You dont have javascript enabled! Please enable it!

দোহাজারী যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম)

দোহাজারী যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী ব্রিজের কাছে সংঘটিত এ-যুদ্ধে ১৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এখানে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়।
১২ই ডিসেম্বর সকালে দোহাজারী যুদ্ধের সূচনা ঘটে। ভারতের দেমাগ্রী থেকে হেলিকপ্টারে করে ১১ই ডিসেম্বর কয়েক দফায় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা বান্দরবানের হলুদিয়া এলাকায় অবতরণ করেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন একজন ভারতীয় কমান্ডার। তাঁর সঙ্গে ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন কর্ণফুলী পেপার মিলের ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক আহমদ। ক্যাম্প গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন মেজর নেইগি। এছাড়া একজন বাঙালি সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। গাইড হিসেবে ছিলেন আবদুর গফুর (পিতা আবদুর রহমান, খরনা, পটিয়া)-সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন আবু সালেহ এমএনএ।
মিত্রবাহিনী হলুদিয়ায় অবতরণের পর একদল সৈন্যকে স্থানীয় এলাকায় টহলে পাঠানো হয়। গাইডসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে দোহাজারী ব্রিজ রেকি করার জন্য প্রেরণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বান্দরবান সড়ক ধরে হলুদিয়ায় ফিরে যাওয়ার সময় ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করে পরাজিত করেন। এখান থেকে তাঁরা ১৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল উদ্ধার করেন। এসব রাইফেল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হলুদিয়ায় ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে প্রাথমিক টহলে প্রেরিত মিত্রবাহিনীর সদস্যরা হলুদিয়ায় ফিরে এসে শুভলং পর্যন্ত পথের বিবরণ দেন। ভারতীয় কমান্ডার এ বিবরণ এবং দোহাজারী ব্রিজ রেকি করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিবেচনা করে রাতে দোহাজারীর দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১২ই ডিসেম্বর সকাল ৭টায় শঙ্খ নদের উত্তর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পূর্বে তৈরি করা বাংকারগুলোতে অবস্থান নেয়। পরদিন সকাল ৮টার দিকে ভারতীয় কমান্ডারের নির্দেশে মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ফায়ার ওপেন করে। পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা ফায়ার করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এ-যুদ্ধের খবর পেয়ে আবদুল গফুর গ্রুপের সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং আবদুল জলিল বকসু ও মীর আহমদ চৌধুরী গ্রুপের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। তাঁদের অংশগ্রহণের ফলে মিত্রবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং যুদ্ধ ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিতে থাকে। এভাবে একদিন ও এক রাত অতিবাহিত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর একজন অফিসার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাহায্যে মাঝির বেশে নৌকায় করে শঙ্খ নদের উত্তর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ড পোস্টের নিকট পৌঁছে সেখানকার এক দোকান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পজিশন চিহ্নিত করে সংকেত প্রেরণ করেন। দুপুরের দিকে গ্রুপ কমান্ডার আবদুল গফুর মাইকে পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানান। তিনি এলাকাবাসীকে এক মাইল দূরে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। এরপর মিত্রবাহিনী মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করলে পাকিস্তানি সেনারা পলায়ন করতে থাকে। তাদের পলায়ন শেষে দুপুর ২টার দিকে দোহাজারী ব্রিজের দুপাশে দাঁড়িয়ে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা আকাশের দিকে বিজয়ের গুলি ছোড়েন। গ্রুপ কমান্ডার আবদুল গফুর বিজয়ের পতাকা তোলেন। এ-যুদ্ধে ১৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগদানকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ১১৭ নম্বর গ্রুপের আবদুল গফুর (পিতা আহমদ কবির, হাছনদণ্ডি, সাতবাড়িয়া, চন্দনাইশ; গ্রুপ কমান্ডার), শ্যামাচরণ নাথ (কলাউজান, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম), ব্রজেন্দ্র লাল দেবনাথ (পিতা রামানন্দ দেবনাথ, কলাউজান, লোহাগাড়া), দিলীপ কুমার চন্দ (সাতকানিয়া), নীল রতন দাশগুপ্ত (চরতি, সাতকানিয়া), ওবাইদুর রহমান (পিতা মনির আহমদ, উত্তর কাঞ্চনা, সাতকানিয়া), দীনবন্ধু দেবনাথ (মুলুক চোবান, আমিরাবাদ, লোহাগাড়া), জামাল (মিরসরাই), নিজাম (মিরসরাই), জাহেদ আহমদ (মিরসরাই), মনমোহন নাথ (কলাউজান, লোহাগাড়া), সুধীর দাশ (নলুয়া, সাতকানিয়া), তেজেন্দ্ৰ নাথ (লোহাগাড়া), অরুণ (তকানিয়া), সিদ্দিক আহমদ (চকরিয়া, কক্সবাজার), নুর আহমদ, সিরাজ, নুরুল হক (কাটগড়, কালিয়াইশ, সাতকানিয়া) ও আবদুল হাকিম (কলাউজান, লোহাগাড়া); ১৫৩ নম্বর গ্রুপের আবদুল জলিল বকসু (কালিয়াইশ, সাতকানিয়া; গ্রুপ কমান্ডার), আনু মিয়া, মো. আবুল হোসেন, অজিত মজুমদার, বাবুল কান্তি মজুমদার, অরুণ কান্তি মজুমদার, রামধন নাথ, রায় গোপাল দাস, অনিল দাশ, বাবুল কান্তি দত্ত, রাখাল কৃষ্ণ দত্ত, বিধুর চন্দ্র দাস, নির্মল কান্তি দাস, বসন্ত দাস, নেপাল কান্তি দাস, নারায়ণ দাস, মেঘনাথ পাল, মিলন চক্রবর্তী, পরিমল কান্তি দাস ও নিরঞ্জন বিহারী নাথ; মীর আহমদ চৌধুরী গ্রুপের ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম আজাদ (পিতা আহমদ হোসেন, হারলা, চন্দনাইশ), মোহাম্মদ ইউছুপ ওরফে ইঞ্চিয়া (পিতা খুইল্যা মিয়া, পশ্চিম হারলা, চন্দনাইশ), আবদুল আলিম (পিতা ওবাইদুর রহমান, চন্দনাইশ), হাবিলদার আছহাব মিয়া (পিতা মতিউর রহমান, মধ্যম চন্দনাইশ), জমির উদ্দিন (পিতা রাজা মিয়া, পূর্ব জোয়ারা, চন্দনাইশ), মোহাম্মদ সোলাইমান (পিতা মো. ইছহাক, হারলা, চন্দনাইশ), ফোরক আহমদ (পিতা আবদুর রশিদ, দক্ষিণ জোয়ারা, চন্দনাইশ), শিব্বির আহমদ (পিতা সিরাজুল ইসলাম, হারলা, চন্দনাইশ), সামসুদ্দীন আহমদ (পিতা হোসেন আলী, হাশিমপুর, চন্দনাইশ) ও অনিল বড়ুয়া (শীলঘাটা, সাতকানিয়া)। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!