মুক্তিযুদ্ধে দেবীগঞ্জ উপজেলা (পঞ্চগড়)
দেবীগঞ্জ উপজেলা (পঞ্চগড়) দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। এর উত্তরে বোদা ও পঞ্চগড় সদর, দক্ষিণে বীরগঞ্জ, খানসামা ও নীলফামারী সদর, পূর্বে ডোমার উপজেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমে ঠাকুরগাঁও ও বোদা উপজেলা।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের রায় বানচাল করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র শুরু করলে সারাদেশের মতো ঠাকুরগাঁও মহকুমার প্রতিটি থানা শহর ও হাট-বাজারের মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকে এ দূরবর্তী জনপদও উত্তাল হতে থাকে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সম্মুখে এবং ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর দেবীগঞ্জের ছাত্র-জনতার মাঝে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত প্রতিটি কর্মসূচি দেবীগঞ্জ থানা সদর ও বিভিন্ন ইউনিয়নে পালিত হতে থাকে। ৩রা মার্চ এখানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় ৷ প্ৰায় প্রতিদিন বড়বড় মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দেবীগঞ্জে মোশারফ হোসেন চৌধুরী এমএনএ, সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, কমর উদ্দীন আহম্মদ, সফিউল প্রধান ও অন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দিকনির্দেশনায় ছাত্র-জনতা স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের খবর সারাদেশের মতো এ অঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। থানায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও জয় বাংলা বাহিনী গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এ সকল সংগঠনের মূল দায়িত্বে থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ – – ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন বিভিন্ন যুব সংগঠন এবং পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ-সময় আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি সঠিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ অঞ্চলে কিছু নেতা-কর্মী এসব সংগঠনের সভাপতি, সম্পাদক, আহ্বায়ক, সদস্য অথবা সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। দেবীগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনার দায়িত্ব পান নূরুল হক প্রধান এবং লুৎফর রহমান। এছাড়া নুরুল ইসলাম রেনু, আব্দুল লতিফ, ডা. রাহিমুল ইসলাম প্রমুখ অত্যন্ত সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। দেবীগঞ্জে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের স্বদেশ চন্দ্র রায়, আব্দুল মজিদ, সফিউল আলম সাবদার, আব্দুল মালেক চিশতি এবং ছাত্র ইউনিয়নের আ কা মনিরুল ইসলাম, আনোয়ারুল হক বাবুল, এনামুল হক প্রমুখ।
জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে দেবীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী কর্তৃক ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ বার্তা ২৬শে মার্চ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেবীগঞ্জে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার কার্যক্রম শুরু হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে সকলের প্রতি ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার’ আহ্বান জানান। ১০ই মার্চ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেবীগঞ্জ বাজার এবং ভূমি অফিসের সামনে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৩শে মার্চ সর্বত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরিস্থিতির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং জনতাকে নিত্য নতুন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। ২৫শে মার্চের পর দেবীগঞ্জের সকল সমাবেশ ও মিছিলে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এ উদ্দীপনাময় স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। থানার সংগ্রামী ছাত্র-জনতা সর্বাত্মক যুদ্ধ-প্রস্তুতি শুরু করে। প্রস্তুতি পর্ব এগিয়ে নিতে মোশারফ হোসেন চৌধুরী এমএনএ, সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, কমর উদ্দীন আহম্মদ, সফিউল প্রধান, নুরুল হক প্রধান, লুৎফর রহমান, মঞ্জুরুল ইসলাম রেনু, আব্দুল লতিফ, ডা. রাহিমুল ইসলাম, স্বদেশ চন্দ্র রায়, মনিরুল ইসলাম, এনামুল হক, আনোয়ারুল হক, বাদল, সফিউল আলম সাবদার, আবুল খায়ের ভূইঞা প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। দেবীগঞ্জের ছাত্র-যুবকরা প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইপিআর সদস্য আব্বাস প্রশিক্ষণ কাজে বিশেষ সহযোগিতা করেন। ফাঁড়িগুলোতে অবস্থানরত বাঙালি ইপিআর এবং মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরাও এ দায়িত্বে নিয়োজিত হন। প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দেবীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে দেরাদুনসহ ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
দেবীগঞ্জে মো. খাজা, আপিল প্রমুখ মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ-এর কমান্ডার ছিলেন স্বদেশ চন্দ্র রায়।
দেবীগঞ্জ এলাকায় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ-প্রচেষ্টার এক উল্লেখযোগ্য দিক হলো হাজারো মানুষের রাস্তায় নেমে আসা এবং হানাদারদের অগ্রযাত্রা রোধে শতশত ব্যরিকেড গড়ে তোলা। ঢাকায় ২৫শে মার্চ রাতের হত্যাকাণ্ডের পর এ এলাকার ইপিআর-এর বাঙালি ও অবাঙালি সদস্যদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস গভীরতর হয়। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ইপিআর-এর কুঠিবাড়ি ও ঠাকুরগাঁও হেডকোয়ার্টার্সের বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করেন। ২৮শে মার্চ রাতে সুবেদার মেজর কামিজ উদ্দিন, সুবেদার হাফিজ প্রমুখের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়নে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ৩০শে মার্চের মধ্যে বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে অবস্থানরত ইপিআর-এর অবাঙালি সদস্যরা আটক বা নিহত হন। অনুরূপ ঘটনা দেবীগঞ্জের আশপাশের ফাঁড়িগুলোতেও ঘটে। ফলে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা বাঙালি সেনা ও জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এরপর সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি সৈয়দপুরের দিকে বাঙালি সেনা ও জনতা অগ্রসর হয়। এ অভিযানে অংশ নিতে দেবীগঞ্জ থেকেও আনসার, মুজাহিদ সদস্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনতা ঠাকুরগাঁও-এ গিয়ে সমবেত হতে থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন ঠাকুরগাঁও মহকুমার থানাগুলোকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে রণকৌশল প্রণয়ন করেন। তিনি চিলাহাটির ‘ই’ কোম্পানির নায়েক সুবেদার বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে মুজাহিদ ও ইপিআর-এর সমন্বয়ে একটি কোম্পানিকে দেবীগঞ্জে প্রেরণ করেন। এছাড়া দেবীগঞ্জ-সৈয়দপুর রুটের খানসামা, জয়গঞ্জ, ঝাড়বাড়ি হয়ে বীরগঞ্জ পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুর অভিমুখী সম্মিলিত শক্তি এক পর্যায়ে সৈয়দপুরের কাছাকাছি চম্পাতলী পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়। এ-সময় সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি দেবীগঞ্জ-বীরগঞ্জ রুটের খানসামা এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরোধব্যূহ সৃষ্টি করে।
ভারতীয় বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ৩১শে মার্চ রাতে সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের সঙ্গে ভারতের ৭৫ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল ব্যানার্জীর যোগাযোগ ও আলোচনা হয়। এরপর কর্নেল ব্যানার্জী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করে কিছু পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।
বৃহত্তর দিনাজপুর এলাকায় বাঙালি সেনা ও জনতার প্রতিরোধ দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে চম্পাতলী, দশমাইল, ভাতগাঁও ব্রিজ এসব স্থানে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এক সময় মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরক্ষাব্যূহ ছেড়ে পিছিয়ে আসতে হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঠাকুরগাঁও শহর পাকসেনাদের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং তারা আরো উত্তর দিকে এগুতে থাকে। এরকম অবস্থায় মুক্তিবাহিনী পঞ্চগড় শহরের করতোয়া ব্রিজকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ১৯শে এপ্রিল পঞ্চগড় শহরের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে মুক্তিবাহিনী আরো পিছিয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুরস্থ করতোয়া ব্রিজকে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অন্যদিকে পাকবাহিনী পঞ্চগড় পেরিয়ে অমরখানা নামক স্থানকে তাদের সর্বশেষ ডিফেন্স হিসেবে গড়ে তোলে। এখানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়।
পাকবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন এলাকা অধিকৃত হতে থাকলে দেবীগঞ্জে তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে জয়গঞ্জ ও খানসামায় ডিফেন্স গড়ে তোলা হয় ৷ খানসামা নদী পার হওয়ার সময় সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে অচিরেই পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে এ প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। মুক্তিবাহিনী এরপর দেবীগঞ্জে এবং করতোয়া নদীর পশ্চিমে সমিতির ডাঙ্গা এলাকায় ডিফেন্স গড়ে তোলে। কিন্তু এ ডিফেন্সও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দেবীগঞ্জ কার্যত অরক্ষিত হয়ে যায়। ১৯শে এপ্রিল পঞ্চগড় শহরে পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে দেবীগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে গিয়ে পুনরায় সংঠিত হতে ও আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।
প্রতিরোধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে দেবীগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল কাদেরের নাম। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি সংগ্রামের শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পরে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তিনি শহীদ হন।
১৯শে এপ্রিলের পর পাকবাহিনী দেবীগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। ১৯৭১-এ বর্তমান করতোয়া সেতুর অস্তিত্ব ছিল না। নদী পারাপারের মাধ্যম ছিল নৌকা। পাকবাহিনী নদীর পশ্চিমে লক্ষ্মীরহাটে এবং পূর্বদিকে দেবীগঞ্জ-ডোমারের মাঝামাঝি দোসীমানা এলাকায় তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। নদীতীরের বেশ কয়েকটি এলাকায় রাজাকাররা অবস্থান নেয়। শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড ইত্যাদি সংগঠন ও সংস্থার নামে স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। দেবীগঞ্জ থানা শহরে পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না। দেবীগঞ্জের কাছাকাছি পূর্বদিকে দোসীমানায় পাকবাহিনীর ক্যাম্প ও কিছু বাংকার ছিল। হানাদাররা প্রধানত নিকটবর্তী ডোমার, চিলাহাটি এবং বোদার পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে দেবীগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করত৷
দেবীগঞ্জে পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিল- সওকত আলী, মছির উদ্দিন (জামায়াত নেতা; সেক্রেটারি, শান্তি কমিটি), হানিফ মাস্টার, হামিদ বসুনিয়া, সৈয়দ খলিফা (ব্যবসায়ী), তাইয়ার প্রধান, খয়রুল প্রধান, হুদা প্রধান, নছির কবিরাজ, হারুন সরকার, তরিকুল ইসলাম, কাওসারুল, দমিজ উদ্দিন, মুশতাক হোসেন, নুরুল হক (পালি), সেরাজুল ইসলাম (পালি), আজিজুর রহমান (পালি), জয়নাল মুনশী (পালি), মতিয়ার রহমান (পালি), দেলোয়ার চৌধুরী (কালুরহাট, ব্যবসায়ী), রহমান আলী (সোনাহার), আবুল কাশেম মাস্টার (সোনাহার), হালিম বসুনিয়া (টেপ্রীগঞ্জ), ফুসিয়ার রহমান (সোনাপুতা), নজরুল ইসলাম সরকার (রামগঞ্জ) প্রমুখ।
রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ছিল- মালেক ভূঁইয়া, একরামুল হক, আব্দুল গণি, তসবির আহমদ, মোতাহার হোসেন, নুরুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক, দেলোয়ার হোসেন, ফয়জুল ইসলাম, আব্দুল গফুর, মকবুল হোসেন, জমির উদ্দিন, কবির উদ্দিন, নুর রহমান, মনছুর আলী, আব্দুল খালেক, লতিফ সিপাহি (ভাউলাগঞ্জ), ছুটু মিয়া (ভাউলাগঞ্জ), আব্দুল মজিদ (ভাউলাগঞ্জ), আব্দুর রহমান (দেবীডুবা), সামসুর রহমান (দেবীডুবা), আহেজ উদ্দিন (দেবীডুবা), তসিত উদ্দিন (দেবীডুবা), নাজিমুদ্দিন (দেবীডুবা), লুৎফর রহমান (পালি), আলাউদ্দিন (পালি), নুরুল হক (পালি), আনোয়ার হোসেন (হাজরাডাংগা), আব্দুল করিম (নতুন বন্দর), আমিনুর রহমান (নতুন বন্দর), আবের আলী (নতুন বন্দর), আক্কাস আলী (নতুন বন্দর), হিকমত আলী (নতুন বন্দর) প্রমুখ।
পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড (পিএনজি)-এর সদস্যদের মধ্যে ছিল— হবিবর রহমান (দেবীগঞ্জ), নূর নবী মানিক (দেবীগঞ্জ), আতিয়ার রহমান (দেবীগঞ্জ), আব্দুর রাজ্জাক (দেবীগঞ্জ), মইনুর রহমান (দেবীগঞ্জ), আবুল হোসেন (দেবীগঞ্জ), নবাব আলী (কমান্ডার, কোনপাড়া), আবু ইব্রাহীম (দেবীডুবা) প্রমুখ।
উত্তরাঞ্চলের মহুকুমা শহর ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন থানা শহর পাক হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারা নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে। হাজার-হাজার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। অনেকে সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় আশ্রয় নেয়। পলায়নরত মানুষ পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসরদের দ্বারা বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে হামলা ও লুণ্ঠনের শিকার হয়। দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা, টেপরিগঞ্জ ও খয়ের বাগান এলাকায় এরূপ বহু ঘটনা ঘটে।
প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদেরকে পাকসেনারা তাদের দোসরদের সহযোগিতায় খুঁজে বের করে এবং তিস্তাঘাট এলাকায় তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ঠাকুরগাঁও শহরে পাকসেনাদের অনুপ্রবেশের পর সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে দেবীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান একজন ইপিআর সদস্যকে নিয়ে মোটর সাইকেলে ঠাকুরগাঁও যান। পাকবাহিনী তাঁদের আটক ও হত্যা করে। এলাকায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে দেবীগঞ্জের হিন্দু-প্রধান এলাকার শতশত পরিবার ভারতে চলে যায়। এসব পরিবারের অনেকে সীমান্তে যাওয়ায় পথে রাজাকারদের কাছে নিজেদের সর্বস্ব হারায়।
বর্তমান করতোয়া ব্রিজের উত্তরে সোনাপোতা নামক স্থানে পাকবাহিনীর দোসররা একটি বড় হত্যাকাণ্ড ঘটায়। হত্যার স্থানটি বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন। সোনাপোতা গণহত্যায় বহু মানুষ প্রাণ হারান।
নভেম্বর মাসে দেবীগঞ্জের ডিয়াগাড়িতে পাকবাহিনী ৪০ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। ২ডিয়াগাড়ি গণহত্যা-র সময় স্থানীয় রাজাকাররা পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা দেবীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। শালডাঙ্গা ইউনিয়নের একজন নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। রাজাকার শওকত আলীর নেতৃত্বে অত্র এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া পাকবাহিনীর দোসরদের দ্বারা স্থানীয় হিন্দু ও আদিবাসী সম্প্রদায়সহ সাধারণ জনগণের গরু-ছাগল ও বাড়িঘরের মালামাল লুটপাটের ঘটনা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।
৮ই ডিসেম্বর দেবীগঞ্জে একটি বিজয় মিছিল বের হলে পাকবাহিনীর ছোড়া কয়েকটি মর্টার শেল মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর এসে পড়ে। শেলের বিস্ফোরণে দেবীগঞ্জ কৃষিফার্মের কর্মচারী নশু মিয়া ঘটনাস্থলে শহীদ হন। এ ঘটনার পর যৌথ বাহিনী করতোয়া নদী অতিক্রম করে দেবীগঞ্জ সদরে অবস্থান নেয়।
উত্তরাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করার পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সেনা সমাবেশের বড় অংশ ছিল পঞ্চগড় শহর এবং এর চারপাশের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পয়েন্টে। দেবীগঞ্জ সদর এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল প্রধানত রাজাকারদের। লক্ষ্মীরহাট ও দোসীমানার পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। ভারত অভিমুখী শরণার্থী এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষের ওপর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। দেবীগঞ্জের শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ওমরখানায় পাকসহযোগীদের একটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী অনেককে এখানে নির্যাতন করা হয়। বহু নারী এ কেন্দ্রে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
বর্তমান করতোয়া ব্রিজের উত্তর দিকে সোনাপোতা নামক স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু লোককে হত্যা করা হয়। স্থানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। করতোয়ার পশ্চিম তীরবর্তী সমিতির ডাঙ্গা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বিভিন্ন সময়ে অনেককে হত্যা করে। জমাদারপাড়া গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মালেক ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদের কবর রয়েছে। দেশের সর্ব-উত্তরে পাকবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনার বড় অংশ ছিল পঞ্চগড় শহরকে কেন্দ্র করে। নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখতে তারা এ শহরে এবং এর পশ্চিমে, পূর্বে ও উত্তরে বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অনেক শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। মুক্তিবাহিনীও এ ঘাঁটিগুলোকে তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রেখে যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উভয় পক্ষের এরূপ কৌশলের কারণে এ এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে তুলনায় দেবীগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ কম হয়।
দেবীগঞ্জের উত্তরে চিলাহাটি সীমান্তের ওপারে ভারতীয় বিএসএফ হেমকুমারি ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে হেমকুমারি গেরিলা ইউনিট গঠন করে। ঘোরামারা নদীর ওপারে সাকাতি এলাকায় এ ইউনিটের সদস্যরা তাঁদের হাইডআউট গড়ে তোলেন। চাউলহাটি ইউনিটের বিভিন্ন হাইডআউটের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ ছিল। দেবীগঞ্জের উত্তর দিকের বিভিন্ন এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী বোদা, চিলাহাটি ও ডোমারের বেশকিছু এলাকা এ ইউনিটের অপারেশনের আওতাভুক্ত ছিল। এ গেরিলা দলের ধারাবাহিক ও সফল তৎপরতায় এলাকার রাজাকার ও অন্য পাক সহযোগীরা কোণঠাসা ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পার্শ্ববর্তী চিলাহাটি ঘাঁটিতে অবস্থানকারী পাকসেনারাও উদ্বিগ্ন হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জমাদারপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের হাইডআউটে পাকবাহিনী আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে হাইডআউটের ঘরগুলোতে হানাদার পাকবাহিনী আগুন লাগিয়ে দিলে আত্মগোপনকারী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার শরীর আগুনে ঝলসে যায়। জমাদারপাড়া যুদ্ধ-এ মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দলের কমান্ডার আব্দুল মালেক (কুমিল্লা)-সহ দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শ্যামাকান্ত বর্মণ (পিতা টেসিং বর্মণ, পামুলি), নিদেবীগঞ্জ শিকান্ড বর্মণ (পালি), চপাই মোহন বর্মণ (পিতা হরনারায়ণ বর্মণ, পামুলি), কালটাং বর্মণ (পিতা মতিরাম বর্মণ, পামুলি), প্ৰফুল্ল চন্দ্র বর্মণ (পিতা পত্রমোহন বর্মণ, পামুলি), কাচু মোহাম্মদ (রামগঞ্জ), সুবোধ বর্মণ (সুন্দরদিঘী), নুরুল হক সরকার, শেখ বাধা (দেবীগঞ্জ), আব্দুল কাদের (পিতা শেখ বাধা), আব্দুল মান্নান (নতুন বন্দর, দেবীগঞ্জ) ও ও আব্দুল মজিদ। এছাড়া পঞ্চগড়ের বাইরের দুজন মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হন। তাঁরা হলেন কমান্ডার আব্দুল মালেক (কুমিল্লা) এবং আব্দুল কাদের (দেবীগঞ্জের ওসি; বাড়ি সিরাজগঞ্জ)।
২৯শে নভেম্বর পঞ্চগড় শহর শত্রুমুক্ত হয়। এ-সময় পঞ্চগড়ের পূর্বদিকে চিলাহাটি সীমান্ত হয়ে মিত্রবাহিনী-র একটি কোম্পানি দেবীগঞ্জ-করতোয়া নদীর পশ্চিমে অবস্থান গ্রহণ করে। এছাড়া কাছাকাছি এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় ডিসেম্বরের শুরুতেই দেবীগঞ্জ থানা সদর কার্যত পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে যায়। তবে পূর্বদিকের দেবীগঞ্জ-ডোমার সড়কে পাক-প্রতিরক্ষা তখনো বহাল থাকায় বিক্ষিপ্তভাবে গোলা ও শেল নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে। ৯ই ডিসেম্বর দেবীগঞ্জের পূর্বদিকের অবস্থান থেকেও পাকবাহিনী সরে যায় এবং এদিন দেবীগঞ্জ সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত হয়।
প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক থানার ওসি আব্দুল কাদের পাকবাহিনীর হতে শহীদ হলে তাঁর লাশ দেবীগঞ্জ তিস্তার হাট এলাকায় সমাহিত করা হয়। এখানে তাঁর নামাঙ্কিত একটি ফলক রয়েছে। এছাড়া তিস্তারহাট থেকে দেবীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি আব্দুল কাদের সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। দেবীগঞ্জ নতুন বন্দর থেকে ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত সড়কের নাম দেয়া হয়েছে শহীদ আব্দুল মান্নান সড়ক। [শফিকুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড