল, ধুপইল), বাদল প্রামাণিক (পিতা দেলবর প্রামাণিক, ধুপইল), দেবেন্দ্রনাথ কুণ্ডু-১ (পিতা রুহিনী কুণ্ডু, ধুপইল), নিতাই চন্দ্ৰ কুণ্ডু (পিতা পূর্ণ চন্দ্ৰ কুণ্ডু, ধুপইল), তারাপদ কুণ্ডু (পিতা রাধা বিনোদ কুণ্ডু, ধুপইল), দেবেন্দ্রনাথ কুণ্ডু-২ (পিতা পূর্ণচন্দ্ৰ কুণ্ডু, ধুপইল), নকুল চন্দ্র কুণ্ডু (পিতা আপাল চন্দ্ৰ কুণ্ডু, ধুপইল), টগর চন্দ্র কুণ্ডু (পিতা শশী কুণ্ডু, ধুপইল), অরুণ কুমার কুণ্ডু (পিতা তারাপদ কুণ্ডু, ধুপইল), বৃন্দাবন কুণ্ডু (পিতা সুবল হালদার, ধুপইল), সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল (পিতা লক্ষ্মণ মণ্ডল, দিলালপুর), দেবেন মণ্ডল (পিতা মহেশ মণ্ডল, দিলালপুর), কার্তিক মণ্ডল (পিতা মহেশ মণ্ডল, দিলালপুর), উপেন মণ্ডল (পিতা সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, দিলালপুর), নরেন মণ্ডল ও তার ভাই সতীশ মণ্ডল (পিতা যোগীন মণ্ডল, দিলালপুর), গোকুল চন্দ্র কুণ্ডু, লখিন্দর চন্দ্র প্রামাণিক, আব্দুল হামিদ প্রামাণিক, মন্টু মিয়া (দিলালপুর), সফি প্রামাণিক (পঁয়তারপাড়া), লাকি প্রামাণিক (পঁয়তারপাড়া), সুরেন মণ্ডল, তাঁর পরিবারের আরো ৫ জন সদস্য যথা তার ছেলে ধনেশ্বর মণ্ডল, ছোট দুই ভাই রুহিনী মণ্ডল ও রসিক মণ্ডল, সুরেনের অপর এক ভাই দেবেন মণ্ডল ও তার ছেলে গঙ্গাধর মণ্ডল।
২৯শে মে-র গণহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়া দিনমজুর আব্দুল আজিজ আজো বেঁচে আছেন। বনপাড়া খ্রিস্টান মিশনে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন।
২৯শে মে নিহতদের স্মরণে ঘটনাস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। তাতে ২৫ জন শহীদের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। [সুমা কর্মকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!