You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দোহার উপজেলা (ঢাকা)

দোহার উপজেলা (ঢাকা) ঢাকা জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত। এর উত্তরে নবাবগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে পদ্মা নদী ও নদীর অপর পাড়ে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলা, পূর্বে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলা ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ এবং পশ্চিমে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা, পদ্মা নদী ও ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলা। দোহার উপজেলা ৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত।
৭০-এর নির্বাচনে দোহার-নবাবগঞ্জ থেকে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর আশরাফ আলী চৌধুরী এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রফি উদ্দিন আহমেদ জয়লাভ করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ফলে সমগ্র দেশের ন্যায় দোহার উপজেলার মানুষও প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ শুনতে ছাত্র, যুবক, আবাল-বৃদ্ধ ঢাকায় আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন- দোহার থানার আসাদুজ্জামান খান কামাল, আব্দুল মান্নান খান, আব্দুর রউফ মোল্লা, তোতা গাজী, কাজী ফিরোজ, বোরহান ডাক্তার, আলাউদ্দীন, সোহরাবউদ্দীন, শাহজাহান বিশ্বাস, ওহিদুল ইসলাম ওনু, নজরুল ইসলাম বাবুল, রুহুল আমীন খোন্দকার, আমজাদ হোসেন খান, হারুনুর রশীদ, ছাত্রনেতা এডভোকেট সাইফুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রাজ্জাক (শিমুলিয়া), খায়রুল আলম (সুতারপাড়া), মো. আ. রফিক আক্কাস (মালীকান্দা নিকোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র), নূর মোহাম্মদ, মো. বায়েজীদ মীর, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, আব্দুল মান্নান, ফজলুর রহমান, আব্দুল মোতালেব, আব্দুস সালাম, মোহাম্মদ এমারত হোসেন, আব্দুল গফুর চোকদার, আব্দুল মোমেন, সফিউদ্দিন বাবু প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে দোহার থানার ছাত্র-যুবকরা পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতনের খবর শুনে দোহার থানার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃবৃন্দ, দোহার- নবাবগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্যবৃন্দ, ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নবাবগঞ্জের আবু মোহাম্মদ সুবেদ আলী টিপু এমপি, দোহার থানার রাইপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজউদ্দীন আহমেদ (সিরাজ মিয়া), নবাবগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান ওরফে সিদ্দিক মাস্টার, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ডা. আবুল কালাম, ডা. আব্দুল আউয়াল, টিএন্ডটি কর্মচারী আলতাফ হোসেন হীরা, জয়পাড়ার ন্যাপ নেতা আব্দুল হাই, ছাত্রনেতা আব্দুল মান্নান খান, আব্দুর রউফ মোল্লা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাইদুর রহমান, গাজী আলী ইমাম, আকসার আলী, বায়েজীদ মীর, রুহুল আমীন খোন্দকার, বাশার মির্জা, ফজলুর রহমান (সোনা মিয়া) প্রমুখ স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে উপজেলার দোহার প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, নটাখোলা কুমার বাড়ির পেছনের খালি জায়গা, নটাখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ, নারিশা ইউনিয়নের নারিশা খালপাড় মাঠ, নারিশা স্কুল, মোকসেদপুর স্কুল, লক্ষ্মীপ্রসাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পানাঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাইপাড়া ইউনিয়নের পাটক্ষেত ও ধনিচা ক্ষেতে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। ২৬শে মার্চের পর থেকে এসব ক্যাম্পে কাটা রাইফেল, বাঁশের তৈরি ডামি রাইফেল ও স্থানীয় বন্দুক দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিমানবাহিনীর সদস্য মজিবর রহমান, ইপিআর সদস্য পেতা (ডাক নাম) প্রমুখ প্রশিক্ষক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
৪ঠা এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে ২নং সেক্টরের দোহার- নবাবগঞ্জ-মানিকগঞ্জের হরিরামপুর-ঘিওর থানার এরিয়া কমান্ডারের ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরী মটর সাইকেলযোগে দোহার-নবাবগঞ্জ থানার পদ্মার পাড়ে আসেন। কায়েদে আজম কলেজ (বর্তমান তিতুমীর কলেজ)- এর ছাত্র মোহাম্মদ রজ্জব আলী মোল্লার সঙ্গে তাঁর পদ্মার পাড়ে সাক্ষাৎ হয়। পরের দিন ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরী স্থানীয় দারোগা বাড়িতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাইদুর রহমান খোকা, ফেরদৌস মিয়া, নিলু সাজ্জাদ, বাবুল, মনির, নারিশার কায়েদে আজম কলেজের আইএর ছাত্র মোহাম্মদ রজ্জব আলী মোল্লা, আওয়ামী লীগের সংগঠক ডা. আবুল কালাম প্রমুখের সঙ্গে সভা করেন। ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরী রাইফেলের একটি গুলির খোসা তাদের হাতে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।
পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয় শতাধিক যুবক ভারতে চলে যান। তাঁদের মধ্যে জয়পাড়ার দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি বোরহানউদ্দিন খান, রাইপাড়া ইউনিয়নের রাইপাড়া গ্রামের সোহরাব উদ্দিন, মজিদ, শিমুলিয়ার আকরাম হোসেন, সুতারপাড়া ইউনিয়নের মধুরচর-সুতারপাড়া গ্রামের মো. আ. রফিক আক্কাস, মো. বায়েজীদ মীর, রুহুল আমীন খোন্দকার, আমজাদ হোসেন খান, শফিউদ্দীন বাবু, আব্দুল মান্নান, মফিজুল ইসলাম মজনু, নূর মোহাম্মদ, খায়রুল আলম, মো. ইউনূস মোল্লা (সুতারপাড়া), সুজাহার খান, মো. লিয়াকত, আব্দুল খালেক, আব্দুল জলিল, দোহারের মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, জয়পাড়ার আব্দুল মান্নান খান (পরবর্তীতে গণপূর্ত মন্ত্রী), হাওলাদার আলাউদ্দীন, বোরহান ডাক্তার, শম্ভুনাথ চক্রবর্তী, হযরত আলী, ফজলু মেম্বার প্রমুখ উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পালামগঞ্জ পোদ্দার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল।
২৬শে মার্চ থেকে ঢাকা, ফরিদপুর, যশোরসহ দক্ষিণ দিকের অনেক মানুষ পায়ে হেঁটে দোহার এলাকায় আসতে থাকে। উপজেলার অনেকে দোহারের নিজ গ্রামে আসার পথে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হন। এলাকার জনগণ ছাত্র-যুবক তথা সর্বস্তরের মানুষের সহায়তায় দোহার থানায় লঙ্গরখানা খুলে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত মানুষদের থাকা-খাওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ কাজে চেয়ারম্যান কাজী আফতাব উদ্দীন ও কাটাখালী গ্রামের রাইস মিলের মালিক হাতেম মিস্ত্রি সহায়তা দেন। মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দোহার উপজেলার শিলাকোঠা গ্রামে শ্রমিক লীগ নেতা শুকুরের বাড়িতে একরাত অবস্থান করে ভারত চলে যান৷
দোহার থানায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন সেনাসদস্য হাবিলদার সাইদুর রহমান (চরভদ্রাসন, ফরিদপুর)। ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. আইউব আলী (পিতা মো. সদর আলী বেপারী, নটাখোলা, রাইপাড়া)।
আলাউদ্দীন হাওলাদার (জামালচর), বায়েজীদ মীর (পিতা সিরাজুল হক মীর, মধুরচর, সুতারপাড়া; জগন্নাথ কলেজের ছাত্র), রুহুল আমীন খোন্দকার (পিতা বেলায়েত আলী খোন্দকার, দোহার, সুতারপাড়া), বাশার মৃধা (পিতা ইউসুফ মৃধা, দোহার, সুতারপাড়া), সুতারপাড়া ইউনিয়নের দোহার গ্রামের গাজী ফজলুর রহমান ওরফে সোনা মিয়া (পিতা রমিজ গাজী, দোহার, সুতারপাড়া) ও বিমানবাহিনীর সদস্য মজিবর রহমান (পিতা মাদবর খান, মালীকান্দা) গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
দোহার উপজেলায় রাইপাড়া ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজউদ্দীন আহমেদ (সিরাজ মিয়া), নারিশা ইউনিয়নের নারিশা গ্রামের প্যরামেডিক চিকিৎসক ডা. আবুল কালাম, রাইপাড়া ইউনিয়নের জয়পাড়া গ্রামের আনসার আলীর পুত্র আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আক্কেল আলী, মোকসেদপুর ইউনিয়নের শাইনপুকুর গ্রামের আসাদুজ্জামান খান কামাল, রাইপাড়া ইউনিয়নের ইকরাশি গ্রামের প্যারামেডিক চিকিৎসক ডা. আব্দুল আউয়াল, সুতারপাড়া ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল মান্নান খান, রাইপাড়া ইউনিয়নের জয়পাড়া গ্রামের ছাত্র আব্দুল রউফ মোল্লা, মোহাম্মদ রজ্জব আলী মোল্লা এবং মোকসেদপুর ইউনিয়নের শাইনপুকুর গ্রামের সাঈদ খোকা, প্রমুখ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু ও এর পরপর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর দোহার উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা করম আলী, শম্ভুনাথ চক্রবর্তী, হযরত আলী প্রমুখ দোহার থানার চারদিকে বাংকার স্থাপন করে হানাদারদের অনুপ্রবেশে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৩ই আগস্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা পদ্মা নদী দিয়ে লঞ্চযোগে দোহার থানার জয়পাড়ার দিকে এগুতে থাকে। নাব্য সংকটের কারণে তারা ছোট-ছোট ছিপ নৌকায় ৪-৫ জন করে জয়পাড়ায় আসে। স্থানীয় লোকজন যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য তারা সেনাবাহিনীর পোশাক পরিবর্তন করে গেঞ্জি ও মাথায় টুপি দিয়ে বাজারের দিকে এগুতে থাকে। সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা এলএমজি বের করে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সেদিন হাটবার থাকায় বাজারে প্রবেশ করে ২০০ থেকে ৩০০ জনকে লাঠি ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। মুক্তিযোদ্ধা শম্ভুনাথ চক্রবর্তী, সেনাসদস্য হযরত আলী, বোরহানউদ্দীন ডাক্তার, সোহরাব প্রমুখ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা গুলি চালান। পাকিস্তানি বাহিনী বাজার থেকে দোহার থানায় চলে যায় পরের দিন ১৪ই আগস্ট সকালবেলা ঢাকা থেকে স্টিমারে করে মাথায় টুপি ও সাধারণ পোশাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পদ্মা নদী দিয়ে জয়পাড়ার দক্ষিণে এসে থামে। তারপর কয়েকটি ছিপ নৌকায় চড়ে দোহার থানার দিকে আসতে থাকে। নটাখোলা নতুন বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বহনকারী নৌকা লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির জবাবে ব্রাশফায়ার করে। পাকিস্তানিদের ব্রাশফায়ারে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী জয়পাড়া বাজারে ঢুকে দোকানপাটে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা লঞ্চে চড়ে এলাকা ত্যাগ করে।
আগস্ট মাসে ৫০ থেকে ৬০ জন পাকিস্তানি সৈন্য পুনরায় লঞ্চযোগে দোহার থানার মোড় জয়পাড়া শশ্মানঘাটে আসে। সেখান থেকে তারা থানার বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ চালায় এবং বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করে। ঐদিন তারা ফিরে যায়। আগস্ট মাসের শেষদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা দোহার থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। দোহার থানার বিপরীতে ছিল পরেশ কর্মকারের (আধারি কর্মকার) বাড়ি। তারা দোহার থানা ও পরেশ কর্মকারের বাড়ির সামনের অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ক্যাম্পের আকার বৃদ্ধি করে। প্রতিরক্ষার জন্য তারা দোহার থানার মাঠে বাংকার স্থাপন করে। এছাড়া তারা জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে।
দোহার উপজেলায় এপ্রিল মাসের শেষদিকে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। উপজেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল জয়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম মিয়া (বর্তমান মেয়র)। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আব্দুর রব্বানী, সামাদ মোল্লা, জয়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক প্রেসিডেন্ট পবন বেপারী, ব্যবসায়ী আব্দুল বারেক চৌধুরী, রসুলপুর গ্রামের আলী মাতবর, হাইত আলী মুন্সী, রাইপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মুজাহার আলী বেপারী প্রমুখ।
শান্তি কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় উপজেলায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। সুতারপাড়ার রমিজ মৌলভী (মুন্সিনগর নবাবগঞ্জ থানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), নারিশা ইউনিয়নের মালিকান্দার আমিনউদ্দীন মৌলভী, রমিজ মৌলভীর পুত্র সিরাজ, সুতারপাড়া ইউনিয়নের মধুরচরের কেনাই মোল্লার ৪ পুত্র কালা মোল্লা, হোসেন মোল্লা, রমজান আলী মোল্লা ও আজিজ মোল্লা, মালিকান্দার হাবিবুর রহমান, মধুরচরের সোনা মিয়া, মালিকান্দা-মধুরচরের আব্দুল করিম, নারিশা ইউনিয়নের রানীপুরের সোহরাব (রিকশা চালক), রজব আলী পাইলট প্রমুখ ছিল কুখ্যাত রাজাকার। শান্তি কমিটির সদস্য এবং রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাত। তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাড়িঘর হানাদারদের দেখিয়ে দিত। তাদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। লোকজনের গরু-ছাগল ধরে নিয়ে খেত। এপ্রিলের শেষদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় জয়পাড়া-নটাখোলা এলাকার হিন্দু বাড়িতে লুটতরাজ চালায়। রাজাকার তাঁতী ওহাদ আলী এবং তার পুত্র মজিদ, আব্দুল বারেক চৌধুরী প্রমুখ জয়পাড়ার পরেশ কর্মকার (আধারি কর্মকার) ও মন্টু সাহার বাড়িতে লুণ্ঠন শেষে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা রেডিওতে ‘জয় বাংলা’র অনুষ্ঠান শোনার জন্য পরেশ কর্মকারকে ধরে থানায় নিয়ে নির্যাতন করে।
শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৪ই আগস্ট সকালে দোহার থানা থেকে জয়পাড়া গ্রামে ঢুকে জয়পাড়া বাজার আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজউদ্দীন আহমেদ (সিরাজ মিয়া) ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আক্কেল আলীর বাড়ি, থানার দক্ষিণে সৈয়দ মাস্টারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
পাকিস্তানি বাহিনী দোহার থানা থেকে নারিশা গ্রামে প্রবেশ করে। সেখানে বসাক পাড়ায় ঢুকে মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। তারা ধোপা বাড়ির মাঠের পূর্বপাশের বাড়িতে নারীনির্যাতন করে। নকুল দাসের মেয়ের জামাই সুরেশ চন্দ্র কর্মকারকে (পিতা ক্ষেত্রমোহন কর্মকার; শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন পাকিস্তানি স্যৈনারা ধরে দুমাইল দূরে নিয়ে হত্যা করে। তারা বটিয়াতে জহির চেয়ারম্যানের বাড়িতে কর্মরত দুজনকে হত্যা করে। জয়পাড়ার সাহাপাড়ার টগর কুমার সাহা গ্রামে-গ্রামে ঘুরে চাল বিক্রি করতেন। আগস্ট মাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা হাসপাতাল রোডে জয়পাড়া গ্রামের বিশ্বনাথ শীলের ছেলে শ্যামলাল শীল ও শ্যামলাল শীলের ছেলে ফুলচান শীল, অশ্বিনী কুমার সাহা, ব্যবসায়ী মতিলাল সরকার, নুরপুর গ্রামের আ. কাদের, দক্ষিণ জয়পাড়ার ঋষিপাড়ার মুচি কেতু মনি (পিতা কানাই লাল মনি), উত্তর জয়পাড়ার সাববাজারের হায়াত আলী, চরলটাখোলা গ্রামের কৃষক বাদশা শেখ (পিতা বাদল্লা মাদবর)-কে গুলি করে হত্যা করে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিত আক্রমণ ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধারা রাইপাড়া ইউনিয়নের নাগেরকান্দা গ্রামের লটাখোলা বাঁশতলায় মাইন পুঁতে রাখেন।
দোহার থানা ক্যাম্প পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে যুবকদের ধরে এনে নির্যাতনের পর থানার সামনের খোলা প্রাঙ্গণে দু-একদিন পরপর ২০ থেকে ২৫ জনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা . হতো। তারা জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস (ছমিলা স্মৃতিভবন)-এ মালতী ভৌমিকসহ অসংখ্য মেয়েদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে দোহার থানার খোলা প্রাঙ্গণ ছিল হানাদার বাহিনীর বধ্যভূমি। তারা থানার পেছনের খালি জায়গায় গর্ত করে মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দিত। এখানে গণকবর রয়েছে। এছাড়া জয়পাড়া পাইলট হাইস্কুলের পেছনে গণকবর রয়েছে।
পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১২ই সেপ্টেম্বর রাইপাড়া ইউনিয়নের কাচারীঘাট বাজারের উত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা ইকরাশি যুদ্ধ- নামে পরিচিত। ১৩ই সেপ্টেম্বর সকাল সাতটার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পালামগঞ্জ পোদ্দার বাড়ি ক্যাম্পে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২৮শে নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দোহার থানায় যুদ্ধ হয়। দোহার থানা যুদ্ধ-এ কমান্ডার হাবিলদার সাইদুর রহমান, আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজউদ্দীন আহমেদ (সিরাজ মিয়া), ডা. আবুল কালাম প্রমুখ নেতৃত্ব দেন। ২৯শে নভেম্বর ভোররাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল মার্চ করে দোহার থানা থেকে নারিশা গোডাউন ঘাটে যায়। গোডাউন ঘাটে পৌছামাত্রই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। এদিনই দোহার উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. গোলাম মোস্তফা, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক- (পিতা গোলাম মো. ফালু শেখ, ঝনকি) ও হাসান উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক (পিতা মেহের উদ্দিন আহমেদ, চর কুশাই)।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সেনাসদস্য বদিউজ্জামান (পিতা ওয়াজউদ্দীন, দোহার), মাহফুজুর রহমান (পিতা জিয়াউল হক, নারিশা-মোকসেদপুর; বাগরা শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস; মানিকগঞ্জের হরিরামপুর যুদ্ধে শহীদ), হায়াত আলী (জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী; জয়পাড়ায় মামার বাড়িতে অবস্থান করে পড়াশুনা করতেন; পোদ্দার বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থানকালে ক্যাম্প থেকে মামার বাড়ি যান, সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে), নায়েক কাশেম আলী সিকদার (পিতা কপিলউদ্দিন সিকদার, আরিতা, কুসুমহাটি, হাসনাবাদ), সেনাসদস্য আবু তাহের (পিতা রফিক খোন্দকার, সুতারপাড়া), জুরাল খান (পিতা আ. লতিফ খান, কাটাখালী, জয়পাড়া), কালু মৃধা (পিতা গণি মৃধা, মোকসেদপুর), ইপিআর সদস্য মোবারক আলী খান (পিতা রমজান খান, শিমুলিয়া, নারিশা), ইপিআর সদস্য আব্দুল মজিদ (পিতা আব্দুল আজিজ, উত্তর শিমুলিয়া, নারিশা), সেনাসদস্য সাহাবউদ্দিন (পিতা ওয়াসিরউদ্দিন, চরকুশাই কুসুমআঁটি), পুলিশ সদস্য কবিরউদ্দিন আহম্মদ (পিতা হানিফ সরকার, ছয়পাড়া), পুলিশ সদস্য মো. মুদাচ্ছের আলী (পিতা পাষাণ আকন, মোকসেদপুর) ও পুলিশ সদস্য আবুল বাসার (পিতা ওসমান ফকির, দোহার সদর)।
উপজেলার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. গোলাম মোস্তফা (পিতা গোলাম মোহাম্মদ, ঝনকী, নারিশা), তোতা মিয়া (পিতা দিলবর বেপারী, ডাইয়ারকুম) প্রমুখ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য দোহার উপজেলার হাবিলদার মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা (পিতা গোলাম মোহাম্মদ, ঝনকী, নারিশা)-কে ‘বীর বিক্রম’ ও ‘বীর প্রতীক’ এবং সেনাসদস্য হাসানউদ্দীন আহমেদ (পিতা নেসারউদ্দীন আহমেদ, চরকুশাইল, কুসুমআঁটি)-কে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিত আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা রাইপাড়া ইউনিয়নের নাগেরকান্দা গ্রামের লটাখোলা বাঁশতলায় মাইন পুঁতে রাখেন। লটাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সুনামউদ্দীন খানের পুত্র হিম্মেচ মাছ ধরার জন্য বাঁশের কঞ্চি কাটতে সেখানে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদত বরণ করেন। শহীদ হিম্মেচ-এর নামে নাগেরকান্দা গ্রামে সড়কের পাশে “শহীদ হিম্মেচ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়েছে। জয়পাড়া হাইস্কুল রোডের চৌরাস্তায় ‘রতন চত্বর’ নামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে পতাকা হাতে একজন যোদ্ধা এবং অস্ত্রহাতে অপর একজন যোদ্ধার প্রতিকৃতি রয়েছে। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!