মুক্তিযুদ্ধে দিঘলিয়া উপজেলা (খুলনা)
দিঘলিয়া উপজেলা (খুলনা) ১৯৭১ সালে দিঘলিয়া ছিল দৌলতপুর থানার একটি ইউনিয়ন। ১৯৮৩ সালে গাজীরহাট, বারাকপুর, দিঘলিয়া, সেনহাটি আড়ংঘাটা ও যোগীপোল এই ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে দিঘলিয়া থানা গঠিত হয়। পরে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। দৌলতপুর, খালিশপুর ও খুলনা শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় এসব এলাকার স্বাধীনতাকামী জনগণ অত্র এলাকার শ্রমিকদের সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে পূর্ব থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে আসছিল। বিশেষ করে সেনহাটি ইউনিয়নের সেনহাটি গ্রামে অবস্থিত স্টার জুটমিলসের শ্রমিকরা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন এবং ২৬শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
২৭শে মার্চ পাকবাহিনী খুলনা শহর দখল করে নিলে যেসব বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্য অস্ত্রসহ পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে আব্দুল হামিদ মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গঠন করেন। তিনি গাজীরহাট বাজারের বটতলা পূজামণ্ডপের পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। সেনহাটি গ্রামের শিববাড়ি মাঠেও আনসার কমান্ডার আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলে। ২৮শে মার্চ স্বাধীনতাকামী | শ্রমিক-জনতা খালিশপুর থেকে ইপিআরের একটি অয়ারলেস সেট সংগ্রহ করে সেনহাটি গ্রামের আলাউদ্দিন মুন্সির বাড়িতে গাছের সঙ্গে টাঙিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী
বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়।
দিঘলিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- সেনহাটি ইউনিয়নের আলাউদ্দিন মুন্সি, নজির আহম্মদ, আরিফ হোসেন গাজী, আবদুস সালাম খান, দিঘলিয়া ইউনিয়নের এম এ রশিদ, গাজীরহাটের আব্দুর রশিদ মোল্লা, আব্দুল হামিদ মোল্লা প্রমুখ। দিঘলিয়া উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ ছিল খুবই তৎপর। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলা স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এখানকার সেনহাটি বাজার এবং পোস্ট অফিসের কাছে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এখানে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাদের মধ্যে মোস্তাক মোল্লা (মোল্লাডাঙ্গা), জলিল শেখ, উকিল উদ্দিন মেম্বার, আব্দুল মজিদ শেখ (বামনডাঙ্গা), রাজাকার কমান্ডার হাফেজ আনোয়ার হোসেন (হাজি গ্রাম), আলী ফকির, আব্দুল গফুর, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শেখ রুস্তম আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপজেলার সেনহাটি গ্রামে একটি বিহারি কলোনি ছিল। রাজাকার ও বিহারিরা সম্মিলিতভাবে অত্র এলাকায় ব্যাপক লুটপাট, হত্যা ও নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটায়। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী গাজীরহাট ইউনিয়নে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ডলি নামের এক গৃহবধূ এবং তাঁর স্বামী ও ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। কোলা বাজারের কাছে স্বামী ও ছেলের হাত-পা বেঁধে জীবিত অবস্থায় তাদের নদীতে ফেলে দেয়। আর ডলি নামের সেই হতভাগ্য নারীকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করার ফলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২৭শে আগস্ট দেয়াড়া গ্রামের বর্তমান শাহনেওয়াজ জুটমিলসের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিহারি ও রাজাকারদের দ্বারা এক নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন তারা ৩৩ জন নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা করে এবং তাদের গণকবর দেয়। এ ঘটনা দেয়াড়া গ্রাম গণহত্যা ও গণকবর নামে পরিচিত।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে গাজীরহাট ও পিরোলি বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে ত্রিনদীর মোহনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী গানবোট থেকে গুলিবর্ষণ করে। এ-যুদ্ধে বারাকপুর ইউনিয়নের রাধামাধবপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান খাঁ শহীদ হন। ১২ই ডিসেম্বর দিঘলিয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
দিঘলিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুর রশিদ (পিতা এজারুদ্দিন মোল্লা, সেনহাটি), মোকছেদ মিয়া (পিতা রঙ্গু মিয়া, সেনহাটি) এবং সুলতান খাঁ (রাধামাধবপুর)। উপজেলার দেয়াড়া গ্রামের গণহত্যায় শহীদদের গণকবরের পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [মেহেরুন্নেসা বেগম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড