দেওয়ানজীর খিল যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম)
দেওয়ানজীর খিল যুদ্ধ (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ৭ই ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় সংঘটিত এ যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
ঘটনার দিন খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি গ্রুপ (১৫৩ নং জলিল বকসু গ্রুপ, ১৫৪ নং আবু তাহের খান খসরু গ্রুপ এবং ১৫৫ নং মাহবুবুর রহমান গ্রুপ) জঙ্গল হাশিমপুরস্থ দেওয়ানজীর খিলে আলী হোসেন মাস্টারের কৃষি খামারের তিনটি পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে সেন্ট্রি পোস্ট স্থাপন করে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, জামিজুরীর উত্তর পাশের রেল ব্রিজটি মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে দোহাজারী-জামিজুরী এ রহমান উচ্চ বিদ্যালয় রাজাকারমুজাহিদ ঘাঁটিতে আক্রমণ করা। মাইন দিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করতে সেফটি ফিউজ দরকার। কিন্তু সেদিন সকালে ১৫৪ নং গ্রুপের সদস্য মাহবুবুর রহমান (পিতা জেবর মুল্লুক) খামার থেকে ধোপাছড়ির চিরিংঘাটায় তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সময় ফিউজটি সঙ্গে নিয়ে যান। ফলে সারাদিন তিনটি গ্রুপই পাহাড়ে কর্মহীন অবস্থায় অবস্থান করে। এদিকে তাদের অবস্থানের খবর খামার থেকে পালিয়ে যাওয়া কানা গফুর জামিজুরীর রাজাকার আইয়ুব আলী মাস্টার-কে জানালে সে আরো কয়েকজন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনীর দোহাজারী সিএন্ডবি অফিস ক্যাম্পে জানিয়ে দেয়। ফলে পাকবাহিনী প্রথমে রেকি করে পরে দোহাজারী ও জামিজুরীর রাজাকার আইয়ুব আলী মাস্টার, কানা গফুর, ইয়াকুব আলী, মো. রমিজ, আহমদ শফি ওরফে চেইঙ্গা ফইর, আবদুশ শুক্কুর, আবদুল হালিম খান বিহারি, আনিস বেগ বিহারি, গণি মুন্সি, আমিন শরীফ, টুনু মিয়া মিস্ত্রি, সালেহ আহমদ, কবির আহমেদ, ফজল কাদের, বাদশা মিয়া, ইয়াকুব আলী, তাজর মুলুক, আবু যাহের, মাহফুজুর রহমান, অছি মিয়া, আদুর রশিদ, আবদুল মালেক, আহমেদ ছফা, আবদুল গাফ্ফার, আবুল কাশেম, ইসমাইল হাজি প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে আসে। রাজাকাররা ছিল পাকসেনাদের আগে-আগে। ১৫৪ নং গ্রুপের কমান্ডার আবু তাহের খান খসরু আলো-আঁধারির মধ্যে তাদের চিনতে না পেরে চ্যালেঞ্জ করলে তারা অস্পষ্ট জবাব দেয়। তখন ১৫৪ নং গ্রুপের যোদ্ধা ঈদগাঁহ নিবাসী আবদুশ শুক্কুর পাহাড়ের শীর্ষে তাঁর অবস্থান থেকে চিৎকার করে বলেন: “কমান্ডার, এরা রাজাকার ও পাকসেনা। আমরা সবাই পজিশন নিয়েছি। আপনি গুলি করার নির্দেশ দিন’। কিন্তু কমান্ডার তিন গ্রুপের সবাইকে যার-যার অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে বললেন: ‘আমার নির্দেশ ছাড়া কেউ গুলি চালাবে না’। তখন ‘অপেক্ষা করলে সবই শেষ হয়ে যাবে’ বলে আবদুশ শুক্কুর তাঁর স্টেনগান দিয়ে গুলি শুরু করেন। জবাবে পাকসেনা ও রাজাকাররাও ফায়ার শুরু করে। এসময় কমান্ডার ‘ফায়ার ফায়ার’ বললে তিন গ্রুপের সকল যোদ্ধা ফায়ার শুরু করেন। পাকসেনারা হয়তো জানত না যে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় অধিক।
মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের শুরুতেই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন। সেন্ট্রি পোস্টে ছিলেন ১৫৩ নং গ্রুপের এলএমজি ম্যান-১ সুভাষ মজুমদার এবং এলএমজি ম্যান-২ বিমল কান্তি চৌধুরী। এই পোস্ট থেকে অনবরত এলএমজির গুলিবর্ষণ হতে থাকে। অন্যদিকে পাকসেনারাও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে। এভাবে যুদ্ধ ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নেয়। এ অবস্থায় আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক, ভাইখলিফাপাড়া, উত্তর হাশিমপুর)-এর নেতৃত্বে মীর আহমদ চৌধুরী গ্রুপের একদল মুক্তিযোদ্ধা নিকটস্থ হাতিখেদা থেকে এসে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন: মোহাম্মদ ইউছুপ ওরফে ইঞ্চিয়া (পিতা খুইল্যা মিয়া, পশ্চিম হারলা), মীর মাহমুদ আলী চৌধুরী (পিতা মীর আহমদ চৌধুরী, পূর্ব চন্দনাইশ), সামসুদ্দীন আহমদ (পিতা হোসেন আলী, হাশিমপুর), শিব্বির আহমদ (পিতা সিরাজুল ইসলাম, অইল্যা বরবাড়ি, হারলা), আবদুল আলিম (পিতা ওবাইদুর রহমান), ফোরক আহমদ চৌধুরী (পিতা আহমদ মিয়া চৌধুরী, পূর্ব চন্দনাইশ), ফোরক আহমদ (পিতা আবদুর রশিদ, দক্ষিণ জোয়ারা), আবুল কালাম আজাদ (পিতা আহমদ হোসেন, হারলা), আছহাব মিয়া (পিতা মতিউর রহমান, মধ্যম চন্দনাইশ), নুরুল আলম (পিতা আবদুল বারি, জোয়ারা) প্রমুখ। এঁরা যোগদান করায় ১৫৩, ১৫৪ ও ১৫৫ নং গ্রুপের শক্তি বৃদ্ধি পায়৷
প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা ও রাজাকারদের ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। এসময় হঠাৎ কমান্ডার আবু তাহের খান খসরু চিৎকার করে নির্দেশ দিলে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগুতে থাকেন। তখন পাকসেনা ও রাজাকাররা পিছু হটতে শুরু করে। দোহাজারী রেলস্টেশনের উত্তর পাশে পাকসেনাদের সহযোগী আর্টিলারি বাহিনী দূরপাল্লার কামান বসিয়ে প্রস্তুত ছিল। তারা পিছু হটতে-হটতে চার্জলাইটের মাধ্যমে আর্টিলারি বাহিনীকে জানায় যে তারা বিপদগ্রস্ত। তখন চার্জলাইটের নিশানা ধরে আর্টিলারি বাহিনী গোলাবারুদ নিক্ষেপ করতে থাকলে আক্রান্ত পাকসেনা ও রাজাকাররা পালাতে সমর্থ হয়।
যুদ্ধশেষে দেখা যায় সেন্ট্রি পোস্টে কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন সুভাষ মজুমদার। এছাড়া তাঁর সহযোদ্ধা বিমল কান্তি চৌধুরীর তিনটি দাঁত ভেঙে গুলি চলে গেছে এবং আরেকটি গুলি তাঁর বাম বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তবে তখনও তিনি জীবিত থাকায় তাঁকে দ্রুত ধোপাছড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে শীলঘাটায় নিয়ে যাওয়া হলে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ এবং চিকিৎসার অভাবে তিনি সেখানেই শহীদ হন। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১৫৩, ১৫৪ ও ১৫৫ নং গ্রুপের ৯৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কয়েকজন হলেন: কমান্ডার আবু তাহের খান খসরু (পিতা ইসহাক মিয়া, দোহাজারী), কমান্ডার মাহবুবুর রহমান (চকরিয়া), কমান্ডার জলিল বসু (পিতা তজু মিয়া, কালিয়াইশ, সাতকানিয়া), সুভাষ মজুমদার (পিতা ক্ষিতীশ মজুমদার, লোহাগাড়া), বিমল কান্তি চৌধুরী (পিতা সুধাংশু বিমল চৌধুরী, নলুয়া, সাতকানিয়া), আবদুশ শুক্কুর (ঈদগাঁহ), মো. আবুল হোসেন (সাতকানিয়া), শম্ভু প্রসাদ মিত্র (পিতা বাণেশ্বর মিত্র, হাশিমপুর), আদিনাথ মজুমদার (পিতা নিরঞ্জন মজুমদার, পূর্ব নলুয়া, সাতকানিয়া), মেঘনাথ রুদ্র (পিতা সতীশ চন্দ্র রুদ্র, সুইপুরা, সাতকানিয়া), রঞ্জিত কুমরার দাশ (পিতা ললিত মোহন দাশ, রামপুর, সাতকানিয়া), নিরঞ্জন বিহারী নাথ (পিতা দুর্গাচরণ নাথ, নাথপাড়া, চন্দনাইশ), নুরুল ইসলাম (চকরিয়া), পরিমল কান্তি দাস (সাতকানিয়া), বাবুল নাথ (বৈলতলী), আনু মিয়া, অজিত মজুমদার, হরিমোহন জলদাস (সাতকনিয়া), রামপ্রসাদ (পটিয়া), ননা চন্দ্ৰ দে (লাউয়ের খিল, পটিয়া), মনমোহন নাথ (বৈলতলী), দেলোয়ার হোসেন দেলু (পিতা শফিকুর রহমান, দোহাজারী), মো. মুসলিম হোসেন (পিতা ছিদ্দিক আহমদ, মোহাম্মদপুর, জোয়ারা), সুনীল জলদাস (পটিয়া), অনিল কান্তি বড়ুয়া (পিতা প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া, জামিজুরী), মো. আকবর খান (পিতা মো. ছিদ্দিক আহমদ খান (দোহাজারী), অর্জুন চন্দ্র নাথ, মদন মোহন দাস (পিতা কিষ্ট চন্দ্র দাস, দোহাজারী), রাখাল চন্দ্র দাস (পিতা তেজেন্দ্র লাল দাস, রায়জোয়ারা), মানিক বড়ুয়া (পিতা প্রভাত চন্দ্ৰ বড়ুয়া, জামিজুরী), সুধীর কান্তি দাস (পিতা প্যায়ারী মোহন দাস, জামিজুরী), রাজ বিহারী বড়ুয়া (পিতা অখী মোহন বড়ুয়া, জামিজুরী), মাহফুজুর রহমান (পিতা আলতাফ মিয়া, দোহাজারী), মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন খান (পিতা ফরিদ মিয়া খান, দোহাজারী), ইসলাম (দোহাজারী), বাবুল কান্তি মজুমদার, অরুণ কান্তি মজুমদার, রামধন নাথ, পরিমল বড়ুয়া, পরিমল মজুমদার, রঞ্জিত মল্লিক, কাজল কান্তি বিশ্বাস, রায় গোপাল দাস, পরিমল কান্তি দাস, নারায়ণ দাস, পুলিন দাস, নেপাল কান্তি দাস, বসন্ত দাস, হিমাংশু বিমল দাস, মিলন চক্রবর্তী, প্রফুল্ল মোহন নাথ, অনিল দাশ, রাখাল কৃষ্ণ দত্ত, বাবুল কান্তি দত্ত, বিধুর চন্দ্র দাস প্রমুখ। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড