You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দুর্গাপুর উপজেলা (রাজশাহী)

দুর্গাপুর উপজেলা (রাজশাহী) রাজশাহী জেলা সদর থেকে ২৫ কিমি দূরে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। থানা সদর থেকে শিবপুর হাট পর্যন্ত পাকা রাস্তা থাকলেও অধিকাংশ জায়গার সঙ্গে এখানকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, সাইকেল প্রভৃতির মাধ্যমেও মানুষ যাতায়াত করত। এ উপজেলার শিক্ষিত মানুষের মধ্যে অনেকটা রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে এখান থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে যথাক্রমে শাহ মো. জাফরুল্লাহ এবং ডাক্তার মো. আলাউদ্দীন নির্বাচিত হন। এলাকার মানুষ রেডিওর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত হতো। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে বিবিসি-ই ছিল সংবাদের একমাত্র উৎস। দুর্গাপুরবাসী বিবিসির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- শোনার সুযোগ পায় এবং তার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ উ ম নুরুল আলম হিরু মাস্টারকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পুঠিয়া থানা সার্কেল অফিসার আব্দুল্লাহর সহযোগিতায় দুর্গাপুর থানার আনসার বাহিনীর সদস্যদের একত্র করে ১১ই মার্চ দুর্গাপুর থানা থেকে ৩০টি রাইফেল এবং প্রচুর গুলি সংগ্রহ করা হয়। থানার ওসি শাহজামান এতে সহযোগিতা করেন। এরপর আনসার কমান্ডার আহম্মদ মিস্ত্রী, তাহের ও কান্দু মিয়া গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। মার্চ মাসের প্রথম দিকে জয়নগর ইউনিয়নের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল করিম মোল্লা তাঁর নিজ এলাকা চুনিয়াপাড়া গ্রামের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সচেতন ও সংগঠিত করতে শুরু করেন। তিনি ২৩শে মার্চ চুনিয়াপাড়া বাচ্চুখালি হাইস্কুল মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এছাড়াও তিনি তরুণদের সংগঠিত ও অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেন। ৫ই এপ্রিল বিকাল ৪টায় ২ জন লোক সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে একটি জিপে করে ৮০টি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে দুর্গাপুরে আসেন। সিঙ্গা হাটস্থ মাঠে হিরু মাস্টার সে অস্ত্রগুলো গ্রহণ করেন। এভাবে শতাধিক অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় এবং সন্ধ্যার পর সেগুলো আনসারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। হিরু মাস্টার ছাড়াও এখানকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মো. নজরুল ইসলাম (সালঘরিয়া), মো. আব্দুল মালেক (শ্রীরামপুর), আব্দুস সালাম, নরেশ ভূঁইয়া, আব্দুল করিম মোল্ল্যা প্রমুখ। স্থানীয় মুসলিম লীগ – নেতাদের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে জীবিত অথবা মৃত গ্রেপ্তারের জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পরপরই আনসার বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় যুবকরা দুর্গাপুরকে অনিরাপদ ভেবে ভারতে চলে যান। তাঁরা চারঘাট থানার মরকুটি, আলাইপুর এবং টাঙ্গোন ঘাট হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার নন্দীভিটা ক্যাম্পে হাজির হন। সেখানে কাজীপাড়া ক্যাম্পে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ধনীরামপুর, পানিপিয়া প্রভৃতি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের কিছুদিনের মধ্যেই উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিহার, কুচবিহার, হাফলং প্রভৃতি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। দুর্গাপুর উপজেলার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী ও দুর্গাপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও যুদ্ধ করেন।
দুর্গাপুর উপজেলার যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আব্দুস সালাম (পিতা ডা. ইদ্রিস আলী, পানানগর) এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মো. নজরুল ইসলাম (বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান, পিতা ছাবের মোল্লা, শালঘরিয়া)।
১২ই এপ্রিল পাকবাহিনী সড়ক পথে রাজশাহী আসার সময় বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এদিন ঝলমলিয়া ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ঝলমলিয়া ডাকবাংলোয় অবস্থান নিয়ে হামলা চালালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রফাত উল্লাহ মোল্লা শহীদ হন৷ এটি ঝলমলিয়া প্রতিরোধযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। একই দিন মুক্তিযোদ্ধারা বিড়ালদহ ব্রিজ সংলগ্ন কালু শাহের পুকুরপাড়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এখানেও ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং উভয় পক্ষে বেশকিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এটি কালু শাহের পুকুরপাড় প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত।
১২ই এপ্রিল পাকবাহিনী দুর্গাপুরে অনুপ্রবেশ করে। এখানে তাদের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। তারা দুর্গাপুরে এসে অভিযান চালিয়ে চলে যেত। তবে দুর্গাপুর পাইলট স্কুলে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল।
এ উপজেলার মুসলিম লীগ নেতা মো. আব্দুল ওয়াহেদ মোল্লা (সভাপতি, দুর্গাপুর থানা শাখা), মো. আব্বাস আলী সেক্রেটারি, থানা শাখা) তাদের অনুগত লোকদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে।
মে মাসে পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা জগিশ্বর গ্রামে এসে শান্তি কমিটি গঠনের নামে গ্রামের লোকজনকে একত্র করার পর ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ২৭ জন মানুষ প্রাণ হারায়। এটি জগিশ্বর গণহত্যা নামে পরিচিত। এ সময় তারা গ্রামজুড়ে নারীনির্যাতন চালায়। ১৬ই মে যোগীশো-পালশা গণহত্যা সংঘটিত হয়। রাজশাহী শহর থেকে সড়ক পথে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত দুটি গ্রাম যোগীশো ও পালশা। গ্রামদুটিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ৪২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পাকসেনারা ২২শে এপ্রিল গগণবাড়িয়ায় বহু লোককে হত্যা করে। এটি গগণবাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যাকালে পাকসেনারা কানপাড়া, গুলালপারা, কুশাকান্দা, বাজুখালি, পাঁচুবাড়ী, বখতিয়ারপুর ও শ্রীধরপুর গ্রামে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর তারা এসব গ্রামের অসংখ্য বাড়িঘর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পুরো সময়টা পাকিস্তানি বাহিনী দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নারীনির্যাতন, ধর্ষণ ও নানা রকম অপকর্ম চালায়। তাদের হাতে মোট ৫৬ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। সেই সঙ্গে প্রচুর বাড়িঘর, মন্দির ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এসব বাড়ি থেকে তারা নগদ অর্থ ও গহনা লুট করে নিয়ে যায়।
উপজেলার গগণবাড়িয়ায় একটি গণকবর রয়েছে। পাকবাহিনী কয়েকটি গ্রামের বহু লোককে গগণবাড়িয়া মাঠে এনে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। পরে তাদের ওখানেই গণকবর দেয়া হয়। এটি গগণবাড়িয়া গণকবর হিসেবে পরিচিত।
১৪ই অক্টোবর ভোরে পাকবাহিনী হাটগোদাগাড়ির গড়িহার নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। হাটগোদাগাড়ি যুদ্ধ-এ ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ১৩ই ডিসেম্বর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। দুর্গাপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- রফাতুল্যা মোল্ল্যা (পিতা কিবি মোল্ল্যা, দেবীপুর), আব্দুল হামিদ (পিতা আ. কাবেদ মোল্ল্যা, শালঘরিয়া), আবুল কাশেম (পিতা আবেদ আলী, রৈপাড়া), জমির উদ্দীন (পিতা মহির উদ্দীন, জগিশ্বর) ও জানেকুল্লা সরদার (পিতা আফের উদ্দীন সরদার, গুলালপাড়া)।
দুর্গাপুর উপজেলা প্রশাসন ভবন চত্বরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে দুর্গাপুর পাইলট হাইস্কুলে একটি শহীদ মিনার এবং গগণবাড়িয়া ও জগিশ্বর গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে বাদইয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আবুল কাশেম স্কুল এন্ড কলেজ। [এ কে এম কায়সারুজ্জামান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!