You dont have javascript enabled! Please enable it!

ধর্মঘর যুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ)

ধর্মঘর যুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২৪শে আগস্ট ও ২৮শে সেপ্টেম্বর। এতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়৷
মাধবপুর উপজেলার সর্বদক্ষিণে আন্তর্জাতিক সীমানা ঘেঁষে ধর্মঘর ইউনিয়নের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে ও হরষপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিমি পূর্বে এলাকাটি অবস্থিত। তেলিয়াপাড়া থেকে একটি রাস্তা মনতলা হয়ে ধর্মঘরকে সংযুক্ত করেছে। ধর্মঘরের পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের মধ্যে মোহনপুর, বিজয় নগর, আহমেদপুর উল্লেখযোগ্য।
ধর্মঘর ছিল পাকিস্তানিদের একটি কৌশলগত অবস্থান এবং একটি সুরক্ষিত ফাঁড়ি। জুলাই মাস থেকে ধর্মঘর বিওপি ঘিরে পাকিস্তানিরা এক কোম্পানি সৈন্য ও এক কোম্পানি রাজাকার দিয়ে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। এ স্থানটি পাকিস্তানিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ কারণে যে, এটি দখলে থাকলে হরষপুর এলাকায় সিলেট-আখাউড়া রেলপথের নিরাপত্তা এবং ধর্মঘরের স্ফীত অংশ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর কাছে এ এলাকার গুরুত্ব ছিল এ কারণে যে, এখানকার আন্তর্জাতিক সীমানার আশপাশে তাঁদের কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। এ এলাকাটি মুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তাঁদের সহজ যোগাযোগ ও অপারেশন পরিচালনা সুবিধাজনক হবে এবং তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
তখন সবেমাত্র ‘এস’ ফোর্স গঠিত হয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সৈন্যদেরকে উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। এ অবস্থায়ই অধিনায়ক কে এম সফিউল্লাহ ধর্মঘর-তেলিয়াপাড়া সড়ক মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর ১১তম ইস্ট বেঙ্গল তখনো পূর্ণমাত্রায় গড়ে ওঠেনি। আক্রমণ পরিচালনায় সমর্থ এবং উপযোগী হচ্ছে একমাত্র দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল। ধর্মঘরসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় হামলাসহ ক্ষুদ্র ধরনের কয়েকটি আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করছেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। এ অঞ্চলে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও তাঁর যোগ্যতায় আস্থাবান হয়ে অধিনায়ক তাঁকেই কমান্ডার হিসেবে মনোনীত করেন।
পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে হামলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিবন্ধকতা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মতিন এবং ক্যাপ্টেন নাসিমকে। পশ্চিম দিকে আহমদপুরের দায়িত্ব দেয়া হয় লে. হেলাল মোরশেদকে। কমান্ডার ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া দক্ষিণ দিক থেকে মালঞ্চপুর সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম দিক থেকে শত্রুদের অবস্থানের ওপরে হামলা করবেন। আক্রমণের দিন হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ এবং আক্রমণের চূড়ান্ত সময় নির্ধারিত হয় গভীর রাত। ভারতীয় মাউন্টেইন ব্যাটারি থেকে গোলন্দাজ সহযোগিতার নিশ্চয়তা পাওয়ায় আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
আক্রমণের পূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া ২৪শে আগস্ট মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান (শহীদ), সুবেদার চাঁন মিঞা, সুবেদার তৈয়ব, সুবেদার সফিউল্লাহ, নায়েক তাহের এবং সিপাই হান্নানকে নিয়ে রেকির উদ্দেশ্যে রওনা হন। একমাত্র হান্নান ছাড়া সবার কাছে অস্ত্র ছিল। লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের কাছে ছিল একটি ভারতীয় স্টেনগান, সুবেদার চাঁন মিয়া ও সুবেদার সফিউল্লাহ্ নিয়েছিলেন চীনা স্টেনগান, সুবেদার তৈয়ব নিয়েছিলেন ভারতীয় স্টেনগান, আর কমান্ডারের কাছে ছিল একটি চীনা স্টেনগান। নায়েক তাহেরের সঙ্গে ছিল একটি ভারতীয় হালকা মেশিনগান এবং ১৩টি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন।
বেলা সাড়ে বারোটার দিকে বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় দেড় মাইল অভ্যন্তরে ছোট্ট একটা পুকুরের পাড় দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় হঠাৎ অপর দিক থেকে হালকা চীনা মেশিনগান ও চীনা রাইফেলের গুলি বর্ষিত হতে থাকে। মুহূর্ত বিলম্ব না করে রেকি পার্টি মাটিতে উপুড় হয়ে পজিশন নেয় এবং পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলিতে আকাশ- বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
শত্রুরা একটা বাড়ি থেকে রেকি পার্টির দিকে গুলি ছুঁড়ছিল। সেই বাড়িটা থেকে তারা বেরিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তাহেরের বিরামহীন গুলিবর্ষণে তারা মাথা জাগাতে পারছিল না। যদিও তাহের কাউকে তাক করে গুলি ছোড়েননি, তবুও তাতেই শত্রুরা এগুতে সাহস পাচ্ছিল না।
ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসছিল। সৌভাগ্যবশত বেলা ১টা ১০ মিনিটের দিকে সেই প্রায় দুর্ভেদ্য ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসে রেকি পার্টি। নায়েক তাহের ও সিপাহি হান্নান সেদিন দুর্দমনীয় মনোবল, উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহসী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এ খণ্ডযুদ্ধে অপরিসীম কৃতিত্ব ও বীরত্ব প্রদর্শন করাতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ তাহের ও হান্নানকে ২৫০০ টাকা পুরস্কার দেন।
২৪শে আগস্ট ধর্মঘরের শত্রুঘাঁটি রেকি করার ব্যর্থতার পর ২৮ ও ২৯শে আগস্টের রাত্রিতে অন্য একটা রাস্তা দিয়ে রেকি করে ধর্মঘর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়।
নতুনভাবে সৈন্য সাজিয়ে নিয়ে এবং প্রয়োজনীয় যুদ্ধ- সরঞ্জামসহ সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণোপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করতে রওনা হওয়ার কিছু আগে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদেরকে সম্বোধন করে একটি দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে সব প্রস্তুতি ও আক্রমণের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত করে রাত সাড়ে ৯টায় রওনা দেন।
মুক্তিযোদ্ধারা রাত ৯.৫০ মিনিটে গাড়ি করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছান। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে রাত ১১টায় তাঁরা শত্রুঘাঁটির দেড় মাইল দূরত্বে একটি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছান। সেখান থেকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা মোতাবেক সৈন্য সমাবেশ ঘটান। প্রথমে লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের ৪নং প্লাটুন, তাঁর সঙ্গে সুবেদার চাঁন মিঞা। তারপরে সুবেদার সফিউল্লাহ্ ৬নং প্লাটুন, তার পেছনে কোম্পানি কমান্ডার নিজে এবং শেষে সুবেদার তৈয়বের ৫নং প্লাটুন। এমনিতেই ছিল কৃষ্ণপক্ষের রাত। তদুপরি রওনা হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বৃষ্টি শুরু হয়। বিদঘুটে অন্ধকার। মাত্র একগজ দূর থেকে কেউ কাউকে দেখতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ চলার পর ঐ অন্ধকারে পরস্পরকে দেখতে না পেয়ে প্রথম প্লাটুনটি দ্বিতীয় প্লাটুন থেকে আলাদা হয়ে যায়। অবস্থার বৈপরীত্যে কমান্ডার কোম্পানিকে হল্ট করিয়ে চারদিকে লোক পাঠান পুনরায় যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। কিন্তু কোথাও তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায় না। ওদিকে দ্রুত গতিতে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করার নির্দিষ্ট সময় এগিয়ে আসছিল। রাত ২টায় আক্রমণ করার কথা।
সহযোদ্ধাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে সুবিদ আলী ভূঁইয়া বাকি ২ প্লাটুন নিয়েই শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করার মনস্থ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ্র সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। সে সময় খুব জোরে-সোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কমান্ডারের সঙ্গে ওয়ারলেস সেট ছিল দুটি। একটি গোলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে সংযোগ রাখার জন্য, অন্যটি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ্র সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে দুটি সেটেই গণ্ডগোল দেখা দেয়। অনেক চেষ্টার পর লে. কর্নেল সফিউল্লাহকে সেটে পেয়ে তিনি তাঁদের একটি প্লাটুন হারাবার সংবাদটা তাঁকে জানান। তিনি উত্তরে জানা যে, লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের প্লাটুন আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা নিজেদের ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছেছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই তাঁরা বাহিনীর সঙ্গে পুনরায় যোগ দেবেন।
এবারে শুধু বৃষ্টি নয় – শিলাবৃষ্টি। রাতের গভীরতার সঙ্গে অন্ধকারের গাঢ়ত্বও বেড়ে চলছিল। রাত ২.১৫ মিনিটে তাঁরা আক্রমণ করার জন্য পজিশনে পৌছান। কিন্তু লে. কর্নেল সফিউল্লাহ্র সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। প্রায় ১০ মিনিট চেষ্টার পর তাঁকে পেয়ে কোড ওয়ার্ড জানিয়ে দেয়া হয়। কয়েক মিনিট পরেই গোলন্দাজ বাহিনীর তরফ থেকে কামানের প্রথম গোলা বর্ষিত হয়।
আক্রমণের সময় প্রথম পর্যায়ে ৫০০ গোলার সাপোর্ট দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু বৃষ্টির কারণে কামান বসে যাওয়ায় সে সাহায্য পাওয়া যায়নি। মাঝে-মাঝে কামানের যে গোলা শত্রুঘাঁটির ওপর গিয়ে পড়ছিল, তা এ যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ওদিকে শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীও বসে ছিল না। তারা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে চলছিল।
প্রচণ্ড বৃষ্টি আর তার সঙ্গে কনকনে হিম হাওয়ায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ঠাণ্ডায় সবার হাত জমে যাচ্ছিল। হাতে আর রাইফেল ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ওদিকে কামানের সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছিল না। এরূপ চরম প্রতিকূল অবস্থার কারণে লে. কর্নেল সফিউল্লাহ যুদ্ধ করা সম্ভব নয় জানিয়ে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পেছনে সরে আসতে নির্দেশ দেন। বৃষ্টি, শীত আর অন্ধকার রাত্রির জন্য অভিযান ব্যর্থ হয়।
এ অভিযানের পরপরই পাকিস্তান বাহিনী ঐ ফাঁড়িটিতে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁড়িটি পুনরায় আক্রমণ করার কথা চিন্তা করেন। ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কমান্ডার বিষয়টি মূল্যায়ন করেন। তাদের ধারণা সর্বাধিক দুটি কোম্পানির সাহায্যেই এলাকাটি শত্রুমুক্ত করা সম্ভবপর। সুতরাং ১৮তম রাজপুত একই ধরনের পরিকল্পনাসহ দুকোম্পানি সৈন্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। দ্বিতীয় আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয় ২৮শে সেপ্টেম্বর। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল দুটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করবে। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার ওপর ন্যস্ত করা হয় ভিন্নতর দায়িত্ব। তিনি বিজয়নগরের দিক থেকে লক্ষ্যস্থলের দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি ভিন্নমুখী করে তোলার জন্য ভুয়া আক্রমণ পরিচালনা করবেন। আক্রমণের সময় ভোর ৫টা। মূল অভিযান উত্তরে চৌমুহনী বাজার থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্যাপক গোলন্দাজ সহযোগিতার ব্যাপারেও নিশ্চয়তা দেয়া হয়।
নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা যার-যার অবস্থান নেন। আক্রমণপূর্ব বোমাবর্ষণ শুরু হয় শত্রু অবস্থানের ওপর। একই সময়ে পাকিস্তান বাহিনী পাল্টা বোমাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী অগ্রবর্তী সেনাদলের সামনে স্থাপিত তিনটি ভারী মেশিনগানের গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে ১৮তম রাজপুত রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি পাকিস্তানিদের অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মেশিনগানের সামনে রাজপুত ব্যাটালিয়নের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সকাল ১০টা পর্যন্ত বহু হতাহত হওয়া সত্ত্বেও উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষাবধি পরিস্থিতির কারণে যুদ্ধ বন্ধ করা হয়। এ অভিযানে ভারতীয়দের ক্ষয়ক্ষতি ছিল বেশ। এতে তাঁদের একজন অফিসারও শহীদ হন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!