You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ধামইরহাট উপজেলা (নওগাঁ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ধামইরহাট উপজেলা (নওগাঁ)

ধামইরহাট উপজেলা (নওগাঁ) ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ফলে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ধামইরহাটের মানুষ পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১লা মার্চ হঠাৎ করে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ২রা মার্চ থেকেই তারা আন্দোলন-এর কর্মসূচি পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ এর মাধ্যমে এলাকার মানুষ স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা পায়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই উপজেলার সর্বত্র মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রাম শুরু হয়।
৭ই মার্চের ভাষণের পর এলাকার তরুণ ও যুবকরা দেশকে পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। গ্রামে-গঞ্জে তারা তাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশকে স্বাধীন করার জন্য এলাকায় তারা মুক্তিবাহিনী গঠন করে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রথমে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার মধুপুর ও মেহেদীপুরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা ভারতের রাইগাঁ, দেরাদুন ও শিলিগুড়িতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- মো. আব্দুর রউফ মণ্ডল, মো. আফজাল হোসেন মাস্টার, আ ফ ম মিল্লাত, মো. আব্দুল কুদ্দুস, মো. মামুন রেজা, মো. শরিফ উদ্দিন প্রমুখ। এঁদের অনেকেই মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত।
ধামইরহাট উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭নং সেক্টরের অধীনে ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে এলাকায় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মো. নুরুজ্জামান (রাঙ্গামাটি), মো. ফরমুদ হোসেন (মালাহার), মো. আব্দুর রউফ মণ্ডল (ধামইরহাট বাজার) ও মো. জয়নাল আবেদীন সিদ্দিকী।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকহানাদার বাহিনী ধামইরহাট উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে ধামইরহাট বাজার থেকে অর্ধ কিলোমিটার পূর্বদিকে ধামইরহাট-জয়পুরহাট সড়কের ঘুকসী নদীর ওপর ব্রিজ এবং হরিতকীডাঙ্গা গ্রামের সন্নিকটে নলপুকুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনী ১টি এলএমজি ও কিছু গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। এলএমজি-টি হরিতকীডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. রইচ উদ্দিন ভারতে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যান। তখন তাঁর নাম হয় রইচ উদ্দিন এলএমজি। এছাড়া আগ্রাদ্বিগুন ইউনিয়নের কুরমাইল নামক স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
পাকবাহিনী মে মাসের প্রথম দিকে উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে সদর থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ফার্শিপাড়ার জমিদার বাড়ি, আলমপুর ইউনিয়নের রাঙ্গামাটি এবং ধামইরহাট ও জয়পুরহাট জেলার সীমান্তবর্তী পাগল দেওয়ানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের এবং ভারতে যাওয়ার পথে হাজার-হাজার মানুষকে ধরে এনে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হত্যা করে।
ধামইরহাট এলাকাটি মূলত মুসলিম লীগ- প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। এলাকায় ফার্শিপাড়া জমিদার পরিবারসহ বেশ কয়েকজন মুসলিম লীগের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি ছিল। তাদের নেতৃত্বে উপজেলা এবং ইউনিয়নে রাজাকার – <আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। এলাকার পাকবাহিনীর দোসর এবং উল্লেখযোগ্য রাজাকাররা হলো— ধামইরহাট ইউনিয়নের রুপনারায়ণপুরের মো. আমেজ উদ্দিন ভেজালী, আঙ্গরতের রিয়াজ উদ্দিন, মো. ছলিম উদ্দিন, বেনিদুয়ারের আমিনুল ইসলাম, শিবরামপুরের ইজাবুল হক, আঙ্গরত দেওয়ানপাড়ার দেওয়ান মোস্তাফিজুর রহমান, কিয়ামুদ্দিন, শরিফ উদ্দিন, দেওয়ান রফিকুল ইসলাম টুকু, জগতনগরের তফিল উদ্দিন, মো. ইউনুস আলী, মহব্বতপুরের নাজিমুদ্দিন, মণিপুরের কিনুমুদ্দীন, রামরামপুরের দেওয়ান সায়েদ আলী, রুপনারায়ণপুরের জহর আলী মেম্বার, নেউটার শাহার আলী, ইউনুস আলী, ইয়াছিন আলী, হবিবর রহমান, খাইরুল ইসলাম, আব্দুল পুরা, আব্দুস সামাদ, শরিফ উদ্দিন, মইশড়ের দেলদার হোসেন প্রমুখ। আলমপুর ইউনিয়নের রাজাকারদের মধ্যে শালুককুড়ির আবুল হোসেন, ইয়াছিন আলী, ইসমাইল হোসেন, মজিবর রহমান, ছিলিমপুরের দারাজ উদ্দিন, আব্দুল গোফফার, তমিজ উদ্দিন, আব্দুল লতিফ, মোকছেদ আলী, দিলালপুরের আব্দুর রহমান, চাঁদপুরের মাহফুজ, মঙ্গলিয়ার জহির উদ্দিন, ছয়ফদ্দীন, চকহিলালের আব্দুস সামাদ, আব্দুল গোফফার, চৈতন্যপুরের আব্দুল করিম সরদার, রাঙ্গামাটির আব্দুর রহিম, রঘুনাথপুরের নুর মোহাম্মদ প্রমুখ ছিল উল্লেখযোগ্য। জাহানপুর ইউনিয়নের রাজাকারদের মধ্যে ছিল জাহানপুরের আবুল হোসেন, লুৎফর রহমান, ইয়াছিন আলী, কোকিলের জামাল উদ্দিন, নানাইচের আবির উদ্দিন প্রমুখ। আগ্রাদ্বিগুন ইউনিয়নের রাজাকাররা হলো- রোস্তম আলী, ইসবপুর ইউনিয়নের পোড়ানগরের হাজী রহিম উদ্দিন, আড়ানগর ইউনিয়নের আড়ানগরের হবিবর রহমান, লক্ষণপাড়ার আব্দুল খালেক, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, খেলনা ইউনিয়নের চকবেনীর তোফাজ্জল হোসেন, গুপিরামপুরের হাজী শামসুদ্দিন, উমার ইউনিয়নের সুন্দরার শরিফ উদ্দিন, চাঁনকুড়ির মমতাজ উদ্দিন, জোতশ্রীরামের নাসির উদ্দিন, চকউমরের আকতারুজ্জামান বুধা, খড়মপুরের আফাজ উদ্দিন, বালুপাড়ার আয়েজ উদ্দিন, শরিফ উদ্দিন, মোসলেহ উদ্দিন, গাংরার তৌফুর রহমান, মালাহারের মোকলেছার রহমান, মোহাম্মদ আলী পতন, শেখাইপুরের আব্দুল জলিল প্রমুখ। এছাড়াও ধামইরহাট পৌরসভার চকযদুর কায়েম উদ্দিন সরকার, আব্দুল বারেক, মহির উদ্দিন আহমেদ, মাহাতাব উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, ফার্শিপাড়ার শরিফ উদ্দিন, আবিলামের মোকলেছার রহমান প্রমুখ রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল।
উপজেলার সর্বত্র যখন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এলাকাবাসী সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ঠিক তখন এলাকাবাসীর ওপর তাদের নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। উপজেলার ফার্শিপাড়া, মাহীসন্তোষ, রাঙ্গামাটি ও পাগল দেওয়ান ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ধরে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। তাদের নির্যাতনে বংশি রবিদাস (আলতাদিঘী), আব্বাস আলী (অমরপুর), ময়েজ উদ্দিন (মালাহার) প্রাণ হারান। আগস্টের মাঝামাঝি সময় নওগাঁর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এডভোকেট আব্দুল জব্বার (বক্তারপুর, নওগাঁ সদর) মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে ভারত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর ধামইরহাট উপজেলার আমাইতারা কলকলিয়া সেতুর কাছে নওগাঁ সদর থানার হোগলাবাগি গ্রামের যুবক ইউনুস আলীসহ পাককানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ফার্শিপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দুই হাতে পেরেক মেরে এভাবে তিনদিন ধরে নির্মম নির্যাতন শেষে তারা তাঁকে হত্যা করে নিকটস্থ একটি বাড়ির পাশে মাটিচাপা দেয়। ১৪ই আগস্ট রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় তারা উপজেলার সীমান্তবর্তী কুলফৎপুর গ্রামে গণহত্যা চালায়। কুলফৎপুর গণহত্যায় ১৪ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে পাকবাহিনী চকযদু গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ মন্ডলের বাড়ি ও মালাহার গ্রামের ময়েজ উদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া উপজেলার রুপনারায়ণপুর, আলতাদিঘী, মইশড়, পিড়লডাঙ্গা গ্রামে তারা অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় পাকবাহিনী পিড়লডাঙ্গা গ্রামের বেলায়েত হোসেন মাস্টার, ফারাজ উদ্দিন, আব্দুল গফুর ও মোশারফ হোসেনের বাড়িসহ উপজেলার সব জায়গায় লুণ্ঠন করে। বিশেষকরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি বেশি লুণ্ঠিত হয়।
উপজেলার আগ্রাদ্বিগুন গড়, মাহীসন্তোষ, ফাশিপাড়া ক্যান্টনমেন্ট, ধামইরহাট থানা ভবন, হরিতকীডাঙ্গা নয়াপুকুর ও পাগলা দেওয়ান ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। পাকক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে ধরে আনা হতো। অনেক সময় তাঁদের না পেয়ে অভিভাবকদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতে যাওয়ার পথে অনেক বাঙালিকে পাকবাহিনীর সদস্যরা ধরে এনে এসব বন্দিশিবিরের রাখত। অনেককে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেলত।
উপজেলার ফার্শিপাড়া ক্যাম্পের নিকটে ফার্শিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিক, পাগল দেওয়ান গ্রামের পূর্ব মাঠ এবং জাহানপুর ইউনিয়নের শল্পী চিরি নদীর পশ্চিম দিক বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাগল দেওয়ান পাকক্যামের আশেপাশে মানুষের শতশত কঙ্কাল পাওয়া গেছে। কুলফৎপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে পুকুর পাড়ে ১৪ই আগস্ট গণহত্যায় নিহত ১৪ জনের একটি গণকবর রয়েছে।
উপজেলার তর্কিউদ্দিন পার্সী আল আরাবি (রহ.) মাহীসন্তোষ মাজার এলাকা এবং হরিতকীডাঙ্গার সন্নিকটে নয়াপুকুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। ১৪ই অক্টোবর পাকবাহিনীর সঙ্গে মাহীসন্তোষ এলাকায় যুদ্ধে ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এটি মাহীসন্তোষ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এছাড়া আগ্রাদ্বিগুন গড় এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের (হযরতপুর) শহীদ হন। ১৩ই ডিসেম্বর ধামইরহাট উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
ধামইরহাট উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— শফি উদ্দিন (মইশড়), আব্দুল জব্বার (বক্তারপুর, নওগাঁ সদর থানা), ইউনুস আলী (হোগলবাড়ী, নওগাঁ সদর থানা), আব্দুল কাদের (হযরতপুর, আগ্রাদ্বিগুন), আবু বক্কর সিদ্দিক (আমাইপুকুর, পত্নীতলা), উপেন (মহাদেবপুর) ও প্রতাপ (পত্নীতলা)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা পরিষদের সামনে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া কুলফৎপুর গণহত্যায় ১৪ জন শহীদদের স্মরণে একটি নামফলক নির্মাণ করা হয়েছে। মইশড় গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শফি উদ্দিন স্মরণে ধামইরহাট-আলতাদিঘী সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন সড়ক। এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দিক ও প্রতাপ স্মরণে জেলার পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর আত্রাই নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সিদ্দিক-প্রতাপ সেতু। [মো. হারুন আল রশীদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড