You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দেবীদ্বার উপজেলা (কুমিল্লা)

দেবীদ্বার উপজেলা (কুমিল্লা) বৃহত্তর কুমিল্লার রাজনীতি সচতেন জনগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। ফলে জাতীয় এবং প্রাদেশিক উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এ নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা টাউন হলে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে তার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। সারা দেশের মতো কুমিল্লারও সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ৩রা মার্চ সংসদ অধিবেশন বন্ধ করার প্রতিবাদে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শাহ আলমের সভাপতিত্বে টাউন হলে এক ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্রদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয়। অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ-র সভাপতিত্বে এডভোকেট আহমদ আলী এমপিএ এবং ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদ এমপিএ-এর বাসায় দুদিন সভা বসে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুমিল্লার সর্বত্র বঙ্গবন্ধু ঘোষিত হরতালের কর্মসূচি সর্বাত্মকভাবে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর সারা দেশবাসীর মতো কুমিল্লার মানুষও বুঝতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। সে লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর আহ্বানে কুমিল্লায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। একই সময় মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ন্যাপ (ভাসানী) ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কুমিল্লা শাখা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অসহযোগ আন্দোলন পরিত্যাগ করে গেরিলা লড়াইয়ের আহ্বান জানায়। এভাবে সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্ষেত্র তৈরী হয়। একই সঙ্গে দেবীদ্বারের মানুষও আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আজমের একান্ত সচিব আবদুল মান্নান সরকার ২৭শে মার্চ থেকে এয়ারগান আর লাঠি দিয়ে প্রায় ৪-৫শ মুক্তিকামী জনতাকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত আবু মিয়া এবং মুকবল আহমেদ। দেবীদ্বার ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতে যাতায়াত ছিল। ক্যান্টনমেন্ট কাছাকাছি হওয়ায় এতে ঝুঁকিও ছিল অনেক। তবে গভীর জঙ্গলে অবস্থিত নলআরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প কিছুটা নিরাপদ ছিল। এ ক্যাম্প থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে অনেকে ত্রিপুরার বক্সনগর ও পালাটোনা ক্যাম্প এবং আসামের লোহারবন ও মেলাগড় প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে আফসুরুদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকারদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে নিরাপত্তার কারণে নলআরা ক্যাম্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
মুজিবনগর সরকার-এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বাড়ি এ উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। সেই সূত্রে সেখানে একটি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিলেন শিক্ষক মুস্তাকুর রহমান (ফুল মিয়া)। তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ভারতের তেজপুর ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে এলাহাবাদ ক্যাম্পের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। নাছির উদ্দিন জুয়েল, সৈয়দ আহমেদ বাকের (ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক), ডা. আবু আইয়ুব হামিদ, মির্জা ইয়াহিয়া (কাপ্তানবাজার, কুমিল্লা), গোলাম ফারুক, ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান মুন্সী (মাশিকাড়া), আওলাদ হোসেন মুন্সী (মাশিকাড়া), আবদুল হালিম মুন্সী (মাশিকাড়া), মুস্তাকুর রহমান ফুল মিয়া ভূঁইয়া প্রমুখ এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এখানে ১৭৭ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যাঁরা দেবীদ্বার ও আশপাশ এলাকায় শত্রুসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। পার্শ্ববর্তী শুভপুর গ্রামেও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন প্রবীণ শিক্ষক রঞ্জিত কুমার পাল (কমিউনিস্ট নেতা), কমরেড হরিমোহন দাস এবং সাদেক মিয়া মাস্টার।
দেবীদ্বার উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন— অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমরেড আব্দুল হাফেজ (ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য), ক্যাপ্টেন সুজাত আলী (ভারতের পালাটোনা ক্যাম্প প্রধান), আব্দুল আজিজ খান (সাবেক সংসদ সদস্য), আজগর হোসেন মাস্টার, নাছির উদ্দিন জুয়েল প্রমুখ। কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন জয়নাল আবেদীন (পিতা বাদশা মিয়া, বারুর) এবং ট্রুপস কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোসলেম উদ্দিন (উঞ্জুটি)।
২৫শে মার্চের পর থেকেই দেবীদ্বারের মুক্তিকামী জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৩১শে মার্চ তাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়, যা ভিংলাবাড়ি- জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৫ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন ও কয়েকজন আহত হন। দেবীদ্বার সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট অবস্থিত। এখান থেকে পাকবাহিনী উত্তরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক এবং পশ্চিমে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক ধরে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালাত। জুন মাসে তারা রাজাকারদের সহযোগিতায় দেবীদ্বার সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কোম্পানীগঞ্জ খাদ্য গুদাম, রসুলপুর এবং চান্দিনা থানা সদরে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পগুলো থেকে পাকসেনা ও রাজাকাররা দেবীদ্বারের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অত্যাচার-নির্যাতন চালায়।
দেবীদ্বার উপজেলায় মুসলিম লীগ (কাইউম ও কাউন্সিল), কনভেনশন মুসলিম লীগ জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- এডভোকেট নুরুল ইসলাম খান (কাউন্সিল মুসলিম লীগের সাবেক এমপি), আজিজুর রহমান (কনভেনশন মুসলিম লীগ), মো. শহীদুল্লাহ ওরফে সোনা মিয়া মাস্টার (জামায়াতে ইসলামী; জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনের সাবেক প্রধান শিক্ষক), মাওলানা মাজহারুল হক (নেজামী ইসলামী) প্রমুখ। পাকবাহিনীর সহযোগিতার জন্য এরা রাজাকার ও আলবদর বাহিনী এবং শান্তি কমিটি গঠন করে। এ দুটি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল কালিকাপুরের আফরসুরুদ্দিন রাজাকার, নাগাইশের আলী আহাম্মদ, রসুলপুরের অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম, রাজাকার লিল মিয়া ওরফে লিলু ডাকাত, উঞ্জুটির আ. লতিফ মাস্টার, দেবীদ্বারের শরাফত আলী, কানু মিয়া, ছোট আলমপুরের আশ্রব আলী, সব্দর আলী, হাবিবুর রহমান ওরফে হবিউল্লাহ চকিদার, বাঙ্গুরীর মোহাম্মদ আলী (উপজেলা শান্তি কমিটির সভাপতি), ভিংলাবাড়ির লাল মিয়া চেয়ারম্যান, শালঘরের মতিন চেয়ারম্যান, ধামতীর এডভোকেট সৈয়দ আহমেদ, সাফিউদ্দিন, বাচ্চু মিয়া প্রমুখ। এলাকায় রাজাকার বাহিনী খুবই প্রভাবশালী ছিল। এছাড়া উপজেলার বিজলীবাজার গ্রামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নীলনকশা প্রণয়নকারী ছিলেন।
২৪শে জুলাই পাকবাহিনী মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের উত্তর ও দক্ষিণ বাখরাবাদ গ্রামের ১৪৩ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা বাখরাবাদ গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন তারা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর নারীদের সম্ভ্রম হরণের পর ২৩ জন যুবককে দেবীদ্বার উপজেলা সদরের দিকে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে ৩ জনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ২০ জনকে উপজেলা সদরের ডাক বিভাগের দক্ষিণ পার্শ্বে এনে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে ঐ গর্তের পার্শ্বে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ব্রাশ ফায়ার করে। একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও বাকি ১৯ জনের লাশ ওই গর্তে মাটিচাপা দেয়া হয়। এ ঘটনা দেবীদ্বার সদর গণহত্যা নামে পরিচিত। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী উপজেলার ললিতাসার গ্রামে হামলা চালিয়ে নারীধর্ষণ ও লুটপাট শেষে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয় এবং ৭ জনকে হত্যা করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট নিকটবর্তী হওয়ায় এবং রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের তৎপরতার কারণে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দেবীদ্বার উপজেলা ছিল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তবে মহেশপুর গ্রামটি তুলামূলকভাবে নিরাপদ ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুরাদনগরসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন নিরাপত্তার জন্য চ মহেশপুর গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে চলে যায়। ১২ই সেপ্টেম্বর মুরাদনগর উপজেলার বাইরা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর বেশকিছু সংখ্যক নারী ভারতে যাওয়ার জন্য মহেশপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সিএন্ডবি ব্রিজ পার হওয়ার সময় দেবীদ্বার উপজেলার রাজাকার লিল মিয়া এবং মুরাদনগর উপজেলার বাইরা গ্রামের ফুল মিয়ার নেতৃত্বে একদল রাজাকার তাদের আটক করে এবং টাকা-পয়সা, গহনা ও মূল্যবান সামগ্রীসহ সবকিছু লুট করে নেয়। সম্ভ্রম রক্ষার জন্য হতভাগ্য নারীরা মহেশপুরে যাবার জন্য রওনা হলে একদল রাজাকার তাদের পিছু নেয়। মহেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছাকাছি পৌঁছলে রাজাকাররা তাদের বলপূর্বক ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। তখন স্থানীয় জনগণ রাজাকারদের বাঁধা দেয় এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ৩ জন রাজাকারকে হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রাজাকারদের প্ররোচনায় পাকবাহিনী ১৭ই সেপ্টেম্বর মহেশপুরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নির্যাতন চালায়। এদিন পাকবাহিনীর হাতে ১৪ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন, যা মহেশপুর গণহত্যা নামে পরিচিত।
৬ই অক্টোবর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর নেতৃত্বে রামপুর গ্রামের মাধাইয়া বাজারের সন্নিকটে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা রামপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। এ গণহত্যায় মরিচা হাইস্কুলের হেড মৌলভী মওলানা আবদুর রহিমসহ বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। ১৬ই অক্টোবর পাকবাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভানী ও রাজামেহার এলাকায় হামলার প্রস্তুতি নেয়। এ সংবাদ জানতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা মূল প্রবেশ পথে মাইন পুঁতে রাখেন। ঘটনার দিন শত্রুসেনারা একটি গাড়ি বহর নিয়ে ওই এলাকায় প্রবেশ করার সময় মাইন বিস্ফোরণে ৭ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে পাকবাহিনী ঘটনাস্থলের আশপাশের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকার বাড়িঘর সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়। উপজেলার ভূষণা ও ধামতী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ঘাঁটি ছিল। ২৯শে নভেম্বর পাকবাহিনীর এক বিশাল বহর ভূষণা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হলে পাকসেনারা গ্রামের ১৬টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং মোহম্মদ আলী, আব্দুল গফুর, আব্দুল বারেক, আব্দুস সামাদ ও সোনা মিয়া নামে পাঁচজন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহতদের কবর অযত্ন- অবহেলায় পড়ে আছে। উল্লেখ্য যে, ২৫শে মার্চ রাতে ভূষণা গ্রামের সেকান্দর আলীকে ময়নামতি সেনানিবাসে কর্মরত অবস্থায় পাকসেনারা হত্যা করে। তিনি সেখানে লন্ড্রিতে কাজ করতেন। একই দিন পাকবাহিনী ধামতী গ্রামের বিখ্যাত চৌধুরী বাড়িসহ ৯০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং ধামতী আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলিম উদ্দিন পীর সাহেবের পৌত্র সহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ হালিম হুজুরের ভাগ্নে জোহর আলী ও আব্দুল বারী, সহোদর দুই ভাই তাজুল ইসলাম ও নজরুল ইসলামকে তাঁদের স্বজনদের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই তরুণদের কবর এখনো পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পাকবাহিনী কোম্পানীগঞ্জের গোমতী নদীর পাড়ের খাদ্যগুদাম ক্যাম্প, রসুলপুর ক্যাম্প এবং চান্দিনা সদরের ক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। রাজাকারদের সহায়তায় তারা বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক নিরীহ নারী-পুরুষকে ধরে এনে খাদ্যগুদামে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহতদের লাশ কখনো মাটিচাপা দেয়া হয়েছে, কখনো বা গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই এটি কোম্পানীগঞ্জ খাদ্যগুদাম বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে পরিচিত। রসুলপুর ক্যাম্পটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে অবস্থিত। এখানে ব্যাপক নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কুখ্যাত রাজাকার লিল মিয়া, আব্দুল মতিন চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামের নেতৃত্বে নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। চান্দিনা ক্যাম্পটি ছিল নির্যাতন, হত্যা, নারীধর্ষণ ও লুটপাটের মালামাল মজুদের কেন্দ্র। ৭ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ক্যাম্পটি দখল করে এবং ক্যাম্প থেকে প্রায় ১২শ পাকসেনা ও ৩০০ রাজাকারকে আটক করে।
দেবীদ্বার উপজেলায় আরেকটি গণকবর আছে- দেবীদ্বার সদর গণকবর। ২৪শে জুলাই পাকবাহিনী এখানে ১৯ জন যুবককে হত্যা করে একটি গর্তে কবর দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেবীদ্বারে ১৭৭জন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত তেজপুর ক্যাম্পের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশের অভ্যন্তরে থেকে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। এ বাহিনীর কার্যক্রম দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও একমাস অব্যাহত ছিল। পরে ক্যাম্পের অস্ত্রগুলো কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে জমা দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর দেবীদ্বার হানাদারমুক্ত হবার দিন পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো- বরকামতা যুদ্ধ দেবীদ্বার থানা আক্রমণ, বারুর যুদ্ধ, পোনরা গ্রামে নৌ-কমান্ডো অভিযান, রাজাকার নিধন অভিযান ও জাফরগঞ্জ যুদ্ধ। বরকামতা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৪ই এপ্রিল কমরেড আব্দুল হাফেজ ও আব্দুল হালিম (পুলিশ)-এর নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্টরা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। দেবীদ্বার থানা অভিযান পরিচালিত হয় দুবার ২১শে মে এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। প্রথমবার অভিযানে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা জামাল হোসেন খোকন চৌধুরী (ধামতী)। এতে হাজীগঞ্জ থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টর পাকবাহিনীর ৬ জন পুলিশ নিহত হয় এবং পাকসেনাদের একটি ট্রাক ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় অভিযান পরিচালিত হয় কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে। অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সিও অফিসের দুটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন, তিনটি বাংলা ও দুটি ইংরেজি টাইপরাইটারসহ অন্যান্য মালামাল হস্তগত করেন। পরবর্তীতে সাইক্লোস্টাইল মেশিন টাইপরাইটারগুলো এলাহাবাদ ক্যাম্পে প্রচারপত্র, চিঠি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আইডি কার্ড তৈরীর কাজে ব্যবহার করা হয়। বারুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে। কিন্তু এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাই শহীদ হন। পোনরা গ্রামে নৌ-কমান্ডো অভিযান পরিচালিত হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর নৌকমান্ডার লেফটেন্যান্ট মো. ফজলুল হকের নেতৃত্বে। এতে নৌকমান্ডো আবু বকর সিদ্দিক ও সমরাস্ত্র বহনকারী সৈয়দ আলী শহীদ হন এবং ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। রাজাকার নিধন অভিযান পরিচালিত হয় অক্টোবর মাসে কমান্ডার সাদিম আলী, কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফিজুর রহমান ও মুস্তাকুর রহমান (ফুলমিয়া ভূঞা)-এর নেতৃতে। এতে কালিকাপুরের আফসু রাজাকার ও দেবীদ্বার গ্রামের শরাফত আলী রাজাকার নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ৭ জন সহযোগীকে আটক করে এলাহাবাদ ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। জাফরগঞ্জ যুদ্ধ সংঘটিত হয় অক্টোবর মাসের শেষদিকে জাফরগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আফসুকে ধরার জন্য। সুবেদার আফজলের নেতৃত্বে এ-যুদ্ধে রাজাকার বাহিনী পরাজিত ও বন্দি হয় এবং রাজাকার কমান্ডার আফসু নিহত হয়। যুদ্ধে অহিদুর রহমান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
দেবীদ্বার উপজেলা হানাদারমুক্ত হয় ৪ঠা ডিসেম্বর। ২ মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সিএন্ডবি ও কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল আর ডি ন হিরার নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এ অভিযান পরিচালিত হয়। – মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা হয়ে দেবীদ্বারে আসে। পাকবাহিনী ৩রা ডিসেম্বর রাতে দেবীদ্বার ছেড়ে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। ধীরে-ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবীদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবীদ্বার থেকে চান্দিনা হয়ে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার পথে মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬ জন সেনা শহীদ হন। চ পাকবাহিনীর ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদে ৪ঠা ডিসেম্বর ভোর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ এবং হাজার-হাজার জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে উপজেলা সদর অভিমুখে আসতে থাকে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করে তোলে উপজেলা সদর।
দেবীদ্বার উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- লাল মিয়া (পিতা ঝারু মিয়া, চরবাকর), মোহাম্মদ আলী মিয়া (পিতা ময়নাল হোসেন, বারুর), সফিকুল ইসলাম (পিতা রোছমত আলী, বারুর), শহিদুল ইসলাম (পিতা সুন্দর আলী, বারুর), জয়নাল আবেদীন (পিতা বাদশা মিয়া, বারুর; গ্রুপ কমান্ডার), মোহাম্মদ হোসেন (পিতা সুন্দর আলী, বারুর), ছামাদ মোল্লা (পিতা রজ্জব আলী, বারুর), নুরুল ইসলাম (পিতা সিরাজুল ইসলাম, রাম্পুর), শাহজাহান ভূঁইঞা (পিতা সিরাজ উদ্দিন ভূঁইঞা, গুনাইঘর), আলমগীর (পিতা সুন্দর আলী, সাহারপাড়), আব্দুল আজিজ (পিতা রজমুদ্দিন মাঝি, উজানীজোড়া), শহিদুল হক খান (পিতা আবিদ আলী খান, রাজামেহার), তাজুল ইসলাম (পিতা নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, ধামতী), আব্দুস সালাম (পিতা আব্দুল মজিদ, ফতেহাবাদ), আব্দুল হাফিজ (পিতা গণি মোল্লা, ভেলানগর), মজিবুর রহমান খান (পিতা হাজী আমজাদ হোসেন খান, ভিড়াল্লা), আব্দুস সামাদ (পিতা কেরামত আলী, সৎপুকুরিয়া), সিরাজুল ইসলাম (পিতা আব্দুর রাজ্জাক, ফতোবাদ), মতি মিয়া (পিতা আব্দুর রহমান, বাগমারা), মোবারক হোসেন ভূঞা (পিতা নজরুল ইসলাম ভূঞা, শাকতলা), আব্দুল বারেক খন্দকার (পিতা নাছির উদ্দিন খন্দকার, উজানীজোড়া), নায়েক আব্দুল কুদ্দুস (পিতা সিরাজুল ইসলাম, ধামতী), সাহেব আলী (পিতা – ছাদির বক্স, বারেরা), দফেদার আব্দুল মোমেন (পিতা সেকান্দর আলী, নোয়াবগঞ্জ), মজিবুর রহমান (পিতা হাজী আব্দুল মতিন, চানপুর), আব্দুল কাদের (পিতা ছোরত আলী, মোহাম্মদপুর), কাজী আব্দুল লতিফ (পিতা কেরামত আলী, রাজামেহার), আব্দুল হাকিম ভূঁইয়া (পিতা জুনাব আলী ভূঁইয়া, বক্রিকান্দি), আব্দুল মজিদ (পিতা ছোরত আলী, মোহাম্মদপুর), নজরুল ইসলাম (পিতা মোজাফ্ফর আলী, বিজলী বাজার), রবিউল আউয়াল (পিতা আকামত আলী, ধামতী), আব্দুল মালেক (পিতা দুধমিয়া, ধামতী), মোহাম্মদ আলী (পিতা গণি মুন্সী, নবীপুর), সেলিম মুন্সী (পিতা সাদত আলী, খিরাইকান্দি), জয়নাল আবেদীন মোল্লা (পিতা কালা গাজী মোল্লা, গুনাইঘর), আব্দুল খালেক (পিতা আহাম্মদ আলী, দুয়ারীয়া), মোহাম্মদ আলী (পিতা আব্দুল করিম, সাহাড়পাড়), সিপাহী আবু জাহের (পিতা আজগর আলী, রসুলপুর), আব্দুল জব্বার (পিতা আব্দুল গফুর, ধলাহাস), আব্দুল মালেক (পিতা ইমাম উদ্দিন, মহেশপুর), আব্দুল হাকিম (পিতা ওমেদ আলী, কাশারিখোলা), গোলাম মোস্তফা (পিতা রমিজ উদ্দিন, সংছাইল), মোবারক হোসেন (পিতা নূরুল হক, শাকতলা), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা মুকশত আলী, ওখারী), আবু তাহের (পিতা নাছির উদ্দিন, চরবাকর), সুরুজ মিয়া (পিতা হানিফ, পিরোজপুর), আব্দুর রব ভূঞা (পিতা চান মিয়া ভূঞা, ধলাহাস) এবং অহিদুর রহমান (অক্টোবরে জাফরগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ)।
দেবীদ্বার উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৪ সালে সরকারি উদ্যোগে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে দেবীদ্বার নিউমার্কেট চৌরাস্তার মোড়ে ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামফলকসহ মুক্তিযুদ্ধ চত্বর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৩ সালে নলআরার গভীর জঙ্গলে অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে একটি স্মৃতিফলক, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের এলাহাবাদ গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ- বাংলাদেশ’ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ এবং ২৪শে জুলাই দেবীদ্বার সদর গণহত্যায় শহীদ ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধার কবরস্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সরকার স্মরণে উপজেলা সদর থেকে গুনাইঘর সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সড়ক রাখা হয়েছে। এছাড়া পোনরা চৌরাস্তার মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবু বকরের কবর পাকা এবং ভিড়াল্লার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান খানের কবরে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। [এ বি এম আতিকুর রহমান বাশার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!