You dont have javascript enabled! Please enable it! দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি - সংগ্রামের নোটবুক

দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি

দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের দুরবস্থার প্রতি নীতিনির্ধারক ও বিশ্বমানবতার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সাহায্য প্রার্থনা করে বিভিন্ন দেশের ৬০ জন বরেণ্য ব্যক্তির একটি প্রচারপত্র। এটি অক্সফাম-এর পরিচালক এইচ লেসলি কাকলে সিবিই কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২১শে অক্টোবর অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত। উল্লিখিত ৬০ জনের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সাহায্য সংস্থা (অক্সফাম, ওয়ার অব ওয়ান্ট, সেইভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড, কেয়ার, কারিটাস ইত্যাদি), খ্রিস্টান মিশনারি (যেমন দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি, নরওয়েজিয়ান চার্চ রিলিফ, ক্যাথলিক চার্চ, মেথডিস্ট মিশনারি, ড্যানিশ চার্চ এইড, চার্চ মিশনারি সোসাইটি), সিনেট, পার্লামেন্ট, পত্রিকা (দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য সানডে টাইম্স, ফাইন্যান্সিয়াল টাইম্স, টরোন্টো টেলিগ্রাম ইত্যাদি), ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (~বিবিসি-, আইটিএন নিউজ, কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোশেন), গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন ইত্যাদির প্রতিনিধিবর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, মাদার তেরেসা, জন স্টোন হাউস (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য), ব্রুচ ডগলাস-ম্যান (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য), বার্নাড ব্রেইন (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য), এইচ লেসলি কার্কলে (পরিচালক, অক্সফাম), ডেভিড লোশাক (ডেইলি টেলিগ্রাফ), এন্থনি মাসকারেনহাস (সাংবাদিক), ক্লায়ার হলিংওয়ার্থ (ডেইলি টেলিগ্রাফ), এলান হার্ট (বিবিসি প্যানোরমা) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও ভারতে ১ কোটি বাঙালির শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়গ্রহণ ছিল বিশ্বমানবতার জন্য এক বড় সংকট। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় প্রথম কয়েক মাস এ সংকটের গভীরতা সম্বন্ধে তেমন ওয়াকেবহাল ছিল না। বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ যার-যার জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখে আসছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তান সরকারকে সহায়তা-সমর্থন করে। পাকিস্তানের সহায়তা নিয়ে চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক স্থাপন ছিল সে সময়ে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের অগ্রাধিকার। অপরদিকে ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনেক পূর্ব থেকে। অন্যতম পরাশক্তি সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রথম দিকে বাংলাদেশ প্রশ্নে সতর্ক অবস্থানে ছিল। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের পাকিস্তানের প্রতি প্রায় অভিন্ন সমর্থন ছিল। সাধারণভাবে নিজস্ব স্বার্থেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষ নেয়। তাই বাংলাদেশ সংকট পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ -পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ বক্তব্য একটা সময় পর্যন্ত বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়।
এমনি অবস্থায় ভারতে স্রোতের মতো প্রতিদিন সাধারণ বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ ও আশ্রয়গ্রহণ, জুন-জুলাই মাসে একদিকে বন্যা-বৃষ্টি, অপরদিকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে মহামারী আকারে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব, শিশু-বৃদ্ধ ও নারীসহ হাজার-হাজার শরণার্থীর ডায়রিয়ায় মৃত্যু, ভারত সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ঔষধের সংকট, এক কথায় শরণার্থীদের মানবেতর জীবন, সেনা-দখলাধীন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশংকা ইত্যাদি ‘টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ প্রকাশে উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করে। শুরু থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ বাংলাদেশ সংকট, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও শরণার্থীদের দুরবস্থা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন সত্য, কিন্তু সংকটের পরিধি বা মাত্রা বিবেচনায় তা যথেষ্ট ছিল না। শরণার্থী শিবিরসমূহে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ও হাজার-হাজার মানুষের মৃত্যু বিশ্বগণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে স্থান পায়।
টেস্টিমনি অব সিক্সটি ছিল বাংলাদেশ সংকটের প্রতি বিশ্বমানবতাকে জাগিয়ে তোলার এক প্রচেষ্টা। এর মূল বক্তব্য ছিল: মানবতা আজ চরমভাবে বিপন্ন, বাংলাদেশ সংকট আর পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ নয়, শরণার্থী সমস্যা ভারতের একার নয়, এটি সমগ্র বিশ্বমানবতার সমস্যা, বিশ্বসম্প্রদায় কিছুতেই নীরব থাকতে পারে না, তাদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে এবং তা এখনই, শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী, ঔষধ ইত্যাদি প্রেরণ করে ত্রাণ তৎপরতা বৃদ্ধি, সংকটের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান, যাতে শরণার্থীরা নির্ভয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারে, ইত্যাদি।
উল্লিখিত আবেদনসহ টেস্টিমনি অব সিক্সটি প্রকাশের পর তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল সিনেটর ও নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি, ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স সদস্য, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সকল সদস্য, নীতিনির্ধারক, সাহায্য সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম প্রতিনিধি প্রমুখের মধ্যে বিতরণ করা হয়। নীতিনির্ধারকদের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং গণমাধ্যমে বহুল প্রচারসহ অন্যান্য উপায়ে বাংলাদেশ সংকটের প্রতি বিশ্বমানবতা জাগ্রত করার মাধ্যমে এ প্রচারপত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: Oxfam, Testimony of Sixty, Oxford 1971; Harun-or- Rashid, ‘British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4 (2), 139-149; The Guardian (London), 8 October 1971; Ibid, 8 December 1971

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড