দেওপাড়া যুদ্ধ (ঘাটাইল, টাঙ্গাইল)
দেওপাড়া যুদ্ধ (ঘাটাইল, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ১৩ই নভেম্বর ও ১০ই ডিসেম্বর দু-দফায়। টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে দেওপাড়ার অবস্থান। জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী এখানে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। কাদেরিয়া বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার অলোকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ই নভেম্বর রাতে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ধলাপাড়া থেকে দেওপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ধলাপাড়া থেকে দেওপাড়ার দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। দেওপাড়া যাওয়ার পথে গাংগাইর গ্রামের পশ্চিম পাশে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত একটি নদী পড়ে। সিগনালম্যানের নির্দেশ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাযোগে নদী পার হয়ে সতর্কতার সঙ্গে নদীর পশ্চিমপাড় দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন। অন্ধকার রাতে উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ দিয়ে অতি কষ্টে তাঁরা দেওপাড়া হানাদার ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছান। দখলদার বাহিনীর ক্যাম্পটি ছিল একটি টিলার ওপর। ক্যাম্পের উত্তর দিকে গভীর জঙ্গল। পূর্ব দিকে সামান্য আবাদি জমি। তারপর আবার জঙ্গল।
কমান্ডার অলোকের নির্দেশ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা আবাদি জমির শেষ পূর্বপ্রান্তে জঙ্গলের গা ঘেঁষে পজিশন নেন। এর দু-তিন মিনিট পরে কমান্ডার অলোক সর্বপ্রথম ফায়ার ওপেন করেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও গুলিবর্ষণ শুরু করেন। অতর্কিত সেই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তারাও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষে প্রায় দুই ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ চলে। ইতোমধ্যে রাতের অন্ধকার কেটে আকাশে সূর্য ওঠে। তাই কৌশলগত কারণে দিনের আলোতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুবিধাজনক নয় বিবেচনায় কমান্ডারের নির্দেশে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যান। সেদিনের যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা আহত হয়।
১০ই ডিসেম্বর দুপুরে কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার রিয়াজউদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে দেওপাড়া হানাদার ক্যাম্পে পুনরায় আক্রমণ চালানো হয়। মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৩ ঘণ্টা ব্যাপক গোলাগুলি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পর্যদুস্ত হয়ে পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। এসময় নূরু নামের একজন রাজাকারের নেতৃত্বে ১৩ জন রাজাকার ও গুরুতর আহত অবস্থায় ৩ জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমপর্ণ করে। এ-যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। হানাদারমুক্ত হয় দেওপাড়া। মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাসে ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী যে কক্ষ ও বাংকারগুলোতে থাকত, সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নারীনির্যাতনের নানা আলামত উদ্ধার করেন। দেওপাড়ার এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কোম্পানি কমান্ডার রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার, গোলাবাড়ীর অলোক, সরাবাড়ীর মোজাম্মেল খাঁ, জাহাঙ্গীর হোসেন, আবদুল কাদের, ভূঞাপুরের সরই গ্রামের আবদুল মালেক, তেঘরীর আবদুল ওয়াহেদ, খানুরবাড়ীর শহিদুজ্জামান খান, নায়েব আলী, রাউৎবাড়ীর ফরিদুল। আলম, সাগরদীঘির বাবর আলী, মির্জাপুরের চর বাথুলীর বাবুল হোসেন, আশরাফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, খোকসাবাড়ীর কালা মিয়া, আসকর আলী প্রমুখ। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড