দৈবজ্ঞহাটি খালকুলার যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট)
দৈবজ্ঞহাটি খালকুলার যুদ্ধ (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় দুবার- ১৯শে সেপ্টেম্বর ও ৯ই অক্টোবর। রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত এ-যুদ্ধে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হন।
দৈবজ্ঞহাটি বিশ্বাস বাড়ির রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতারা একত্র হয়ে এলাকার ১২ বছর থেকে ৪০ বছরের কিশোর ও যুবকদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। তারা হত্যা, লুট ও নারীধর্ষণে মেতে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। ক্যাম্প আক্রমণের লক্ষ্যে প্রযোজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য সুন্দরবন সাব-সেক্টরের বঙ্গবন্ধু কোম্পানির কমান্ডার নূর মোহাম্মদ হাওলাদার মুক্তিবাহিনী দলকে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ পেয়ে ১৯শে সেপ্টেম্বর সকালে শেখ মশিউর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহাবউদ্দিন আহম্মেদ, মতিন সরদার, আব্দুর রশিদ, সুধীর কুমার সাহা, মোশারেফ হোসেন ও আব্দুর রউফসহ ৮ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল সাধারণ যাত্রীবেশে নৌকায় করে দৈবজ্ঞহাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল ১টি এসএলআর, ৭টি রাইফেল ও এক ব্যাগ গ্রেনেড। দলটি বেলা ১টার দিকে পানগুছি নদী পাড়ি দিয়ে পাচগাঁও এলাকায় পৌঁছে। সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে তাঁরা বিশ্বস্ত লোকদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্ৰহ করেন। ভাটখালী এলাকায় পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধারা আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্য সংগ্রহ করার পর তাঁরা জানতে পারেন যে, দৈবজ্ঞহাটির রাজাকাররা মাসের বেতন আনতে বাগেরহাট গেছে। এ প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় হেডমা খাল দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। বিকেল ৫টার দিকে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পের অদূরে ক্যাম্পের পরিচালক আতাহার আলী খান এমএলএ-র বাড়ির নিকট মুক্তিযোদ্ধারা পৌঁছান। সেখানে পুলের ওপর মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমানের সঙ্গে তাঁর আত্মীয় আব্দুল জলিলের দেখা হয়। আব্দুল জলিল মশিউর রহমানকে জানান, মুক্তিযোদ্ধা দলটি যেদিকে যেতে চায় রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে সেদিকে লুটপাট করতে গেছে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা দলের অন্য পথে নৌকা চালানোর সুযোগ ছিল না। তারা ঐ খাল দিয়েই সামনের দিকে চলতে থাকেন। খালকুলা সতীশ কবিরাজের বাড়ি পর্যন্ত পৌছানো মাত্র তাঁরা দেখতে পান রাজাকাররা মালামাল লুট করে নৌকা বোঝাই করে আতাহার খানের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। লুটের নৌকাটি মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা অতিক্রম করতেই রাজাকার মোফাক্কর মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে নৌকাটি ছিদ্র হয়ে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পানিতে নেমে পড়েন এবং নিজেদের কোনো মতে সামলিয়ে মোফাক্করকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। মোফাক্কর আহত হয়ে নৌকা থেকে পড়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্যরা পরস্পরের বিরুদ্ধে একযোগে গুলি ছুড়তে থাকে। খালটি ছিল অনেক গভীর ও খরস্রোতা। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও দাঁড়াতে পারছিলেন না। বেশ কিছু সময় ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি-পাল্টা গুলি চলে। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা সুধীর কুমার সাহা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহম্মদের বুকে এবং সরদার মতিনের হাতে গুলি লাগে। এতে তাঁরা আহত হন। তাঁদের প্রথমে ইসমাইল ডাক্তারের বাড়িতে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখান থেকে মোস্তাফিজুর রহমান রামচন্দ্রপুর গ্রামের রুহিনী কুমার দাসের বাড়িতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যান। রুহিনী কুমারের স্ত্রী শোভা রানী দাস আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেন। রাতভর আগুন জ্বালিয়ে কাপড় গরম করে আহতদের ঠাণ্ডা দেহ উষ্ণ রাখার চেষ্টা করেন। পরে চিকিৎসার জন্য তাঁদের সিকদার মল্লিক ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকদিন পরে সিকদার মল্লিক থেকে তাঁদের উন্নত চিকিৎসার জন্য শেখ মশিউর রহমান সুন্দরবনে নিয়ে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো বাহিনীও সুন্দরবনে ফিরে যায়।
৯ই অক্টোবর সুন্দরবনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স দ্বিতীয়বারের মতো দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু কোম্পানি কমান্ডার নূর মোহাম্মদ হাওলাদারকে আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। অপারেশন কমান্ডার হিসেবে আব্দুল হাই খোকন, খালিদ হোসেন ও হাবিবুর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়। নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের সহকারী হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান ও শেখ মশিউর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়। নূর মোহাম্মদ যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে অপারেশন কমান্ডারদের প্লাটুন কমান্ডার, গ্রুপ কমান্ডার ও অন্যান্য যোদ্ধাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে হাবিবুর রহমান ও তাঁর দলকে রাজাকার ক্যাম্প ও বিশ্বাস বাড়ির দক্ষিণ দিকের রাস্তা, মোড়েলগঞ্জ যাবার বড় রাস্তা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম রাস্তাসহ দৈবজ্ঞহাটি বাজারের দিকে এম্বুশের নির্দেশ দেন। খালিদ হোসেন ও তাঁর দলকে বিশ্বাস বাড়ির উত্তর ও পশ্চিম দিকের রাস্তা এবং বাগেরহাট যাবার বড় রাস্তা পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখার নির্দেশ দেন। সিদ্ধান্ত হয়, হাবিবুর রহমানের দলের একাংশ এবং খালিদ হোসেনের দলের একাংশ দুদিক থেকে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করবেন। আব্দুল হাই খোকন তাঁর দল নিয়ে রাজাকারদের মূল ঘাঁটি মহালক্ষি দোতলা ভবন আক্রমণ করবেন। নূর মোহাম্মদ তাঁর নিজস্ব বাহিনী নিয়ে কমান্ড পোস্টে অবস্থান করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬টি বড় নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধারা। সুন্দরবন থেকে বিকেল ৫টার দিকে প্রযোজনীয় যুদ্ধাস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে দৈবজ্ঞহাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বৃষ্টিতে ভিজে রাত ১১টার দিকে তাঁরা ফুলহাতা বাজারে পৌঁছান। নৌকাগুলো প্রবল বৃষ্টি ও ঘোর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ধীরে-ধীরে এগোচ্ছিল। এ অবস্থাতেই রাত ৩টার দিকে চ মুক্তিযোদ্ধারা দৈবজ্ঞহাটি এলাকায় পৌঁছান। এরপর নৌকাগুলো পথে রেখে বেশ কিছু দূর হেঁটে কমান্ডার ও সহযোদ্ধাগণ নিজ-নিজ অবস্থানে পৌঁছে অবস্থান করতে 5 থাকেন। অতিবৃষ্টির কারণে রাজাকার ক্যাম্পের চারদিকে পানি জমে যায়। এ কারণে এম্বুশ নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট হয়। শেষরাতের দিকে কমান্ডার নূর মোহাম্মদ হাওলাদার ফায়ার ওপেন করেন। ফায়ার ওপেন হওয়া মাত্র অন্য সহযোদ্ধারাও রাজাকারদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। এভাবে বেশকিছুক্ষণ গুলি বিনিময় চলতে থাকে। কিন্তু রাজাকারদের কোনোভাবে পরাস্ত করা যাচ্ছিল না। তারা সুরক্ষিত ভবনে অবস্থান করছিল। সকাল হলে রাজাকারদের অবস্থান ও ভবনের দরজা জানালা মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টিগোচরে আসে। র মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রত্যেকে জানালা লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। দরজা-জানালায় অবিরাম গুলি চলতে থাকায় রাজাকাররা আর জানালার কাছে আসতে সক্ষম হয়নি। ই রাজাকার কমান্ডার জব্বার আলী আত্মসমর্পণের প্রতিশ্রুতি। দিয়ে সময় চায়। সকাল ৯টার দিকে রাজাকাররা জানালা দিয়ে কয়েকটি রাইফেল ফেলে দেয় এবং আরো সময় চায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে ৫ মিনিট সময় দেয়া হয়। এর মধ্যে তারা ৩টি রাইফেল ফেলে দেয় এবং পুনরায় সময় প্রার্থনা করে। রাজাকারদের পুনঃপুন সময় চাওয়ার অভিসন্ধি র বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হাই খোকন। রাজাকারদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করতে সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন। একটি গ্রেনেড ব্লাস্ট হলেও বাকিগুলো ভিজে যাওয়ায় ব্লাস্ট হয়নি। গ্রেনেডগুলো সুষ্ঠুভাবে ব্লাস্ট হলে রাজাকারদের স্বল্প সময়ের মধ্যে হত্যা করা যেত। যুদ্ধরত অবস্থায় সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা রোদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যাতে রোদের তাপে কিছুটা হলেও সবল হওয়া যায়। কিন্তু তখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুর ১২টার পর মুক্তিযোদ্ধা ট খালিদ সকল ফায়ারিং পয়েন্টে এ মর্মে খবর পাঠান যে, বাগেরহাট ও পিরোজপুর থেকে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর একটি বিশাল দল দৈবজ্ঞহাটির কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীকে প্রতিহত করার মতো মুক্তিযোদ্ধা দলের কারোরই দৈহিক ও মানসিক সামর্থ্য ছিল না। তাই কমান্ডারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ ছেড়ে নিরাপদ স্থান সুন্দরবনের দিকে ফিরে যান। এ-যুদ্ধ ছিল দৈবজ্ঞাহাটি রাজাকারদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার একটি বিশেষ অভিযান। কিন্তু বিরামহীন বৃষ্টির কারণে তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ-যুদ্ধে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কেউই আহত বা নিহত হননি। [শেখ মশিউর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড