You dont have javascript enabled! Please enable it! শেখ সাহেবের বাড়ি হিসেবে সর্বজনস্থ পরিচিত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি - সংগ্রামের নোটবুক

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি বঙ্গবন্ধু বা শেখ সাহেবের বাড়ি হিসেবে সর্বজনস্থ পরিচিত। বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর ৬৭৭, কিন্তু ৩২ নম্বর সড়কের সঙ্গে এ নম্বর একাকার হয়ে একক সত্ত্বায় রূপ নিয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বলতেই সকলে বোঝেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। এর পৃথক হোল্ডিং নম্বর সকলেই আজ বিস্মৃত আর তা স্মরণে রাখার আবশ্যকতাও পড়ে না। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বা বাসগৃহ হিসেবে নয়, বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনে এ বাড়ির অবস্থান ও ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণেই ৩২ নম্বর ধানমন্ডির এরূপ পরিচিতি। এটিকে আখ্যায়িত করা যায় বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার হিসেবে। সে- লক্ষ্যে এখানে দিনের পর দিন রাজনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং জনগণের উদ্দেশে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এ বাড়ির যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা, অপরদিকে তেমনি স্বাধীনতাপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশী-বিদেশী চক্রের ষড়যন্ত্রে এ বাড়িতেই সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, যার শিকার হন বাঙালি জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য। বাড়িটি বর্তমানে একটি ট্রাস্টের অধীনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এসে প্রথমে প্রগতিশীল মুসলিম লীগ কর্মীদের জন্য বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত (১৯৪৪) ১৫০ মুঘলটুলী পার্টি হাউজে ওঠেন। সেখানে থেকেই ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিরোধী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় ১৫ দিনের জন্য মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬-৫৮ সময়ে খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ-এর মন্ত্রিসভা গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু নয় মাস সে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকার পর স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে (৩০শে মে ১৯৫৭) তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ সময় পর্যন্ত ঢাকা শহরে তাঁর
নিজস্ব কোনো বাড়ি ছিল না। ১৯৫৭ সালে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব ২ হাজার টাকা এককালীন জমা দিয়ে তাঁর নামে ধানমন্ডিতে পিডব্লিউডি-র কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা মূল্যে ১ বিঘার একটি প্লট বরাদ্ধ পান। বাকি ৪ হাজার টাকা ছিল কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য। বেগম মুজিবের মাসে-মাসে জমানো টাকা ও হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৬১ সালে সেখানে একটি বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৬১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তিন কক্ষবিশিষ্ট একতলা একটি ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে লেখেন, ‘১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনোমতে তিনটা কামরা করে এসে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজকর্মও বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়। বেগম মুজিবের জমানো টাকা ও হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের ঋণ ছাড়াও এ বাড়ি নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর শুভানুধ্যায়ী অনেকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। এ বাড়িতে ওঠার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করা বাসায় কাটাতে হয়। আইয়ুব সরকারবিরোধী বঙ্গবন্ধুর কঠোর অবস্থান ও বিভিন্ন সময়ে কারাবন্দি থাকার কারণে ভাড়ায় বাসা মেলাও এ পরিবারের জন্য ছিল দুরূহ। যাহোক, পর্যায়ক্রমে একতলা বাড়িটি আড়াইতলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখে সম্প্রসারিত হয়।
৩২ নম্বর বাড়িটির রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এ বাড়িতে অনেক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি এ বাড়িতেই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির পূর্বতন সকল সদস্য, পুনর্গঠিত জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং দল থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দের উপস্থিতিতে ২ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এনডিএফ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটি ফ্রন্ট) থেকে বেড়িয়ে এসে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সভায় ৬ সপ্তাহের মধ্যে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬৬ সালে ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ খ্যাত বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি – লাহোরে বিরোধী দলের কনভেনশনে (৫-৬ই ফেব্রুয়ারি) উত্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টার পর ২০শে ফেব্রুয়ারি ৩২ নম্বর ধানমন্ডি ভবনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, দলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় তাঁর ৬-দফা কর্মসূচির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। ঐ সভায় ১৮-২০শে মার্চ ৩ দিনব্যাপী দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। একই সভায় ৬-দফার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ পুস্তিকা প্রকাশ করে তা দেশবাসীর মধ্যে বিতরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতির সম্মুখে বঙ্গবন্ধুর ৬- দফা কর্মসূচি পেশ এবং ৩ মাসের মতো তা সারাদেশে প্রচারশেষে ৮ই মে নারায়ণগঞ্জের জনসভা থেকে ফিরে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে একনাগারে প্রায় ৩ বছর কারাগারে বন্দি জীবন কাটান। এ-সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁকে ১ নম্বর আসামি করে আইয়ুব সরকার কর্তৃক আগরতলা মামলা দায়ের (১৯৬৮) এবং ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক আদালতে বিচারকার্য পরিচালিত হয়। এর বিরুদ্ধে ৬৯-এ দেশব্যাপী প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের নিমিত্তে প্রথমে প্যারোলে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নিলে ঐ বাড়ি থেকেই বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো অবস্থায়ই প্যারোলে মুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন না করা সংক্রান্ত একটি চিরকুট নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন, যা ছিল নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ১৯৭০ সালের নির্বাচন শেষে এ বাড়িতে বসেই বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ঐ নির্বাচনের ফলাফল শুনছিলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও ৬-দফার পক্ষে গণরায় বাঞ্চাল করতে পাকিস্তানের নতুন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৩রা মার্চ ১৯৭১ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন মাত্র ২দিন পূর্বে ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করলে এর বিরুদ্ধে ২-২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক হরতালের কর্মসূচি পালনকালে এ বাড়ি থেকে সময়ে-সময়ে বাঙালিদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত নির্দেশাবলি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ গণমাধ্যমে তুলে ধরতেন এবং সে অনুযায়ী তখন পূর্ব বাংলার প্রশাসন পরিচালিত হতো। ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে এ বাড়িতেই একটানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন তা নিয়ে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু কী হবে তা নির্ধারণের ভার নিজের ওপর নিয়ে বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এ ক্ষেত্রে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব-এর বক্তব্য ‘… সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে …. অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে … তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে’ বঙ্গবন্ধুর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল বলে সাতই মার্চের ভাষণ থেকে প্রতীয়মান। মার্চ মাসের শুরু থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় চলমান অসহযোগ আন্দোলন কালে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটি পরিণত হয়েছিল সকল মিছিলের শেষ গন্তব্য ও সর্বস্তরের মানুষের কেন্দ্রস্থলে। এ সম্বন্ধে লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক Evening Standard (12 March 1971) পত্রিকার মন্তব্য, ‘Sheikh Mujibur Rahman now appears to be the real boss of East Pakistan with the complete support of the population … Rahman’s home in Dhanmondi, already known as Number 10 Downing Street in imitation of the British Prime Minister’s residence has been besieged by bureaucrats, politicians, bankers, industrialists and people from all walks of life.’
২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসকে বাংলার ছাত্র সমাজ ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ঐদিন সারা বাংলার ঘরে-ঘরে, অফিস-আদালতে, যানবাহনে যেমন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়, তেমনি বঙ্গবন্ধু নিজহাতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে ঐ পতাকা উড্ডীন করেন। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও’ মর্মে বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এ ঘোষণা ও নির্দেশনা ইপিআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে ঐ রাতেই পৌছে যায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করতে এসে সে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩২ নম্বর বাসভবনের সকল কক্ষ লুটপাট এবং বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব লাইব্রেরিটি তছনছ করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা বসায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর বেগম মুজিব পুত্র শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে প্রথমে ধানমন্ডিতে এক প্রতিবেশীর বাসায়, পরে একই এলাকায় এক আত্মীয়ের ফ্লাটে, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাসহ ওয়ারিতে এক আত্মীয়ের বাসায়, এরপর বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, তাঁর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াসহ সকলে খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ার একটি বাসায়, ৪ দিনের মাথায় ঐ বাসা ছাড়তে বাধ্য হয়ে মগবাজার চৌরাস্তার কাছে প্রধান সড়কে অবস্থিত অপর একটি বাসায় অবস্থান নেন। অতঃপর ১২ই মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকল সদস্যকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে কড়া সশস্ত্র পাহারায় অন্তরীণ করে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এ অবস্থায়ই এ বাড়িতে তাঁদের দিন কাটে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম এ বাড়িতেই ওঠেন।
এরপর পার্শ্ববর্তী আরেকটি ভাড়া করা বাড়িতে এবং সর্বশেষে, ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটি স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে বাসোপযোগী করে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে সেখানে ওঠেন রাষ্ট্রীয় কোনো ভবনে না উঠে প্রায় নিরাপত্তাহীন ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাটে। এখানেই সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, যার নির্মম শিকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য।
সে সময়ে দেশের বাইরে অবস্থান করায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পান। দীর্ঘদিন তাঁরা নির্বাসিত জীবন-যাপনে বাধ্য হন। সে অবস্থায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তবে তাঁকে ধানমন্ডির বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তখন ক্ষমতায় জেনারেল জিয়াউর রহমান। একই বছর ১২ই জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নির্দেশে বাড়িটি খুলে দেয়া হয়। তখন বাড়িটিতে গাছপালা জন্মে জঙ্গলে রূপ নেয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা বাড়িটিকে জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কেননা জনগণের সার্বিক মুক্তি তথা তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, এমনকি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি ট্রাস্টের অধীনে ১৯৯৪ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে এ বাড়িটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ, দলিলপত্র, ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের নানা নিদর্শন এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। এখানে রয়েছে বাঙালি, বাংলাদেশ ও আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কিত একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবন তথা বর্তমান স্মৃতি জাদুঘরটি বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ২০১৫; হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, ঢাকা, বাংলা একাডেমি ২০১৬; এম. নজরুল ইসলাম, ৩২ নম্বরের বাড়ি ও সুধাসদন : যে ইতিহাস সবার জানা দরকার, ঢাকা, সুবর্ণ ২০১৬; আমিনুর রহমান সুলতান, বাড়ির নাম ৩২ নম্বর, ঢাকা, পুথিনিলয় ২০১৬

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড