ধানুয়া-কামালপুর গণকবর (বকশীগঞ্জ, জামালপুর)
ধানুয়া-কামালপুর গণকবর (বকশীগঞ্জ, জামালপুর) জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। বর্তমানে গণকবরটি সংরক্ষিত। পাকসেনারা তাদের কামালপুর ঘাঁটিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে এখানে পুঁতে রাখে। এপ্রিল থেকে বকশীগঞ্জ উপজেলায় পাকিস্তানি মিলিশিয়া-রা শক্ত অবস্থান নিয়ে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী নেজামে ইসলামী ও অন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থী মাদ্রাসায় শিক্ষিতদের নিয়ে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটি, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের খবর পাকসেনাদের প্রদান করত। তারা এদের সহযোগিতায় সাধারণ মানুষদের ধরে হত্যা করত। আওয়ামী লীগ-এর নেতা-কর্মীদের ঘরবাড়িতে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করত। আলবদর ও রাজাকাররা গ্রামগঞ্জ থেকে নারীদের জোরপূর্বক ধরে আনত। তারা গৃহস্থদের গবাদি পশু এনে পাকসেনাদের ক্যাম্পে সরবরাহ করত। বকশীগঞ্জের স্বভাবকবি হুরমুজ আলী ঐ দুঃসময়ের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—
শত শত জনগণ হতাহত
বাড়িঘর অফিস আদালত পুড়ি হলো ধ্বংস
এদেশের কিছু আলেম রাজাকার বদর
পাকেগরে সাথে গেল মিশি
যুবক পাইলেই ধরে আনে দেয়, এটা হায় মুক্তি
অনেক প্রকার শাস্তি দিয়ে পরে করে গুলি।
ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী বকশীগঞ্জের কামালপুরে পাকবাহিনীর একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি ছিল। ঘাঁটিতে তারা গুচ্ছাকারে অনেক কংক্রিটের বাংকার তৈরি করেছিল। বাংকারগুলোতে সুড়ঙ্গপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতেও এসব বাংকার ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। এসব বাংকারের একটিতে ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দি করে রাখা হতো। তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পর হত্যা করে এখানে পুঁতে রাখা হতো। অন্য একটি কক্ষে ছিল নারীনির্যাতন কেন্দ্র। শান্তি কমিটি, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা নারীদের ধরে এনে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। অকথ্য নির্যাতনের পর অসংখ্য নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। তখন তাদের ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী কামালপুর গণকবরে পুঁতে রাখা হতো। এভাবে ৯ মাস পাকসেনারা অনেক মুক্তিকামী মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও নারীকে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে এ গণকবরে পুঁতে রাখে।
৪ঠা ডিসেম্বর কামালপুরের পাকঘাঁটি দখল করে নেয়া সম্ভব হয়। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী-র যৌথ রণকৌশলের ফলে এ ঘাঁটির পতন ঘটানো সম্ভব হয়৷ এখানে বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। এ পাকক্যাম্প দখল করার সময় কয়েক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। কামালপুর মুক্তদিবসে বাংকারের একটি কক্ষে ১৬ জন নারীর রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। চারপাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে গণকবরটি সংরক্ষিত ও একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [রজব বকশী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড