দুধখালী ও মিঠাপুর গণহত্যা (মাদারীপুর সদর)
দুধখালী ও মিঠাপুর গণহত্যা (মাদারীপুর সদর) সংঘটিত হয় ২০শে মে ও ২৭শে জুলাই। এতে শতাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।
২০শে মে ও ২৭শে জুলাই মাদারীপুর সদর উপজেলাধীন দুধখালী ইউনিয়নের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর দুধখালী গ্রামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী দুদফা হামলা চালিয়ে নৃশংস গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটতরাজ সংঘটিত করে। তাদের এসব ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করে স্থানীয় শান্তি কমিটি ও বাহিনীর সদস্যরা। তাদের মধ্যে ছিল রব খালাসী, লতিফ হাওলাদার, সোবহান চৌধুরী ওরফে কুটি মিয়া, আনিস হাওলাদার, সালাউদ্দিন ডাক্তার, নওয়াব খন্দকার, মুজিবর মাস্টার, হাবিব মাস্টারসহ অনেকে।
২০শে মে বৃহস্পতিবার ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা শুরু হয় বোয়ালিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মান্নান মোল্লাকে হত্যার মাধ্যমে। পাকসেনারা খালপাড় দিয়ে মিঠাপুর বাজার হয়ে শিকদার বাড়ি যায়। রাজাকাররা তাদের পথ দেখিয়ে সাহায্য করে। এরপর হানাদারদের ৬-৭ জনের একটি দল ভূঁইয়া বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে বাড়ির লোকজন পালাতে থাকে। কিন্তু নারায়ণ সাহা ও তাঁর ভাই পরেশ সাহা ধরা পড়েন। হানাদাররা তাদের দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। কয়েকজন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
এক সময় মিঠাপুর স্কুলের লাইব্রেরির সামনে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা নিরীহ লোকদের লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। স্কুলের একটি তালাবদ্ধ কক্ষের দরজা ভেঙ্গে তারা কক্ষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৮-৯ জন নিরীহ মানুষকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। সকাল ৯টার দিকে হানাদার বাহিনী হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা শেষ করে মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুট মিলস ক্যাম্পে ফিরে যায়।
২৭শে জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যরা বলরাম সাহা, নিতাই সাহাসহ ২১ জনকে মিঠাপুর বাজারের পাশের খালপার থেকে ধরে এনে শিকদার বাড়ির ভোলানাথ সাহার বাড়িতে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সঙ্গে গুলি করে। নিতাই সাহা ছাড়া সবাই প্রাণ হারান। বুকে গুলি লেগেও বেঁচে থাকা নিতাই সাহাকে বুট দিয়ে লাথি মেরে উপুড় করে পিঠে বেয়নেট চার্জ করে। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। মিঠাপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে আদেল উদ্দিন বেপারী পাকসেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান।
ভোলানাথ সাহার বাড়ির উত্তর দিকে ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা বড় একটি গর্তের ভেতর ৩০-৪০ জন নিরীহ মানুষ লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ওই বাড়ির উঠোনে এলে হঠাৎ একটি শিশু কেঁদে ওঠায় সেদিকে তাদের নজর যায়। তারা গর্তের ভেতরে ব্রাশ ফায়ার করে সবাইকে হত্যা করে। এটি ছিল এক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড।
এ দুদিনের গণহত্যায় শতাধিক লোক নিহত হলেও অনেকের বাড়ি এ এলাকায় না হওযায় তাদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। স্থানীয়দের মধ্যে ৬৮ জনের নাম জানা যায়। তারা হলেন- সনাতন ঘোষ, প্রশান্ত কুমার ঘোষ, বাসনা রানী ঘোষ, শোভা রানী ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, পুষ্প রানী ঘোষ, গৌরী নাথ ঘোষ, হরেন্দ্র ব্রহ্ম, হরেন্দ্র ব্রহ্মের স্ত্রী, সবিতা রানী ঘোষ, মহাদেব ঘোষ, হরেন্দ্র নাথ ঘোষ, রমেশ চন্দ্র ঘোষ, কানাই লাল ঘোষ, কানন বালা ঘোষ, গোপী নাথ চক্রবর্তী, মুকন্দ লাল ঘোষ, অতুল চন্দ্র ঘোষ, পবিত্র কুমার ঘোষ, রাধা রানী ঘোষ, গোপাল চন্দ্র ঘোষ, নিত্যানন্দ সাহা, নান্টু সাহা, বাবু লাল অধিকারী, সুশীল কুমার ঘোষ, নারায়ণ চন্দ্র সাহা, পরেশ চন্দ্র সাহা, চিত্তরঞ্জন সাহা, হরিপদ সাহা, রমেশ চন্দ্র শিকদার, তরণী ভূঁইমালী, জগদীশ চন্দ্র সাহা, গোপীলাল ঠাকুর, জগবন্ধু সাহা, তরণী ভূঁইমালী বাবু, পদ্মা হাওলাদার, রমা রানী ঘোষ, আদেল উদ্দিন বেপারী, সাজু বিবি, রাধা রানী ঘোষ, মহাদেব ঘোষ, আবদুল মান্নান মোল্লা, জ্যোতি ঠাকুর, তারক চন্দ্র সাহা, রাধেশ্যাম সাহা পোদ্দার, জগদীশ সাহা, নাম না-রাখা ১ মাসের একটি মেয়ে শিশু, মোতালেব ফকির, আবু ফকির, রহমান ফকির, নিশিকান্ত মালো, জিন্নাত গাজী, খোকন ঘোষ, দুলাল ঘোষ, কল্যাণী রানী ঘোষ, বেসকা রানী ঘোষ, মেলানী রানী ঘোষ, শান্তি রানী ঘোষ, ময়না বিবি, নেদু ঘোষ, পলাশ চন্দ্র ঘোষ, দিপা রানী ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, জয়ন্তি রানী ঘোষ, আকাশ চন্দ্র ঘোষ, শুকচন্দ্র ঘোষ, কানাই সাহা ও সুধন্য মালো। মারাত্মকভাবে আহত হন নিতাই ঠাকুর, শম্ভুনাথ ঘোষ, গীতা রানী ঘোষ, তারক চন্দ্র হালদার প্রমুখ। এ ছাড়া মাদারীপুর সদর থানায় নিয়ে বন্দি করে রাখা হয় কানাই লাল ঘোষ, নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ, সুবোধ চন্দ্র ঘোষ, সুশীল চন্দ্র ঘোষ, শান্তিরঞ্জন ঘোষ, ক্ষিরোদ লাল পোদ্দার, পুলিন বিহারী ঘোষ, সুশীল চন্দ্র সাহা ও শংকরসহ অনেককে। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড