মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজী
দেওয়ান ফরিদ গাজী (১৯২৪-২০১০) রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগ-এর প্রবীণ নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধকালে সিলেট সদর ও সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ১ এর বেসামরিক প্রশাসক। তিনি ১৯২৪ সালের ১লা মার্চ বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেওয়ান হামিদ গাজী এবং মাতা সলিমা খাতুন। তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন দিনারপুর পরগনার জমিদার। তাঁরা হযরত শাহজালাল (র)-এর সহচর শাহ তাজউদ্দিন কোরেশীর বংশধর। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল ও মৌলভীবাজার জুনিয়র মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে তিনি সিলেট রসময় মেমোরিয়াল হাইস্কুল (জিন্দাবাজার) থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে এম সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ১৯৫০ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে তিনি বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন নিরহঙ্কার এবং সাদাসিধে জীবন-যাপন ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শে বিশ্বাসী।
ছাত্রজীবন থেকেই দেওয়ান ফরিদ গাজী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালে ৭ই জুন অনুষ্ঠিত সিলেট রেফারেন্ডামে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে-সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে। ১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ)-এ যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালে সিলেটে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির তিনি যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী- তাঁর অনুসারীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে ভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠন করলে দেওয়ান ফরিদ গাজী সিলেটে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তাঁর নেতৃত্ব ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বৃহত্তর সিলেটে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। তিনি ১৯৬৪ সালে সিলেট পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। আইয়ুব খানের শাসন আমলে (১৯৫৮-১৯৬৯) প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ নামে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ ছয়দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তখন থেকেই এর পক্ষে প্রচারে দেওয়ান ফরিদ গাজী আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য ১৯৬৭ সালে তাঁকে গ্রেফতার বরণ করতে হয় এবং এক নাগারে ১১ মাস কারাগারে বন্দি থাকেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি সিলেট সদর আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারাবাংলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তা সফল করতে তিনি সিলেটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ ছিলেন দেশের পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করা হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সিলেটে সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। তাঁর নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ সংবাদ বুলেটিন আকারে ছাপিয়ে প্রচার করা হয়। ২৫শে মার্চ বিকেলে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সিলেট রেজিস্টারি মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অন্যান্যের মধ্যে তিনি বক্তব্য রাখেন। জনসভা শেষে চা- বাগানের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে তিনি বেরিয়ে পড়েন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য ক্র্যাকডাউনের সংবাদ পেয়ে তিনি সিলেট শহরে ছুটে আসেন এবং আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করে শহর ও শহরতলীতে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দায়িত্ব বন্টন করে দেন। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা দেশের অন্যান্য স্থানের মতো জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর কাছেও এসে পৌছে। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্র থানা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদের তা জানিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি পাকহানাদার বাহিনীর কাছে কোনোরূপ ‘আত্মসমর্পণ না করে মোকাবেলা করার’ আহ্বান জানান। ২৮শে মার্চ কিছু সময়ের জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল হলে তিনি দক্ষিণ সুরমা চলে যান এবং সেখানে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ, পুলিশ, আনসার ও সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তিনি ঐদিন রাতে ৩ জন নেতা-কর্মীসহ পায়ে হেঁটে আসামের করিমগঞ্জে রওনা দেন। ৩রা এপ্রিল তিনি পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যান এবার গ্রেনেড, চাইনিজ রাইফেল, স্টেনগানসহ বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সেগুলো প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ৪ঠা এপ্রিল শেরপুর (হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের সংযোগস্থল)-এ অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম- ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে আক্রমণ পরিচালিত হয়। ৩ দিনব্যাপী যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে সিলেট শহরে আশ্রয় নেয়। ৬ই এপ্রিল তাঁদেরই নেতৃত্বে পাকবাহিনীকে হটিয়ে সিলেট মুক্ত করা হয়। এরপর দেওয়ান ফরিদ গাজীর নির্দেশে কারাগার থেকে রাজবন্দিদের ছেড়ে দেয়া হয়। ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট শহর তাঁদের পক্ষে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়। সিলেট শহর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধ চলে। এরপর তিনি ভারতে যান এবং আসামের করিমগঞ্জে তাঁর মূল ক্যাম্প স্থাপন করেন। সেখানে থেকে শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের সংস্থান, যুবকদের ট্রেনিং ও অস্ত্র সংগ্রহ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ, ভারত সরকারের প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ সরকার-এর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহের জন্য ১৩টি যুবশিবির খোলা হয়। সেগুলো পরিচালনার জন্য ৭ জন জনপ্রতিনিধিকে নিযুক্ত করা হয়। দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর দায়িত্ব ছিল প্রশাসন পরিচালনা করা। এছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হলে তাঁকে সিলেট সদর ও সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-১-এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৭ই ডিসেম্বর সকালে তিনি অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সেক্টর ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বঙ্গবন্ধুর দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি সিলেট রেজিস্টারি মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর দেওয়ান ফরিদ গাজী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত ও সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি অবদান রাখেন। এ লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে দলের কাউন্সিলে (৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল, হোটেল ইডেন, ঢাকা) সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন-কে আহ্বায়ক করে ৪৪ সদস্যের যে সাংগঠনিক কমিটি করা হয়, দেওয়ান ফরিদ গাজী তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। দলের অভ্যন্তরে প্রধানত নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে ১৯৭৮ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করা হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং অন্যতম সহসভাপতি হন। কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মূল আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পরে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২০১০ সালের ১৯শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সিলেটে হযরত শাহ জালাল (র.)-এর মাযার সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: এম এ করীম চৌধুরী ও অন্যান্য (সম্পাদিত), জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী, সিলেট ১৯৯৭; এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ঢাকা, বাংলা একাডেমি ২০১২
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড