You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৌলতখান থানা যুদ্ধ(দৌলতখান, ভোলা)

দৌলতখান থানা যুদ্ধ(দৌলতখান, ভোলা) সংঘটিত হয় তিন দফায় ২৩শে অক্টোবর, ২৭শে অক্টোবর ও ২৬শে নভেম্বর। ভোলা জেলার অন্তর্গত এ থানার অবস্থান জেলা শহর থেকে প্রায় ২১ কিমি দূরে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে পাকবাহিনীর অনুগত পুলিশ, রাজাকার ও ~শান্তি কমিটির লোকজন এ থানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২৩শে অক্টোবর এক অভিযানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমবার তা মুক্ত করেন।
থানাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য আনসার এডজুট্যান্ট আলী আকবর (বড়ভাই), কর্পোরাল ইব্রাহিম মিয়া, ল্যান্স নায়েক মোহাম্মদ ফারুক বাচ্চু, জমশেদ খন্দকার, আবু তাহের ও ল্যান্স নায়েক মনির হোসেন এক পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তাঁদের নেতৃত্বে ৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ১৮ই অক্টোবর গভীর রাতে ভোলার হেকমাগজারিয়া হয়ে ঘুইঙ্গার হাটের পূর্বদিকে শরৎ ডাক্তারের বাড়িতে অবস্থান নেয়। তাঁদের সঙ্গে ছিল একটি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৩২টি গোলা, ৩টি এলএমজি, ৬টি স্টেনগান, ২৬টি এসএলআর, ২০টি ৩০৩ রাইফেল এবং অন্যান্য এম্যুনেশন। এ গ্রুপের নেতা ছিলেন মোহাম্মদ ফারুক। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৫ জন ছিলেন ভোলার বাসিন্দা, অন্যরা বরিশাল, ফরিদপুর ও নোয়াখালীর।
শরৎ ডাক্তারের বাড়িতে বসে মোহাম্মদ ফারুক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকসহ এলাকার বিশ্বস্তদের মাধ্যমে থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। এ-সময় থানায় ৪০-৫০ জন পুলিশ ও রাজাকার ছিল। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন হাবিবুর রহমান। রাজাকার কমান্ডার ছিল রাধাবল্লভের সিরাজুল হক (সেরু ডিলার)।
২২শে অক্টোবর বিকেলে মোহাম্মদ ফারুক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পরামর্শ করে থানা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন এবং এদিন মধ্যরাতে তাঁরা থানাসংলগ্ন এলাকায় পৌঁছান। অতঃপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী থানার পশ্চিম পাশের আবু সিকদারের বাড়ির পুকুরপাড় ও বাগান, দক্ষিণ পাশের বাজার এবং দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের আজিম উদ্দিন পাটোয়ারীর বাড়ির সামনের বাগানে অবস্থান নিয়ে থানার টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
২৩শে অক্টোবর রাত ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে প্রথম ফায়ার করা হয়। থানা থেকে পুলিশ ও রাজাকাররাও পাল্টা জবাব দেয়। ভোর পর্যন্ত থেমে-থেমে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সাধারণ জনগণ বাজারে এসে জমায়েত হয়। মাইকে থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের উদ্দেশে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তারা তা না করে বরং আক্রমণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। উপস্থিত জনতা ‘জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করতে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারাও আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। পরদিন সকাল ৯:৩০টার দিকে শত্রুপক্ষের গুলিতে থানার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের বাগানে থেকে যুদ্ধরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ তালুকদার (ফরিদপুর) শহীদ হন। এ খবর প্রচারের পর বিভিন্ন স্থান থেকে আরো মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ লোক বাজারে এসে জড়ো হয়। যেসব মুক্তিযোদ্ধার হাতে অস্ত্র ছিল তাঁরা যুদ্ধে অংশ নেন এবং অন্যরা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। স্থানীয় সাধারণ জনগণও বিভিন্নভাবে তাঁদের সাহায্য করে। এ-সময় শত্রুদের গুলিতে আজিম উদ্দিন পাটোয়ারীর বাড়ির সামনে মো. হাফিজ মুন্সী (পিতা নজির আহমদ মুন্সী, চর খলিফা) নামে একজন গ্রামবাসী শহীদ হন। এ অবস্থায় উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলিতে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে আলী আকবর ও ইব্রাহিম মিয়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।
এমন সময় মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন মিয়া মর্টার থেকে একটি গোলা নিক্ষেপ করেন। গোলাটি লক্ষ্য ভেদ করায় থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকাররা দোতলা থেকে নিচে নামতে থাকে। তখন মর্টার থেকে ২য় গোলা নিক্ষেপ করা হয়। বেলা ১২:৩০টার দিকে থানার দিক থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে থানার উত্তরপার্শ্বস্থ ধানক্ষেত ও পূর্বপার্শ্বস্থ কালির খাল দিয়ে অনেক পুলিশ ও রাজাকার ছদ্মবেশে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন গুলিবন্ধের বিষয়টি কৌশলগত কি- না তা যাচাই করছিলেন। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা থানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে থানার কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান ও রাজাকার কমান্ডার সেরু হাত তুলে থানা থেকে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ সেরু কমান্ডার থানার সামনের পুকুরে ঝাঁপ দেয়। তাকে অনুসরণ করে অন্যান্য পুলিশ ও রাজাকাররাও পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সেরুকে মুক্তিযোদ্ধারা পুকুরের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করেন। কয়েকজন পুলিশ ও রাজাকারকে জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলে। অনেকে জনতার সঙ্গে মিশে যায়। থানার কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আমির জান চৌধুরী গজনবী তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা থানা তল্লাশি করে তিনজন রাজাকারকে বন্দি করে কালির খালপাড়ে গুলি করে হত্যা করেন। থানা থেকে তাঁরা ৪০টি রাইফেল ও কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেন। এ- যুদ্ধে শত্রুপক্ষের মোট ৫ জন পুলিশ ও ১২ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধের পরদিন পুলিশ ও রাজাকারদের সহায়তা করার অভিযোগে সৈয়দপুরের আবুল ফাত্তাহকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেন। যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ তালুকদারের লাশ দৌলতখান সরকারি গোরস্তানে এবং মো. হাফিজ মুন্সীর লাশ পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আলী আকবর, ইব্রাহিম মিয়া, মোহাম্মদ ফারুক, আবুল হাশেম এবং আবু তাহের। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন তাঁরা হলেন- নেহাল হোসেন তালুকদার, আলিমুল হুদা দারোগা, আমির জান চৌধুরী, আহমদ উল্লাহ মাস্টার, নাগর তালুকদার, খোরশেদ আলম দরবেশ, গোলাম কিবরিয়া, শাহজাহান ডাক্তার, আমির হোসেন ডাক্তার, মুসলিম দফাদার, হাদিস পাটোয়ারী, খোরশেদ আলম ডাক্তার, বেলায়েত চৌধুরী, আবু মিয়া, মন্নান খন্দকার, আরজু সিকদার, নান্টু মিয়া, আবি আব্দুল্লাহ, রশিদ মিয়া, হাতেম মাস্টার, ইব্রাহিম বেপারী, জানু বেপারী, শাহজাহান নান্টু, আনিসুল হক, কানু, ইয়াসিন বেপারী প্রমুখ।
২৩শে অক্টোবরের যুদ্ধে দৌলতখান থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এলেও তাঁরা তা ধরে রাখতে পারেননি। ২৭শে অক্টোবর পাকবাহিনী এসে আবার তা দখল করে রাজাকারদের সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। পরে ২৬শে নভেম্বর থানাসহ সমগ্র উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। [মো. রফিকুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!