You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.04 | ধোপাছড়ি যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

ধোপাছড়ি যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম)

ধোপাছড়ি যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় পাঁচবার – ৪ঠা জুলাই, ৭ই আগস্ট, ১১ই সেপ্টেম্বর, ২৯শে সেপ্টেম্বর এবং ১১ই নভেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় সংঘটিত এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
জামাল উদ্দিন মেম্বার নামে এক স্বাধীনতাবিরোধী ধোপাছড়ি শান্তি কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে এক গোপন আস্তানা গড়ে তোলে। সেখানে সে আলাউদ্দিন নামে এক অস্ত্র-প্রশিক্ষকের মাধ্যমে কতিপয় পাকিস্তানি দালালকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়। এ খবর জানতে পেরে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা ঐ আস্তানা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা ৪ঠা জুলাই এম আর চৌধুরীর নেতৃত্বে ঐ আস্তানায় পৌঁছান। তখন জামাল উদ্দিন মেম্বার সেখানে উপস্থিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আস্তানার নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দালালরা টের পেয়ে তাঁদের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালান। অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে উত্তর হাশিমপুরস্থ ভাইখলিফাপাড়ার দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক)-এর গুলিতে জামাল উদ্দিন মেম্বার এবং অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার গুলিতে আলাউদ্দিন নিহত হলে অন্যরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। নিহতদের লাশ চেমি খালে ফেলে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ আস্তানা থেকে ৫টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল উদ্ধার করেন।

দ্বিতীয় যুদ্ধ
৭ই আগস্ট সকাল ১১টার দিকে গোলার পাহাড় হয়ে একদল এবং শীলঘাটা হয়ে আরেক দল পাঞ্জাবি সৈন্য কতিপয় -রাজাকার-কে সঙ্গে নিয়ে ধোপাছড়ি বাজারে এসে দোকান পোড়াতে থাকে। এ খবর পেয়ে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার আসহাব মিয়া (পিতা কেরামত আলী, গাছবাড়িয়া)-র নেতৃত্বে বাজারের পশ্চিম পাশের পাহাড়ে পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করেন। পাকসেনা ও রাজাকাররাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে ৩ জন রাজাকার গুলিবিদ্ধ হলে হানাদাররা তাদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে গুলিবিদ্ধ রাজাকাররা মারা যায়। এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: হাবিলদার আসহাব মিয়া, আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক, উত্তর হাশিমপুরস্থ ভাইখলিফাপাড়া), ছাবের আহমদ (পিতা গুরা মিয়া, দোহাজারী), আবু বক্কর (পিতা সুলতান আহমদ, বৈলতলী) প্রমুখ।

তৃতীয় যুদ্ধ
১১ই সেপ্টেম্বর ধোপাছড়ি পোস্ট অফিস এলাকায় এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বাহিনীর একদল যোদ্ধা এবং পাকসেনা ও রাজাকারদের মধ্যে সংঘটিত এ- যুদ্ধে অজ্ঞাতনামা দুজন রাজাকার নিহত হয়। উল্লেখ্য যে, এদিন মুক্তিযোদ্ধারা পোস্ট অফিসকে লক্ষ করে ফায়ার করেন এমন অভিযোগে পোস্ট অফিসের ইন্সপেক্টর নুরুল হুদা চৌধুরী ৩০শে অক্টোবর তৎকালীন পটিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলা নং: ১৫, ধারা: US/436 PPC R/W9/7|

চতুর্থ যুদ্ধ
২৯শে সেপ্টেম্বর ধোপাছড়ি বাজারে এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এদিন পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ধোপাছড়ি বাজারে এসে তাণ্ডব শুরু করলে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের একজন হলেন সুলতান আহমদ (পিতা ফেরু মিয়া, রসুলাবাদ, কালিয়াইশ, সাতকানিয়া)।

পঞ্চম যুদ্ধ
ধোপাছড়িতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় ১১ই নভেম্বর। এদিন দুপুর ২টা-২.৩০টার দিকে দোহাজারী ও বান্দরবন থেকে প্রায় ৪০০ পাকসেনা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ধোপাছড়িতে আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুটপাট করা। তখন সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা ধোপাছড়ি বাজারে, একদল দানু মিয়ার পাহাড়ে এবং আরেক দল মায়নির মুখে অবস্থান করছিল। এ তিন দলেরই কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম। কুসুমপুরী নিজে ছিলেন ধোপাছড়ি ফরেস্ট অফিসে। আগের দিন ১০ই নভেম্বর তিনি ও হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম বান্দরবন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চেরাগ আলীর কাছ থেকে সোর্সের মাধ্যমে খবর পান যে, পাকবাহিনী যে-কোনো সময় ধোপাছড়িতে আক্রমণ চালাতে পারে। তাই তাঁরা অস্ত্রশস্ত্র ও যোদ্ধা চেয়ে একটি চিঠি লিখে তা তিনজন মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে রাঙ্গুনিয়ার পার্বত্যাঞ্চলে সুবেদার মেজর টি এম আলী বাহিনীর নিকট পাঠান। পত্রবাহক মুক্তিযোদ্ধাদের দুজন হলেন মুন্সী মিয়া (পিতা আবদুর রহমান চৌধুরী, পূর্ব চন্দনাইশ) ও মোস্তাফিজুর রহমান (পিতা কালু মিয়া, বৈলতলী)। তবে তাঁরা কোনো সহায়তা পাননি।
১১ই নভেম্বর ধোপাছড়িতে আগত পাকিস্তানি সেনা, শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা দুগ্রুপে বিভক্ত ছিল। এক গ্রুপ ধোপাছড়ি বাজারে আক্রমণ শুরু করলে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা হাবিলদার সুজায়েত হোসেনের নেতৃত্বে পশ্চিম পাশের পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। এ- সময় ফরেস্ট অফিস থেকে কুসুমপুরীও পশ্চিমের পাহাড়ে চলে আসেন। এক পর্যায়ে কুসুমপুরীসহ মুক্তিযোদ্ধা দলটি পিছু হটে মায়নির মুখে রওনা দেয়। ততক্ষণে দানু মিয়ার পাহাড়ের দলটি হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলামের নেতৃত্বে ফরেস্ট অফিসে চলে আসে। তাঁরা দুদিকে পজিশন নেয়ার পর হানাদারদের দুগ্রুপই তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়। তখন হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলামের নির্দেশে এই মুক্তিযোদ্ধা দলও পাল্টা আক্রমণ করে। তাঁরা মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর প্রভৃতি ব্যবহার করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। পাকসেনারা ভাবতেই পারেনি, তাদের এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হবে। প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর সন্ধ্যার দিকে হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং অর্ধশত পাকসেনা ও কতিপয় রাজাকার গুলিতে আহত হয়। অন্যদিকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ও ৫ জন নিরীহ লোক শহীদ হন।
এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম (পিতা হামিদ হোসেন, বরকল স্থ কানাইমাদারি), আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক, উত্তর হাশিমপুরস্থ ভাই খলিফাপাড়া), হাবিলদার সুজায়েত হোসেন, হাবিলদার সুজায়েত আলী (পিতা মফজল আহমদ, সাতবাড়িয়াস্থ হাজিপাড়া), আবুল কাশেম (পিতা মফজল আহমদ, দক্ষিণ গাছবাড়িয়া), আইয়ুব আলী (পিতা হামিদ হোসেন, কানাইমাদারি), মো. আবুল কাশেম (পিতা মো. এনু মিঞা, পশ্চিম পাঠানদণ্ডি), আবুবকর চৌধুরী (পিতা কবির আহমদ চৌধুরী, কানাইমাদারি), আনোয়ারুল হক চৌধুরী (পিতা আবু ছায়েদ চৌধুরী, কানাইমাদারি), মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা কোরবান আলী, মধ্যম চন্দনাইশ), আবদুল জব্বার (পিতা দুলা মিয়া চৌধুরী, কানাইমাদারি), ছাবের আহমদ (পিতা গুরা মিয়া, দোহাজারী), মো. ইছহাক মিয়া (পিতা মো. এনু মিয়া, পাঠানদণ্ডি), মনছফ আলী (পিতা আবদুর রশিদ, কানাইমাদারি), হাবিলদার আলী আকবর, আশরাফুল আলম (পিতা এজহার মিয়া, হাশিমপুর), মতিউর রহমান (বরিশাল), হাবিলদার জালাল আহমদ, আশরাফ আলী (কুমিল্লা), মো. রফিকুল ইসলাম (পিতা গুরা মিয়া, উত্তর গাছবাড়িয়া), মমিন মিয়া (ঢাকা), সানাউল্লাহ (যশোর), নায়েক আবুল বশার (রাজশাহী), শফিকুল আলম (কুমিল্লা), সিরাজ উদ্দিন (নোয়াখালী), শামসুল হক (কুমিল্লা), শামসুল হক (কুমিল্লা), আবুল খায়ের (নোয়াখালী), শফিউল্লাহ (নোয়াখালী), সিপাহি সেলিম হোসেন, শশাঙ্ক বিশ্বাস (সাতকানিয়া), আমজাদ আরী (রাজশাহী), সিপাহি আনসার উদ্দিন (পটুয়াখালী), সিপাহি মোশাররফ হোসেন (বরিশাল), তারেক উল্লাহ (কুমিল্লা), সিপাহি আবদুস সামাদ (ঢাকা), সিপাহি আনিসুর রহমান (বরিশাল), আনোয়ার হোসেন (ঢাকা), আহমদ নবী (পিতা বদিউর রহমান, গাছবাড়িয়া সিপাহি আবদুর রউফ (যশোর), সিপাহি জহিরুল হক (নোয়াখালী), রমিজ উদ্দিন (দুরদুরি), নায়েক ফয়েজ আহমদ (পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল, কাঞ্চনা), আবদুল হামিদ (সাতকানিয়া), সিপাহি আবদুল হাই (ঢাকা), সিপাহি সাহেব আলী (রাজশাহী), বাদশা মিয়া (মহেশখালী), এ এম ফররুখ আহমদ (সাতকানিয়া), সুকুমার দাস (পার্বত্য চট্টগ্রাম), মগ সোলায়মান (বান্দরবান), পরেশ বড়ুয়া (রামু), সালাম (সিলেট) প্রমুখ। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড