You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দেবহাটা উপজেলা (সাতক্ষীরা)

দেবহাটা উপজেলা (সাতক্ষীরা) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশের মতো দেবহাটা উপজেলায়ও সর্বস্তরের জনতা স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। কেন্দ্রের নির্দেশে প্রতিটি মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সাতক্ষীরায় ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমানকে সভাপতি ও কামরুল ইসলাম খানকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রত্যেক থানায় এর শাখা গড়ে ওঠে। দেবহাটায় আলী আহমেদকে আহ্বায়ক করে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা হলেন মোশাররফ হোসেন মশু (পারুলিয়া; ছাত্রনেতা), আব্দুর রহিম, ইয়াছিন আলী, আব্দুল মাবুদ গাজী, আতিয়ার রহমান গদাই, জামসেদ আলম, আব্দুর রউফ, আব্দুস সালেক ও আনন্দ সাহা। এরপর গঠিত হয় সাতক্ষীরা মহকুমা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ, যার অন্যতম সংগঠক ছিলেন লুৎফর রহমানI সরদার (ধোপাডাঙ্গা; বামপন্থী নেতা এবং ১৯৫২-র ভাষা। আন্দোলন-এর অন্যতম সৈনিক)। সাতক্ষীরার প্রতিটি থানায় এর শাখা গঠিত হয়। দেবহাটা থানা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মোহাম্মদ শাহজাহান (টাউন শ্রীপুর শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের। প্রধান শিক্ষক) ও সনৎ কুমার সেন। পরিষদের সদস্যরা হলেন আতিয়ার রহমান বিশ্বাস, দেলদার সরদার, স ম আশরাফ আলী, সন্তোষ কুমার সরকার, নিরাপদ সরকার, লুৎফর রহমান সরদার, নূরুল মোমিন, আতিয়ার রহমান, আব্দুর রহমান দাদু, মাস্টার অজিয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান ও কাজী আবু হাসান (সউদ কাজী)। উপর্যুক্ত সকলের নেতৃত্বে দেবহাটায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তাই স্বাধীন বাংলা সংগ্ৰাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্ৰাম পরিষদ যৌথভাবে দক্ষিণ পারুলিয়ার একটি আমবাগানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। রাস্তা খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ।
এছাড়া ধোপাডাঙ্গার কার্তিক মিস্ত্রীর বাঁশবাগানে মুজাহিদ, ছাত্র ও যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। লুৎফর রহমান সরদার প্রশিক্ষণকর্মের তত্ত্বাবধান করেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকাসহ দেশের বড়বড় শহরে অপারেশন সার্চলাইট নামে নির্বিচারে গণহত্যা চালালে মোহাম্মদ শাহজাহান ও লুৎফর রহমান সরদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদ, ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করে যুদ্ধের জন্য তৈরী হওয়ার নির্দেশ দেন। থানা অফিসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)-র ৬ জন ইপিআর সদস্যকে বন্দি করে তাদের রাইফেলগুলো নিজেদের আয়ত্তে নেন। টাউন শ্রীপুর শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
১৯শে এপ্রিল গভীর রাতে জাতীয় পরিষদ সদস্য এম আব্দুল গফুর (পাইকগাছা) ও ইপিআর সুবেদার আইয়ুব আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন সশস্ত্র ইপিআর জওয়ান ও কতিপয় সংগ্রামী যুবনেতা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (বর্তমান সোনালী ব্যাংক) সাতক্ষীরা শাখায় অপারেশন চালিয়ে ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন। উক্ত টাকা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের পশ্চিমবঙ্গ বসিরহাট শাখায় জমা রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে এ অপারেশন ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা।
২৬শে এপ্রিল মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে মো. আব্দুর রহিম, আব্দুল ওহাব, জোবেদ আলী, মুনসুর আহমেদ (পারুলিয়া; ছাত্রনেতা), আতিয়ার রহমান, আফজাল হোসেন (বটিয়াঘাটা), মো. জামসেদ আলম, আব্দুল হামিদ ইঞ্জিনিয়ার, আব্দুল মাবুদ গাজী প্রমুখ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টাকি ও তকিপুর ক্যাম্পে যান। সেখান থেকে ২৫শে মে মো. জামসেদ আলমসহ কয়েকজনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে ভারতীয় সামরিক একাডেমিতে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণশেষে তাঁরা বিএলএফ-এ যোগ দেন। দেশে ফিরে তাঁরা ৯নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন।
দেবহাটা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- এ এফ এম এন্তাজ আলী (হিরারচক; ছাত্রনেতা ও সাতক্ষীরা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক), মোহাম্মদ শাহজাহান (মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেন; ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার নামে খ্যাত), আলী আহমেদ, লুৎফর রহমান সরদার (ধোপাডাঙ্গা; বামপন্থী নেতা), সনৎ কুমার সেন, আতিয়ার রহমান বিশ্বাস (পারুলিয়া), দেলদার সরদার, সন্তোষ কুমার সরকার, নিরাপদ সরকার, নূরুল মোমিন, আব্দুর রহমান দাদু, মাস্টার অজিয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান, কাজী আবু হাসান (সউদ কাজী), স ম আশরাফ আলী (পারুলিয়া; ছাত্রনেতা), মুনসুর আহমেদ (পারুলিয়া; ছাত্রনেতা), মো. আব্দুল মাবুদ গাজী (পারুলিয়া; ছাত্রনেতা), মোশাররফ হোসেন মশু (পারুলিয়া; ছাত্রনেতা), মো. আব্দুর রহিম (দেবহাটা), মো. জামসেদ আলম (খেজুরবাড়িয়া/পারুলিয়া) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ২০শে এপ্রিল সাতক্ষীরা আসে। সেখান থেকে ২২শে এপ্রিল কালিগঞ্জ যাওয়ার পথে দেবহাটার পারুলিয়াতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অজিয়ার রহমানকে গুলি করে হত্যা করে। কালিগঞ্জ থেকে ফেরার পথে পারুলিয়া বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। পরে তারা পারুলিয়া ব্রিজ, কুলিয়া ব্রিজ, দেবহাটা থানা ও শাঁখরা- কোমরপুর বিওপি অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী সাতক্ষীরায় আসার পর মুসলিম লীগ নেতা ডা. দিদার বখত খান (ডি বি খান)-এর নেতৃত্বে সাতক্ষীরা মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর অন্যতম সদস্য ছিল দেবহাটা থানার কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল গফফার। তার নেতৃত্বে দেবহাটা থানায়ও শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ১৮ই মে পারুলিয়া খালে ভারতগামী শরণার্থীদের নৌকায় পাকসেনারা মেশিনগানের গুলি চালায়। এতে শতাধিক লোক নিহত হয়।
এ ঘটনা পারুলিয়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। মে মাসের মধ্যভাগে স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর একটি দল হাদিপুর গ্রামের ঘোষপাড়ায় অতর্কিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার চালায়। ২৫শে অক্টোবর আব্দুল গফফারের পুত্র আব্দুল জলিলের সহযোগিতায় পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল সীমান্তবর্তী চৌবাড়িয়া, বৈচনা ও শ্রীরামপুর গ্রামে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ১৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং বহু লোককে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তারা গ্রামগুলোর বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারা সখিপুর গ্রামের অনেক হিন্দুবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং পাকাবাড়িগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এছাড়া পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন সময়ে পারুলিয়া, নওয়াপাড়া, ধোপাডাঙ্গা, খেজুরবাড়িয়া, বালিয়াডাঙ্গা, কুলিয়া, হাজিপুর, জগন্নাথপুর, পুষ্পকাটি ও কোমরপুর গ্রামের ১৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তারা হলেন- অজিয়ার রহমান (পারুলিয়া), রমজান আলী গাজী (নওয়াপাড়া), জাকের আলী, আবদুস ছাত্তার ওরফে গুলি ছাত্তার (ধোপাডাঙ্গা), আবদুল মালেক (খেজুরবাড়িয়া), পুটে খোকা (পারুলিয়া); জোহর আলী (সখিপুর বাজার), শহীদুজ্জামান সরদার শহীদ, কামরুজ্জামান, মনিরুজ্জামান সরদার (বালিয়াডাঙ্গা), দীন ইসলাম, জাহান বকস জানু, মোহাম্মদ আলী (কুলিয়া), নরেন ঘোষ, পাগলা ঘোষ (হাজিপুর), গোপীনাথ ঘোষ (জগন্নাথপুর), আবদুস সোবহান (পুষ্পকাটি), গৌর চন্দ্র পাগল (কোমরপুর) এবং এজাহার আলী (পারুলিয়া)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল ৯ নং সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তাঁর অধীনে সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ✉ মাস্টার, ক্যাপ্টেন এম এন হুদা, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আলম বেগ ও লেফটেন্যান্ট সামসুল ড্র আরেফিন। এঁদের নেতৃত্বে দেবহাটা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, পারুলিয়া ব্রিজ অপারেশন, ভাতশালা যুদ্ধ ও কুলিয়া ব্রিজ যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে ৭ই জুন সংঘটিত টাউন শ্রীপুর যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন (দেবহাটার বাইরেসহ) এবং ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৫ই আগস্ট লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে পারুলিয়া ব্রিজ অপারেশনে ৪ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ব্রিজটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ১৭ই অক্টোবর ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে সংঘটিত ভাতশালা যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৫ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা, লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আলম বেগ ও ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের যৌথ নেতৃত্বে সংঘটিত কুলিয়া ব্রিজযুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন (দেবহাটার বাইরেসহ)। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দিলে অবশিষ্ট পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এছাড়া বেলেডাঙ্গা, পুষ্পকাটি প্রভৃতি স্থানেও পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ৬ই ডিসেম্বর দেবহাটা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। দেবহাটার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— লোকমান হোসেন গাজী (নওয়াপাড়া), আবুল কাসেম মণ্ডল (দেবহাটা), আব্দুল ওহাব (কোঁড়া; খানজিয়া বিওপি-তে পাকসেনাদের পাতা মাইন বিস্ফোরণে শহীদ) এবং গোলজার হোসেন সরদার (পিতা রাহাতুল্লাহ সরদার, দক্ষিণ কুলিয়া; অক্টোবর মাসে ভাতশালা যুদ্ধে শহীদ)।
দেবহাটায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম মণ্ডলের নামে ১৯৮৬ সালে পারুলিয়াতে একটি পার্ক স্থাপন করা হয়েছে, যার নাম ‘শহীদ কাসেম পার্ক”। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নামে ধোপাডাঙ্গার মোড় থেকে দেবহাটা থানা হেডকোয়ার্টার্স পর্যন্ত ১০.৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের নাম ‘ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার সড়ক’ রাখা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান সরদারের নামে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের মাঝামাঝি সখিপুর বাজার থেকে ধোপাডাঙ্গা পর্যন্ত সড়কের নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান সড়ক’ রাখা হয়েছে (২০০৮ সালের ৬ই অক্টোবর ফলক উন্মোচন করা হয়)। এছাড়া তাঁর নামে শহীদ কাসেম পার্কে ‘মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান সরদার মঞ্চ’ তৈরি করা হয়েছে। [সিরাজুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!