মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১১) ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’– এই ভরাট কণ্ঠ, ভারতের কিংবদন্তী বাচিক শিল্পী ও জনপ্রিয় সংবাদপাঠক, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠসৈনিক, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাদাতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত।
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ২৫শে জুন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নন্দদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীহারবালা দেবী। তিনি শান্তিপুর মিউনিসিপ্যালিটি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর সেখান থেকে পরিবারের সবাই কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতা সরস্বতী ইনস্টিটিউশনে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। সে কারণে এক সময় তিনি পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। এ নিয়ে পিতার সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। তিনি ঘরছাড়া হন এবং একটি মেসে ওঠেন। রোজগারের জন্য চায়ের দোকানে কাজ, টিউশনি এবং রেল কোম্পানির হয়ে সার্ভে কাজও করেন। পরবর্তীতে সরস্বতী ইনস্টিটিউশন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই ইনস্টিটিউশন থেকে বিএ পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই দেবদুলাল ছিলেন খুবই অদম্য এবং সৃজনশীল কাজের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকাঙ্ক্ষা। দিনের কাজ শেষে রাতে ঘরে ফিরে তিনি খাতা-কলম নিয়ে বসতেন কবিতা লিখতে। তিনি ছিলেন উচ্চমানের আবৃত্তি শিল্পী।
১৯৬০ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’ পদে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি ‘সংবাদ পাঠক’ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অসাধারণ বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ ও সুরেলা কণ্ঠের জন্য রাতারাতি তিনি দুই বাংলার শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’-এরূপ ভরাট, আবেগ ও দরদি কণ্ঠে সংবাদ পাঠ, প্রণবেশ সেন লিখিত ও উপেন তরফদার প্রযোজিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর সংবাদ সমীক্ষা বা সংবাদ-পরিক্রমা পাঠ- ইত্যাদি মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করেছে; শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উজ্জীবিত করেছে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের। ভারতীয় সময় রাত ১০টায় এ অনুষ্ঠানটি শুরু হলে শহর ও গ্রামের প্রতিটি মানুষ রেডিওর চারপাশে ভিড় জমাত। এক সময় পাকিস্তান সরকার আকাশবাণী কলকাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ গোপনে, এমনকি জঙ্গলে গিয়েও শুনেছেন আকাশবাণী ও বিবিসি-র খবর। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিবিসি-র মার্ক টালি ছিলেন তখন বাঙালির ঘরে-ঘরে অতি প্রিয় নাম। মুক্তিযুদ্ধতো বটেই, এমনকি ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতেও দেবদুলাল আকাশবাণী থেকে পড়েছেন বাংলাদেশের খবর।
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৪ সালে আকাশবাণী কলকাতা থেকে অবসর নেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর পেশাগত জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালটি। বাংলাদেশ ছিল তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশ, যদিও তখন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে আসেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস উচ্ছ্বাস নেমে আসতো আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেনো নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন পড়বো বাংলাদেশের খবর। এই খবর পড়ার জন্য কখনো কখনো রাতে বাড়িও ফিরিনি। রাত কাটিয়েছি আকাশবাণী ভবনে। ভোরের খবর পড়তে হবে যে ! তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীর প্রতি নৈকট্যবোধে মন আপ্লুত হয়েছে আমার বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।
বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন, তখন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঢাকায় আসেন এবং হোটেল পূর্বাণীতে ওঠেন। সেটিই ছিল তাঁর প্রথম বাংলাদেশে আগমন। এরপর তিনি কয়েকবার বাংলাদেশে আসেন। বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদানের জন্য তাঁকে বুকে আলিঙ্গন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে ২৭শে মার্চ দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে Friends of Liberation War (মরণোত্তর) সম্মাননা প্রদান করে। এর পূর্বে ১৯৭২ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য পিএসপি (প্রোগ্রেসিভ সুপ্রা নিউক্লিয়ার পলসি) রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ধীরে-ধীরে তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো শুকিয়ে যায়। অবশেষে ২০১১ সালের ২রা জুন দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর সংলগ্ন নিজ এপার্টমেন্টে ৭৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী কবি রুবি বন্দ্যোপাধ্যায় (মৃত্যু ২০০৮)। তাঁদের দেবারতি নামে এক কন্যা ও দেবরাজ নামে এক পুত্র সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: দেবরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় (দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র)-এর সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার, ২৯শে মে ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড