বীর প্রতীক দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী
দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (১৯৪৬- ২০০৯) ইপিআর নায়েক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৬ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সিংহেরগাঁও ইউনিয়নের হুগলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ওয়াজেদ আলী পাটোয়ারী, মাতার নাম ছায়েরা খাতুন। ৫ ভাই এবং ৪ বোনের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী ছিলেন সবার বড়।
দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপর ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে ঢাকার পিলখানায় ইপিআর বাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি চট্টগ্রাম সেক্টরের অধীনে ১১নং উইংয়ের হালিশহর হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত ছিলেন। দেশের রাজনীতি এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের শোষণ-বঞ্চনা সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং হালিশহর, পাহাড়তলী, কালুরঘাট প্রভৃতি এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেকক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। কালুরঘাটের পতন হলে তিনি ভারতে চলে যান। সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১নং সেক্টরে কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের অধীনে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ‘জেড’ ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হন। জেড ফোর্সের সৈনিক হিসেবে তিনি নকশী বিওপি, রংপুরের চিলমারী, উলিপুর, জামালপুরের কোদালকাঠী, হবিগঞ্জের দক্ষিণ গুল চা বাগান, সোনারূপা চা বাগান, ভানুগাছসহ কয়েকটি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এর মধ্যে ভানুগাছের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বৃহত্তর সিলেট জেলা মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে অভিযান শুরু করেন। এক দল (অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ভারতের কৈলাশ শহর থেকে মৌলভীবাজারের শমশেরনগর হয়ে সিলেটের দিকে এগুতে থাকে। এ দলে ছিলেন দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী। তাঁদের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এ জে এম আমিনুল হক, বীর উত্তম- (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)। পথে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা ছিল। ১লা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আলীনগর চা বাগানে (শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার) হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুপক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা প্রচ- যুদ্ধ হয়। এতে পাকিস্তানিরা বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে ভানুগাছে আশ্রয় নেয়। দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারীসহ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুসরণ করে ভানুগাছে উপস্থিত হন। এখানে আগে থেকেই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। সিলেট দখলের জন্য ভানুগাছ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে উচ্ছেদ করা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৬ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা ভানুগাছে আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে এখানে সারা দিন যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা মরিয়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। দেলোয়ার হোসেনসহ মুক্তিযোদ্ধারা এতে বিচলিত না হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান। ভানুগাছে দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পরদিন পালিয়ে যায়। যুদ্ধ চলাবস্থায় ৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানিদের ছোড়া গুলিতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। এরপরও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠান। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ সরকার দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারীকে ‘বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি ইপিআর বাহিনীতে পুনর্বহাল হন এবং ১৯৭৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম জাহানারা বেগম। এ দম্পতির ২ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড