মুক্তিযুদ্ধে দৌলতপুর উপজেলা (মানিকগঞ্জ)
দৌলতপুর উপজেলা (মানিকগঞ্জ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ না জানিয়ে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু -অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দিলে দৌলতপুর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করে। এরপর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানালে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। দৌলতপুর থেকে নির্বাচিত তালুকনগরের এ কে এম সিদ্দিকুর রহমান এমপিএ-এর নেতৃত্বে থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আফাজ উদ্দিন (রঘুঘোষ), হাবিবুর রহমান (রামচন্দ্রপুর), ধনি আহমেদ সরকার (বাচামারা), ক্ষিতীশ চন্দ্র বসু (খলসী), মনছুর আলী (খলসী), মনছুর ডাক্তার (বাঘুটিয়া), ডা. রিয়াজ উদ্দিন (দৌলতপুর), অবনী বন্ধু ফৌজদার (দৌলতপুর), রমণী মোহন বসাক (দৌলতপুর), ছেনুদ্দিন আহমেদ (চকহরিচরণ), হাকিম মাস্টার (কাকনা), ছোহরাব আলী মণ্ডল (চরকাটারী), আব্দুর রশিদ মাস্টার (চরকাটারী), বাহাদুর আলী (দৌলতপুর), আকবর হোসেন মোল্লা (চকমিরপুর), নুরুল ইসলাম (শ্যামপুর), বেলায়েত হোসেন (শ্যামপুর), জয়নাল হোসেন (খলসী), আব্দুল হামিদ মাস্টার (বাঘুটিয়া), ওসমান গনি (বাচামারা), মোকছেদ বিএসসি (বাঘুটিয়া), এস এম শাহজাহান (কৈল) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার-এর শপথ গ্রহণের পর এ কে এম সিদ্দিকুর রহমান এমপিএ-র নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২নং সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর খালেদ মোশাররফ মানিকগঞ্জ মহকুমাসহ ২২টি থানা নিয়ে একটি অঞ্চল গঠন করেন। এ অঞ্চলের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী-কে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ছদ্মবেশে দৌলতপুরে যাতায়াত করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করতেন। তাঁর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম দৌলতপুরের মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি দৌলতপুর বাজার সংলগ্ন ডা. রিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ১০ই মে তাঁর নেতৃত্বে এখানকার ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল গঠিত হয়। এ দলের সদস্যদের মধ্যে হাবিবুর রহমান হবি (রামচন্দ্রপুর), বাহাদুর আলী (নয়াপাড়া, দৌলতপুর), দেলোয়ার হোসেন বাচ্চু (দৌলতপুর), কফিল উদ্দিন (দৌলতপুর), বজলুল হক শাহজাহান (দৌলতপুর), আমজাদ হোসেন (দৌলতপুর), আব্দুস সালাম দুদু (রামচন্দ্রপুর), আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা (রামচন্দ্রপুর), লোকমান হোসেন মোল্লা (রামচন্দ্রপুর), আবদুস ছালাম মাস্টার (রামচন্দ্রপুর), সুজায়েত হোসেন (রামচন্দ্রপুর), আব্দুল হালিম মোল্লা (রামচন্দ্রপুর), মেহের আলী (নয়াপাড়া, দৌলতপুর), আব্দুল মজিদ (চকমিরপুর), হামিদুর রহমান দুদু (চকমিরপুর), আকবর হোসেন মোল্লা (চকমিরপুর), হরিলাল সরকার (মুলকান্দি), ওয়াজ উদ্দিন (দৌলতপুর), মোতালেব প্রধান, এম এম শাহজাহান (কৈল) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে দৌলতপুরের পূর্বাঞ্চল কলিয়া ধামশ্বরের নিরালীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-কালীন ছাত্রনেতা আফাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। দড়গ্রামের (সাটুরিয়া) এলাহী মাস্টার ১২-১৩ জন সদস্য নিয়ে নিরালী ক্যাম্পে যোগ দেন। পরবর্তীতে নুরুল ইসলাম (শ্যামপুর), হাকিম মাস্টার (কাকনা), আব্দুল আজিজ খান (কলিয়া) প্রমুখের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নিরালী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পূর্ণতা লাভ করে। ৭০ জনের অধিক মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
নাগরপুর (টাঙ্গাইল)-এর খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে দক্ষিণ টাঙ্গাইলে মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল গড়ে ওঠে তহশীল অফিস থেকে একটি বন্দুক সংগ্রহ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে তিনি কয়েকটি নৌকাযোগে নিরালী ক্যাম্পে উপস্থিত হন এবং সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে ৩৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা নিরালী ক্যাম্পের পাশে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ঘাঁটি স্থাপন করেন। দৌলতপুরের দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষিতীশ বোসের নেতৃত্বে খলসী ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। তাঁর বাসভবনে মুক্তিসেনাদের গোপন সভা অনুষ্ঠিত হতো। এ ক্যাম্পের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন— মনছের আলী (খলসী), জয়নাল হোসেন (বিষ্ণুপুর), আব্দুল মুন্নাফ (বাঘুলি), মোহাম্মদ আলী (খলসী) প্রমুখ।
মনছুর ডাক্তারের নেতৃত্বে বাঘুটিয়া ইউনিয়নে গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প। বাচামারা ইউনিয়নে বাতেন ও শহীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি ক্যাম্প। তাছাড়া আব্দুল কাদের ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে চরকাটারীতে এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প গঠন করেন। এ ক্যাম্পে রশিদ ডাক্তার, রশিদ মাস্টার, মোকছেদ আলী বিএ, সোহরাব মণ্ডল, আব্দুল আজিজ মণ্ডল প্রমুখের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
২৫শে মার্চের পর দৌলতপুর থানায় পাকিস্তান সরকার ইপিআর সদস্য মোতায়েন করে। সরকারের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে হাবিলদার আবুল কাশেমের (কুমিল্লা) নেতৃত্বে কয়েকজন সিনিয়র ইপিআর সদস্য থানা থেকে বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। প্রথমে তারা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। সিও অফিসের নৈশ প্রহরী তৈমুদ্দিনের মাধ্যমে তারা সংবাদ আদান-প্রদান করতেন। ২৫শে সেপ্টম্বর রাত ৯টা ৩০ মিনিটে আবুল কাশেমের (বাঘুটিয়া) নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর ক্যাম্প অভিমুখে ফাঁকা গুলি ছুড়লে ইপিআর সদস্যরাও ফাঁকা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা ক্যাম্প থেকে ৮০টি রাইফেল নিয়ে আসেন।
২৬শে সেপ্টেম্বর নদীপথে একটি দ্বিতল লঞ্চযোগে পাকবাহিনী দৌলতপুর থানায় অনুপ্রবেশ করে। পথে তারা গজঘাটা নামক স্থানে একটি ছোট নৌকায় করে সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার সময় থানার ওসি হামিদ খানকে গ্রেপ্তার করে। পাকসেনারা বিকেলে দৌলতপুর সিও অফিসের ঘাটে অবতরণ করে। এসময় মুসলিম লীগ-এর স্থানীয় নেতা শাহাদত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি দল পাকসেনাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে সিও অফিসে নিয়ে যায়। তখন দৌলতপুর থানার সিও (ডেভলপমেন্ট) ছিলেন মতিয়ার রহমান (টাঙ্গাইল)। ১২৫ সদস্যের পাকসেনাদের দলটি সিও অফিসের টুইন কোয়ার্টার্সে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরের দিন ২৭শে সেপ্টেম্বর টুইন কোয়ার্টার্সের প্রধান ফটকে প্রধান সড়ক অভিমুখে তাক করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র (মেশিনগান, এলএমজি, মর্টার) বসানো হয়। এরপর ৪-৫টি বাংকার খনন করে বালির বস্তা দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করা হয়।
পাকবাহিনী দৌলতপুরে ক্যাম্প স্থাপনের পর ক্যাম্পের প্রধান মেজর বজলুর রহমান স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ও বাঘুটিয়া ইউনিয়নের শাহদত চেয়ারম্যানকে শান্তি কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়। সে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে বৈঠক করে। সেখানে শাহাদত চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিল- ফকির চান (চেয়ারম্যান, ধামশ্বর), শওকত আলী (চেয়ারম্যান, কলিয়া), মাইনুদ্দিন বিএসসি (চেয়ারম্যান, চকমিরপুর), বাহেজউদ্দিন (চেয়ারম্যান, জিয়নপুর), কলিমুদ্দিন (চেয়ারম্যান, খলসী), আব্দুল আজিজ (চেয়ারম্যান, বাচামারা), মোহাম্মদ মহসীন (শিক্ষক, দৌলতপুর) ও তফিজ কমান্ডার (বাচামারা)। শান্তি কমিটির আহ্বায়ক শাহদত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। থানা ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির তত্ত্বাবধানে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকারদের মধ্যে চান্দু মিয়া (চকমিরপুর), মানু মিয়া (চকমিরপুর), আনছার (সমেতপুর), ফজর কানা (ইসলামপুর); ছানু বেপারী (ইসলামপুর), মোসলেম (ভররা), দুর্জন খা (কুমুরিয়া), জলিল কেরানী (চকমিরপুর), পবন (উত্তরপাড়া), পিঞ্জির খা (জিয়নপুর), মকন দফাদার (জিয়নপুর), আক্কাস আলী (সমেতপুর), ফুলচান (সমেতপুর), আসকর শিকদার (রাহাতপুর), সফিজ ঢালী (ফকির পাড়া) প্রমুখ ছিল উল্লেখযোগ্য।
দৌলতপুর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। এ অঞ্চলে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তারা হলেন- নিপেন্দ্র নাথ কুণ্ডু (বিষ্ণুপুর, খলসী), নরেন্দ্র নাথ কুণ্ডু (বিষ্ণপুর, খলসী), নিরেন্দ্র নাথ কুণ্ডু (বিষ্ণুপুর, খলসী), স্বদেশ চন্দ্র বসু (খলসী), দবির উদ্দিন (পুরানপাড়া, বাঘুটিয়া), লাল মিয়া (পুরানপাড়া, বাঘুটিয়া), ডা. হীরালাল সরকার (ভার্তা, বাঘুটিয়া), আব্দুল লতিফ মণ্ডল (গোবিন্দপুর, চরকাটারী), পাঞ্জু মিয়া (নাটুয়াবাড়ি, ধামশ্বর), তেজেন্দ্র নাথ সরকার (টুটিয়াম, কলিয়া), মো. আবুল হাসেম (বাচামারা), মাইনুদ্দিন (পুরানপাড়া, বাঘুটিয়া) প্রমুখ। ২৬শে আগস্ট রাত ২টায় কয়েকটি নৌকাযোগে পাকহানাদার ও তাদের এদেশীয় দালালদের একটি দল কণ্ডুবাড়ি হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা কুণ্ডুবাড়িতে ঢুকে ৪ জনকে বেঁধে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে কালিগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়
পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর কর্তৃক এখানকার যেসব নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন, তাদের র কয়েকজন হলেন— গীতা রাণী সাহা (দৌলতপুর), শেফালী কর্মকার (দৌলতপুর), রাজিয়া বেগম (কৈল, বাচামারা), চেলি ন বেগম (ভররা, খলসী) ও সাগরি বেগম (ভররা, খলসী)। এছাড়া লাউতারা ভৌমিক বাড়ির নারীরাও হানাদার বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হন।
পাকহানাদাররা এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অঞ্চলে বহু ঘর- বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। ৩০শে সেপ্টেম্বর তারা দৌলতপুরের যশোদা লাল বসাক, যতীন্দ্র কর্মকার, গণেশ কর্মকার, ভজগোপাল কর্মকার এবং অবনী বন্ধু ফৌজদারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ২০শে আগস্ট নিখিল চন্দ্র কুণ্ডের བ বাড়ি (বিষ্ণুপুর, খলসী) আগুনে ভস্মীভূত করে দেয়। ১৫ই নভেম্বর তারা গাজিছাইল কলিয়ার দীনেশ চন্দ্র মণ্ডল, ভবেশ চন্দ্র মণ্ডল, সমরেন্দ্র নাথ মণ্ডল, রাজেন্দ্র নাথ মণ্ডল, মহাদেব চন্দ্র মণ্ডল, যুধিষ্ঠির চন্দ্র মণ্ডল, নিস্তা রানী মণ্ডল, নিবারণ মণ্ডল, অশ্বিনী চন্দ্র রায়, রতিকান্ত রায়, মতিলাল রায়, বিনোদ বিহারী রায় এবং গুরুদাস রায়ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
২৫শে আগস্ট পাকহানাদার ও তাদের দোসররা কুণ্ডু বাড়ির মূল্যবান স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা-পয়সা, গুদামে রক্ষিত ধান, সরিষা ও কলাই লুট করে নিয়ে যায়। ক্ষিতীশ চন্দ্র বসুকে (খুলসী) ধরে নিয়ে যাওয়ার পর শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা তার ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। পাকহানাদার বাহিনী, শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা থানা সদরে অবস্থিত যশোদা লাল বসাকের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার, রুপা এবং নগদ টাকা লুণ্ঠন করে।
২০শে সেপ্টেম্বর পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আবুল বাতেনকে ধরার জন্য হেলিকপ্টার নিয়ে বাচামারার চরকাটারীর একটি বাড়িতে অবতরণ করে। সেখান থেকে তারা একটি বড় নৌকা লক্ষ্য করে গুলি করলে লতিফ মণ্ডল (গোবিন্দপুর) নামে একজন নৌকার মাঝি নিহত হয়। অক্টোবরের ৩ তারিখ পাকসেনারা ডাক্তার রিয়াজ উদ্দিনের (দৌলতপুর) বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে না পেয়ে। ভাড়াটিয়া সরকারী কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে (টিসিও) ক্যাম্পে এনে চোখ বেঁধে অকথ্য নির্যাতন চালায়। পরের দিন তারা নাগরপুর ইউনিয়নের ভাদ্রা গ্রামের কফিল উদ্দিনকে ধরে ক্যাম্পে এনে চোখ বেঁধে কয়েক দিন বন্দি রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে। ক্ষিতীশ বসুকে ধরে ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মানিকগঞ্জ মহকুমার টর্চার সেলে রেখে নির্যাতন করে। মে মাসের শেষদিকে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমকে তার বাড়ি থেকে ধরে ক্যাম্পে এনে ৩ দিন যাবৎ তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
দৌলতপুর সিও অফিসের ক্যাম্প-ই ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহযোগিতায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ধরে এনে চোখ বেঁধে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। ক্যাম্পের পশ্চিম দিকের একটি কক্ষ ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এটি পাকবাহিনীর দৌলতপুর থানা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির- হিসেবে পরিচিত।
দৌলতপুর, ঘিওর ও শিবালয় এই তিন থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আওলাদ হোসেন (হরিরামপুর)। তাঁর নেতৃত্বে তিন থানার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন (কাউটিয়া), শমসের আলী (হাতকোড়া) এবং জসীম উদ্দিন (কালিয়া) দৌলতপুর থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মনছুর আলম খান (কাউটিয়া, ঘিওর), শমসের আলী ও গিয়াসউদ্দিন প্রথমে তেরশ্রীতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেন।
দৌলতপুরে খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী বাতেন বাহিনী – নামে পরিচিত। ২৭শে এপ্রিল খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে তাঁর নিজ এলাকা দক্ষিণ টাঙ্গাইলের কনোড়া গ্রামে এ বাহিনী গঠিত হয়। এদিনই তিনি ঘিওর থানা ও দৌলতপুর থানা অপারেশন করেন। দক্ষিণ টাঙ্গাইল এবং দৌলতপুরসহ কয়েকটি থানায় বাতেন বাহিনীর তৎপরতা ছিল এ বাহিনীতে ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
১৭ই ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে কাকণা গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। কাকণার যুদ্ধ-এ পাকসেনারা পিছু হটে তেরশ্রী বাজারে আশ্রয় নেয় এবং ৮০টি রাইফেল কাকণা খালে ফেলে যায়। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নিরালীতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। নিরালী যুদ্ধ-এ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। নাটুয়াবাড়ির পাঞ্জু মিয়া এবং অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১২ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানের আক্রমণে জামালপুর ও শেরপুরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলে ১৫০ জন পাকসেনার একটি দল ঢাকার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা হয়। ১৪ই ডিসেম্বর তারা দৌলতপুর থানা সদরের ওপর দিয়ে নিলুয়া গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছলে তেরশ্রী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা পেছন থেকে তাদের লক্ষ করে গুলি চালান। পাকসেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে পাকসেনারা মানিকগঞ্জে চলে যায়। ~নিলুয়ার যুদ্ধ-এ ২ জন পাকসেনা আহত হয়। মানিকগঞ্জ থেকে পাকসেনারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে বাঘুটিয়ায় ইন্তাজ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে পাকসেনারা যমুনা পার হয়ে কাজীর হাটের (পাবনা) দিকে চলে যায়। ১৪ই ডিসেম্বর সংঘটিত বাঘুটিয়ার যুদ্ধ-এ কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ১৫ই ডিসেম্বর দৌলতপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
দৌলতপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ফজলুল হক (চরকাটারী), সিপাহী সাইদুর রহমান (কৈল, বাচামারা), আব্দুল হামিদ (লাউতারা, জিয়নপুর), হাবিবুর রহমান (রামচন্দ্রপুর, চকমিরপুর), শামছুল হক (রামচন্দ্রপুর, চকমিরপুর), আব্দুল বাতেন (আগকলিয়া, কলিয়া), আফাজ উদ্দিন (রঘুঘোষ, ধামশ্বর), সিপাহি আব্দুর রহমান (কাপশাইল, ধামশ্বর), নায়েক কাজী ইমদাদুল হক (ঘড়িয়ালা, ধামশ্বর), সোবহান (কাপশাইল, ধামশ্বর) ও পাঞ্জু মিয়া (নাটুয়াবাড়ি)।
“
২০০৮ সালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের প্রধান ফটকে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। [মো. আমিনুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড