You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে দোয়ারাবাজার উপজেলা (সুনামগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে দোয়ারাবাজার উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

দোয়ারাবাজার উপজেলা (সুনামগঞ্জ) ১৯৭১ সালে ছাতক ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৬ সালে দোয়ারাবাজার স্বতন্ত্র থানার মর্যাদা লাভ করে এবং ১৯৮৫ সালে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। দোয়ারাবাজারের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের টেংরাটিলায় গ্যাস ফিল্ড থাকার কারণে এ এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো। স্বাধীনতাকামী মানুষ যে-কোনো সময় গ্যাস ফিল্ডে হামলা চালাতে পারে এ আশংকায় পাকিস্তানি প্রশাসন মার্চের প্রথম থেকেই গ্যাস ফিল্ডে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। ৭ই মার্চের পর থেকে টেংরাটিলার জনসাধারণ স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এ কে এম আসকির মিয়া (দোয়ারাবাজার), ফজলুল হক (টেংরাটিলা), ডা. আব্দুল হামিদ (টেংরাটিলা), আব্দুল কাদির (কান্দাগাঁও), মদনমোহন নন্দী (আশাউড়া), রইছ মিয়া চৌধুরী (লক্ষ্মীপুর) প্রমুখের নেতৃত্বে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। দোয়ারাবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং অফিস আদালতসহ দোকানপাটে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দোয়ারাবাজারে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়। দোয়ারাবাজারের সীমান্ত সংলগ্ন ব্রিটিশ রোডে পাকিস্তান বাজারের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাবাজার’ নামকরণ করে বাংলাবাজার মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আব্দুল কাদির তালুকদার (বক্তারপুর) সভাপতি, সুনাব আলী
(আনোয়ারপুর) সহ-সভাপতি এবং রইছ মিয়া চৌধুরী (লক্ষ্মীপুর) এ কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। সদস্যদের মধ্যে জিয়াউল হক (চকিঘাট), আজহর আলী (বক্তারপুর), আব্দুল মতলিব (দেলোয়ারনগর), ফজলুর রহমান চৌধুরী (লক্ষ্মীপুর), মনফর আলী (লক্ষ্মীপুর) মোস্তফা মোড়ল (চকিরঘাট), তারা মিয়া (চকিরঘাট) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বাঁশতলায়ও ডা. মুছাব্বিরের নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ সংগ্রাম কমিটি স্থানীয় ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদের মাধ্যমে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
দোয়ারাবাজার ও টেংরাটিলার জনবিক্ষোভের প্রভাব সমগ্র সুনামগঞ্জ অঞ্চলে গিয়ে পড়ে। টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডে বিপদের আশংকায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি করলেও সংগ্রামী জনতা গ্যাস ফিল্ডে আক্রমণ চালায়। এ-সময় আনসার কমান্ডার খুর্শিদ মিয়া (কাঠালবাড়ী) ও সুলতান মিয়া (গিরিশনগর) পুলিশের ওয়ারলেস ও অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সীমান্তের রেঙ্গুয়া বাজারে চলে যান। ১০ই এপ্রিল তাঁরা বোগলা ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে বোগলা ইপিআর ক্যাম্পের ৩ জন পাঞ্জাবি ইপিআর সদস্য জনতার হাতে নিহত হয়। ক্যাম্পের ওয়ারলেস মাস্টার আব্দুল কাদির (ঢাকা) সংগ্ৰামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বোগলা ইপিআর ক্যাম্প থেকে জনতা ৬টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, একটি স্টেনগান, ওয়ারলেস সেট, গুলি ও রেশন হস্তগত করেন।
টেংরাটিলা ও বোগলা ইপিআর ক্যাম্প থেকে পাওয়া অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম কমিটি তাদের নিজস্ব বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনীই দোয়ারাবাজার অঞ্চলে পেট্রোল করত। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এ বাহিনী কান্দারগাঁওয়ে পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকসেনাদের ১০ জনের একটি টহল গ্রুপ বোগলা আসার পথে কান্দারগাঁওয়ে মোল্লাপাড়ায় অবস্থান নেয়। প্রায় ২ হাজার জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অবস্থান মোল্লাপাড়া-কান্দারগাঁও গ্রামটি ঘিরে ফেলে। সেখানে ২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা আহত অবস্থায় ফিরে যেতে সমর্থ হয়। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য দোয়ারাবাজার, টেংরাটিলা, আশাউরা, কান্দারগাও-লিয়াকতগঞ্জ প্রভৃতি গ্রামের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে এ কে এম আসকির মিয়া সভাপতি (দোয়ারাবাজার) এবং আহসান উল্লাহ সহ-সভাপতি (ভাঙ্গাপাড়া) নির্বাচিত হন। সদস্যদের মধ্যে সিরাজ মিয়া (কুমিল্লা), মদনমোহন নন্দী (আশাউড়া), উবেদ আলী মোড়ল (সোনাচূড়া), ডা. আব্দুল হামিদ (টেংরাটিলা) প্রমুখ ছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে হাজী সোনাহর মিয়া (পশ্চিম মাছিমপুর), হারিছ মিয়া তালুকদার (দিগলবন্ধ), মোমিন উদ্দিন (দোয়ারাবাজার), সোনা মিয়া (পূর্ব মাছিমপুর), আব্দুল ওয়াহিদ (পশ্চিম মাছিমপুর), মো. ফজলুল হক (টেংরাটিলা), আব্দুল হক (টেংরাটিলা), সিরাজ মিয়া (বোগলা), মন্নান ফকির (বোগলা), আলফাজ মিয়া (বাগানবাড়ি), রুস্তম আলী (সোনাচূড়া), রূপা মিয়া (গোজাউরা), হাজী দাইম উল্লা (গোজাউরা), গোপাল চক্রবর্তী (দোয়ারাবাজার), মণীন্দ্রচন্দ্র রায় (দোয়ারাবাজার) প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী এমএনএ-এর পরামর্শে রেঙ্গুয়া অঞ্চলের চামডর গ্রামে বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটি নামে আরো একটি কমিটি গঠিত হয়।
দোয়ারাবাজার থানাটি ছিল ৫নং সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী (পরবর্তীতে লে. জেনারেল)। অন্যদিকে এ থানাটি শেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টরের অধীনে ছিল। এ সাব- সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিন (পরবর্তীতে লে. কর্নেল)। বাংলাদেশের প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত দুজন অফিসার লে. রউফ এবং লে. মাহবুব কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া শহীদ চৌধুরী (কোম্পানি কমান্ডার, হরিণাপার্টি), নূরুল হক (কোম্পানি কমান্ডার, বাংলাবাজার) ইদ্রিছ আলী (কোম্পানি কমান্ডার, বড়খাল), শামসুদ্দিন আহমদ (কোম্পানি কমান্ডার, কানাইঘাট), উজির মিয়া (কোম্পানি কমান্ডার, ইনাতনগর), সুবেদার খোরশেদ (ইপিআর) প্রমুখ বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপর দোয়ারাবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধ গড়ে ওঠে 1 টেংরাটিলার গ্যাস দিয়ে ছাতকের শিল্প-কারখানা চালু রাখতে পাকসেনারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন কেন্দ্ৰীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ছাড়াই এলাকায় আন্দোলন চালাতে থাকে। তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে গ্যাস ফিল্ডের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে তছনছ করে দেয়। হরিনাপার্টির শহীদ চৌধুরী, টেংরাটিলার তরুণ ছাত্রনেতা আব্দুস সালাম, আব্দুল হালিম, ফয়েজ উদ্দিন আহমদ, আব্দুল মজিদ, লক্ষ্মীপুর গ্রামের বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুসহ এলাকাবাসী সংগ্রামের পথকে প্রশস্ত করে। বিপদ থেকে রক্ষা ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এলাকার লোকজন সীমান্তবর্তী এলাকা রেঙ্গুয়া ও বাগানবাড়ি অঞ্চলে চলে যায়। ঐ স্থানে মুক্তাঞ্চল গড়ার কাজে তারা আত্মনিয়োগ করে এবং বাগানবাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে ১৫০ জন প্রাক্তন ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদের একটি গ্রুপ অবস্থান করত। তাছাড়া দোয়ারাবাজারের দক্ষিণ- পশ্চিমে পান্ডারগাঁও ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের – গোপন আস্তানা ছিল। চারিদিকে হাওড় বেষ্টিত এ স্থানে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধারা চোরাগোপ্তা হামলা চালাতেন। ২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী দোয়ারাবাজারে প্রবেশ করে এবং টেংরাটিলা ও দোয়ারাবাজার সদরে ক্যাম্প স্থাপন করে। ১২ই মে সুনামগঞ্জ মহকুমায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর কদিন পরেই মুসলিম লীগ-এর ছত্রছায়ায় দোয়ারাবাজারে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। সুনামগঞ্জ মহকুমায় শান্তি কমিটি গঠনের সভায় দোয়ারাবাজারের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের রাশিদ আলী যোগ দেয়। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে আব্দুল ওয়াহিদ (চেঙ্গাইয়া), দেওয়ান আখলাক চৌধুরী (পানাইল), আব্দুর রশিদ (নৈনগাঁও), আব্দুল হাশিম (টেবলাই), আব্দুল গফুর (পরমেশ্বরীপুর), আছকর আলী (চণ্ডীপুর), ওয়াজেদ আলী মুনসী (যোগীরগাঁও), আব্দুল ছত্তার (ইদনপুর), সিকন্দর মোড়ল (আজমপুর), হুছন আলী (মঙ্গলপুর), গৌছ আলী (পান্ডারগাঁও), আব্দুল কাদির (শ্রীপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। রাজাকারদের মধ্যে আবুল হোসেন (বড়বন্দ), আ. খালেক (টেবলাই), মকবুল আলী (বড়বন্দ), আ. বারী (শ্রীপুর), শমর আলী (বেতুরা), তাহের আলী (টেবলাই), আছমত আলী (টেবলাই), টেনাই মিয়া (বড়বন্দ), রং হোসেন (মাছিমপুর), বুদাই (শিমুলতলা), আব্দুল খালেক (শরীফপুর), নুরুল হক (শরীফপুর), সামাদ (মাছিমপুর), মকবুল (পূর্ব মাছিমপুর), বুদাই (পূর্ব মাছিমপুর), মাফিজ আলী (পূর্ব মাছিমপুর), হোসেন আলী (পূর্ব মাছিমপুর), ছন্দু মিয়া (রাখালকান্দি), নুর উদ্দিন (রাখালকান্দি), আ. মালেক (রাখালকান্দি), ইছিম উল্লা (রাখালকান্দি), আ. জলিল মেম্বার (জিরারগাও), আয়েত আলী মোল্লা (লামাসানিয়া), আইয়ুব আলী (লামাসানিয়া), সেকান্দার আলী (লামাসানিয়া), আকবর আলী (বড়বন্দ), আব্দুল ছাত্তার (মঙ্গলপুর), সোনাহর আলী (পলিরচর), মোখলেছ (পলিরচর), আরব আলী (পলিরচর), ইন্তাজ আলী (গুরুশপুর), কাশেম আলী (বালিউড়া), ল্যান্স নায়েক আলাউদ্দিন, মনু মিয়া (বালিউড়া), আব্দুল হক (বড়বন্দ), কেরামত আলী (রাখালকান্দি), হাজী উমেদ আলী (টেংরাটিলা), শামসুদ্দিন (টেংরাটিলা), আব্দুল কাদির (টেংরাটিলা), শামসুজ্জামান ফারাজি (গিরিশনগর), আ. হাকিম ফারাজি (গিরিশনগর), মনু মিয়া (খৈয়াজুরি), মাহমদ আলী (মহবতপুর), বারিক মোল্লা (মহবতপুর), আব্দুল কদ্দুছ (আলীপুর), কামাল ডাক্তার (মহবতপুর), তোফাজ্জল হোসেন (টেংরাটিলা), ইন্তাজ আলী (টেংরাটিলা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব রাজাকাররা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা অঞ্চলে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি থাকায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ অঞ্চলে তাদের অত্যাচারের মাত্রা ছিল ভয়াবহ। পাকবাহিনী টেংরাটিলার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব হাজী আব্দুর রহমান (পিতা শেরমাহমুদ)-এর ওপর নির্যাতন চালায়। প্রথমে তারা তাকে তাদের দলে টানার চেষ্টা করে। তারপর তার বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি জোরপূর্বক নিয়ে যায়। পরবর্তীতে হাজী আব্দুর রহমানের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কারণে পাকসেনারা তাকে বিবস্ত্র করে তার পায়ের জুতা খুলে সেই জুতা দিয়ে তাকে মারধর করে।
পাকসেনারা হিন্দু প্রধান দোহালিয়া গ্রামটি পুড়ে ছারখার করে দেয় এবং হাজী সোনাহর মিয়া, মোমিন উদ্দিন ও সোনা হাজীর বাড়িগুলো আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। দোয়ারাবাজারের কুখ্যাত রাজাকার ছিল ওসমান গণি ওরফে বোদাই মিয়া ও আব্দুল হাশিম (ব্যবসায়ী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া)। তারা দোয়ারাবাজারের এ কে এম আসকির মিয়া, বলরাম দে ও নারায়ণের বাসা দখল করে নেয় এবং পরবর্তীতে এ কে এম আসকির মিয়ার বাসাটি পুড়িয়ে দেয়।
বৈঠাখাই গ্রামের আব্দুর রহমানের মেয়ে মহেচানের ওপর তিনজন পাকসেনা হামলা করতে উদ্যত হলে সে দা দিয়ে কোপ দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তা এক পাকসেনার বন্দুকের বাটে লাগে। পরক্ষণেই সে অন্য পাকসেনার বন্দুক কেড়ে নিয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় অন্য সেনাসদস্য পুকুরেই আব্দুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে। একই গ্রামের মিছিল মিয়া সকাল বেলা সুলতানপুর গ্রামের পথে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে রেকি করার সন্দেহে পাকবাহিনী সাধুর বাপের টিলার বাঙ্কার থেকে গুলি ছুড়ে তাকে হত্যা করে। হাসনবাহার গ্রামের রমা মিয়া মাঠে কাজ করতে যাওয়ার সময় জিন্নাত আলী মিয়ার টিলার বাঙ্কার থেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে তাকে গুলি করে হত্যা করে। বাঘরা গ্রামের দিনমজুর মালিক মিয়া নৌকাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেয়ার অপরাধে পাকসেনারা নৌকাতেই তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়।
কাউয়ারগড় গ্রামের সিকন্দর আলী তার সবজী বাগানে কাজ করার সময় মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে পাকসেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। মারপশি গ্রামের সিরাজ মিয়াও একইভাবে পাকসেনাদের নির্মম হত্যার শিকার হয়। টিলাগাঁও গ্রামের বার বছরের শিশু আব্দুল করিম বিলে মাছ ধরতে গেলে পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ পানিতে ফেলে দেয়। টেংরাটিলার মো. ইয়াহিয়াকে গুলি করে আহত করা হয়।
দোয়ারাবাজার থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে নৈনগাঁও গ্রাম। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক দুঃসাহসিক অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে চলে যাওয়া গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটালে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯শে আগস্ট ছাতক হানাদার ক্যাম্প থেকে হানাদার ও রাজাকার বাহিনী দুটি লঞ্চযোগে নৈনগাঁওয়ে প্রবেশ করে ১৯ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে, যা নৈনগাঁও গণহত্যা- নামে পরিচিত। এদিন তারা বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রম হানি করে এবং লুটতরাজ শেষে পুরো গ্রামটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
দোয়ারাবাজার উপজেলার পান্ডারগাঁও ইউনিয়নের একটি দুর্গম গ্রাম শ্রীপুর। এ গ্রামে সাবসেক্টর কমান্ডার এ এস হেলাল উদ্দিন অবস্থান করে আশপাশের এলাকায় অপারেশ চালাতেন। পাকবাহিনী রাজাকারদের মাধ্যমে এ সংবাদ জানতে পেরে ১৪ই নভেম্বর হেলিকপ্টারে গ্রামটি রেকি করে এবং একই দিনে ছাতক থেকে নৌকাযোগে পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে এসে গ্রামটিতে গণহত্যা চালিয়ে ১১ জন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা শ্রীপুর গণহত্যা- নামে খ্যাত। এদিন পাকবাহিনী দুজন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় এবং পুরো গ্রামটিতে অগ্নিসংযোগ করে।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে শহীদ কোম্পানির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্মীপুর থেকে ২টিলাগাঁও পাকবাহিনীর বাঙ্কার দখল করার লক্ষ্যে আক্রমণ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক দিয়ে আক্রমণ করেন। এতে পাকবাহিনী পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ফেলে যাওয়া রসদ-সামগ্রী ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দোয়ারাবাজার থেকে পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে পুনরায় টিলাগাঁও দখল করে নেয়।
জুলাই মাসে শহীদ কোম্পানি টেংরাটিলা হানাদার ক্যাম্প অপারেশন-এর উদ্দেশ্যে সুলতানপুর, লক্ষ্মীপুর ও মহব্বতপুরে ডিফেন্স নেয়। পাকসেনাদের ডিফেন্স ছিল কালাপানি, আলীপুর, টিলাগাঁও ও টেংরাটিলায়। স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে টেংরাটিলায় একযোগে আক্রমণ চালান। তিন দিন তিন রাত ধরে যুদ্ধ চলে। তৃতীয় দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে দোয়ারাবাজারে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা টেংরাটিলা দখল করে নেন। কিন্তু পাকসেনারা সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার থেকে অতিরিক্ত সৈন্য এনে প্রচণ্ড শক্তিতে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে পারেননি। পরবর্তীতে পাকসেনারা টেংরাটিলায় শক্তভাবে অবস্থান নেয়।
বেতুরার কুখ্যাত দালাল মতছির আলী ফকিরের বাড়িটি রাজাকার ও দালালদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জুন মাসের প্রথম দিকে কমান্ডার শামসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বেতুরার ফকির চেয়ারম্যান বাড়ি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দালাল ফকির চেয়ারম্যানকে ধরার জন্য বাড়িটিতে গেরিলা আক্রমণ চালালে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে গুলিসহ কয়েকটি বন্দুক উদ্ধার করেন। এ অপারেশনের পর ফকির চেয়ারম্যান আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং সে পাকবাহিনীর একটি গ্রুপকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। ফলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে কমান্ডার উজির মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয় দফা আক্রমণ পরিচালিত হয়। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাড়িটি ধ্বংস করে দেন।
সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পাকসেনাদের শক্ত অবস্থান ছিল। প্রথম ছাতকের পেপার মিলস ও সিমেন্ট কারখানা, দ্বিতীয় টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড। টেংরাটিলা থেকে ছাতকের সিমেন্ট কারখানায় গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। এর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল রাজাকার বাহিনী। শহীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জুন মাসের প্রথম দিকে টেংলাটিলা গ্যাস পাইপ লাইন অপারেশন পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধরা পাইপ লাইনের ওপর এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে এর কিছু অংশ ধ্বংস করে দেন।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে উজির মিয়ার নেতৃত্বে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা একটি নৌকাযোগে রাতের অন্ধকারে মাছিমপুরের দিকে যাওয়া গ্যাস পাইপ লাইনটি উড়িয়ে দেন। এ দলের 3 দুজন মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান ও হিরন্ময় কর অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে টেংরাটিলার নিকটবর্তী এ পাইপ লাইনটি ধ্বংস করায় পাকিস্তানিদের সিমেন্ট উৎপাদন বহুদিন বন্ধ থাকে। এ গ্রুপটিকে গাইড করেন ফখরুদ্দিন (শিবপুর)।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে নৈনগাঁও গ্যাস পাইপ লাইন অপারেশন পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শক্তিশালী বিস্ফোরক নিয়ে নৈনগাঁওয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া গ্যাস পাইপ লাইনটি উড়িয়ে দেন। সারারাত গ্যাসের লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকে। এর ফলে ছাতকে ১৫ দিন উৎপাদন বন্ধসহ পাকসেনাদের ক্যাম্পও অন্ধকারে ডুবে থাকে।
বেটিরগাঁও গ্রামটির অবস্থান সুরমা নদীর পাড়ে। পাকসেনারা সুনামগঞ্জ থেকে বেটিরগাঁও হয়ে দোয়ারাবাজার ও ছাতকে যাতায়াত করত। তাদের বাধা দেয়ার জন্য আগস্ট মাসের শেষদিকে ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিনের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ বেটিরগাঁওয়ে অবস্থান নেয়। সুনামগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা রকেট লঞ্চার ছুড়ে মারলে বেটিরগাঁও যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে হানাদারদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদুর রহমান ওরফে সোনা মিয়া (পিতা হাবিব উল, বাজিতপুর) শহীদ হন এবং হুসিয়ার আলী (পিতা মরম আলী, সোনাপুর) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করে তাঁর লাশ সুরমা নদীতে ফেলে দেয়। স্বাধীনতার পর বেটিরগাঁওয়ের জনগণ গ্রামটির নাম পরিবর্তন করে ‘সোনাপুর’ নামকরণ করে।
আগস্ট মাসে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে বালিউড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ ছাতক থেকে বালিউড়া যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বালিউড়া বাজারের পূর্ব দিকের সড়ক ও কাছারি পুকুর পাড়ে অবস্থান নেন। পাকবাহিনীর একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কাছাকাছি এলেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। এমতাবস্থায় পাকবাহিনী পিছু হটে।
আগস্ট মাসের শেষদিকে টেংরাটিলা থেকে মহব্বতপুর পর্যন্ত এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মহব্বতপুরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভয়াবহ এ-যুদ্ধে মো. রফিক ড্রাইভার (জাফলং) ও মো. আমিনুল হক (শিমুলতলা) সহ নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিন হাবিলদারকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে চারজন পাকসেনা নিহত হয়।
ব্রিটিশ সরকার সুরমা নদী থেকে মালামাল নিয়ে মেঘালয়ে যাওয়ার জন্য দোয়ারাবাজার থেকে ছাতকের সীমানা ঘেঁষে একটি ট্রলি লাইন তৈরি করেছিল। এটাই স্থানীয়ভাবে ব্রিটিশ সড়ক নামে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে সড়কটির দখল নেয়ার জন্য পাকসেনারা মরিয়া হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ সড়কের দখল নেয়ার জন্য যুদ্ধ হয়। ব্রিটিশ সড়ক যুদ্ধে আব্দুল মতিন (জাফলং) ও আব্দুর রহিম নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
ছাতক নিয়ন্ত্রণে নেয়ার উদ্দেশ্যে সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, গোবিন্দগঞ্জ, রাধানগর প্রভৃতি স্থান থেকে যাতে পাকবাহিনী ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য এসব স্থানে বিভিন্ন কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্সে রাখা হয়। ১৩ই অক্টোবর সেখানে পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে এক ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা দোয়ারাবাজার যুদ্ধ- নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
টেংরাটিলায় পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ৩০শে নভেম্বর সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে সেখানে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালিত হয়। ৩০শে নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে একটানা যুদ্ধ চলে, যা টেংরাটিলা যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী সুনামগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। ৫ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা টেংরাটিলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং এদিনই দোয়ারাবাজার উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
দোয়ারাবাজার উপজেলায় ২৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন খোরশেদ আলম (পিতা কানু শেখ মণ্ডল, কাঠালবাড়ী), আব্দুল মজিদ (পিতা হালিম উদ্দিন, কেম্পেরঘাট), খুর্শেদ আলম (পিতা নুর মিয়া, ইদুকোনা), হোসেন আলী (পিতা আহমদ আলী, নোয়াডর), আরজু মিয়া (পিতা মহবত আলী, ঘিলাছড়া), আব্দুস সাত্তার (পিতা আব্দুল আউয়াল, পরমেশ্বরীপুর), মকরম আলী (পিতা মোহাম্মদ আলী, প্যাকপাড়া), নায়েক মো. মঈনউদ্দিন (পিতা নাজিম উদ্দিন, মোলাপাড়া), মো. হুসিয়ার আলী (পিতা মরম আলী, সোনাপুর), আবু মিয়া (পিতা রশিদ আলী, ঘিলাছড়া), সাজ্জাদুর রহমান ওরফে সোনা মিয়া (পিতা হাবিব উল, বাজিতপুর), আব্দুল মন্নান (পিতা আব্দুল হামিদ, এরুয়াখাই), এ জেড জাহাঙ্গীর পাশা (পিতা ফজর আলী,রাঙ্গাউটি), আব্দুল লতিব (পিতা আব্দুল মতলিব, লাস্তবেরগাঁও), মন্তাজ উদ্দিন (পিতা আব্দুল কদ্দুস, চিলাইরপার), আফাজ উদ্দিন (পিতা হাফিজউদ্দিন, প্যাকপাড়া), আবু তাহের (পিতা মহবত আলী, ইদুকোনা), তারু মিয়া (পিতা রুশমত আলী, কেম্পেরঘাট), মোমতাজ উদ্দিন (পিতা জহুর উদ্দিন, কেম্পেরঘাট), আমিনুল হক (পিতা টুক্কু মিয়া, শিমুলতলা), আলফাজ উদ্দিন (পিতা হাজী হাদির উদ্দিন, বাঁশতলা), ইদ্রিস আলী (পিতা আব্দুল মজিদ, বক্তারপুর) ও আব্দুন নূর (পিতা হাজী ওয়াহিদ উল্লা, রঘারপার)।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ইদ্রিস আলী, বীর প্রতীক- (পিতা আলহাজ্ব মো. ইসমাইল, বড়খাল), মো. আব্দুল মজিদ, বীর প্রতীক- (পিতা আব্দুল গণি, টেংরাটিলা) এবং এম এ হালিম, বীর প্রতীক- (পিতা আব্দুল কুদ্দুস মিয়া, টেংরাটিলা)।
দোয়ারাবাজার উপজেলার একজন বিশিষ্ট নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন কাঁকন বিবি। তিনি মূলত ভারতের খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোক। তাঁর বাড়ি ছিল খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। দিরাই উপজেলার জিরারগাঁও গ্রামের শাহেদ আলীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের পর তাঁর নতুন নাম হয় নূরজাহান বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ আব্দুল হক এমএনএ ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলার নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে হক নগর এবং বাঁশতলায় হক নগর প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে বাঁশতলায় শহীদ স্মৃতি জুনিয়র হাইস্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিন ২০০৮ সালে বাঁশতলায় নিজ অর্থায়নে একটি শহীদ স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করেন। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু লক্ষ্মীপুরে স্থাপন করেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হেলাল-খসরু হাইস্কুল। বড়খাল হাইস্কুলের একটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে ক্যাপ্টেন হেলাল বিজ্ঞান ভবন। মহব্বতপুরে সাব সেক্টর কমান্ডার এ এস হেলাল উদ্দিনের অর্থায়নে ‘স্মৃতি দীপ্তিমান’ নামে একটি শহীদ স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করা হয়েছে। [বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড