দিনাজপুর কুঠিবাড়ি ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণ (দিনাজপুর সদর)
দিনাজপুর কুঠিবাড়ি ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণ (দিনাজপুর সদর) পরিচালিত হয় ২৮শে মার্চ। এদিন অনেক পাকসেনা বাঙালিদের হাতে নিহত হয়। এ আক্রমণে দিনাজপুর শহর শত্রুমুক্ত হয় এবং ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত বাঙালিদের দখলে থাকে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে দিনাজপুর জেলায় ব্যাপভাবে নীলচাষ শুরু হয় এবং জেলা সদর নীল ব্যবসার বৃহৎ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এ কারণে এখানে বহু সংখ্যক নীল কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেগুলোর প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে একটি কুঠিবাড়িও প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে এই কুঠিবাড়ি ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা বর্তমানে বিজিবি সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর থেকেই কুঠিবাড়িকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনাদের তৎপরতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এখানে অবাঙালি ইপিআর- এর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর্মি হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি ওয়ারলেস সেট স্থাপন করা হয়। সেটি সেনাবাহিনীর অবাঙালি অফিসাররা নিয়ন্ত্রণ করত। সেটের সীমানার মধ্যে বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কুঠিবাড়ির অস্ত্রাগারে বাঙালি গার্ড পরিবর্তন করে পাঞ্জাবি ও পাঠান সৈন্যদের নিয়োগ করা হয়। অবাঙালিদের এই কার্যকলাপ বাঙালি ইপিআরদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে কুঠিবাড়ির বাঙালি সৈন্যরা গোপন বৈঠক করে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে কুঠিবাড়িতে আরো কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বর্ডার আউট পোস্টগুলো (বিওপি) থেকে অবাঙালি সেনাদের কুঠিবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কুঠিবাড়ির বাঙালি গার্ড সরিয়ে অবাঙালিদের নিয়োগ করা হয়। সেক্টর এডজুট্যান্টের বাঙালি পদটি অবাঙালি ক্যাপ্টেনকে দিয়ে পূরণ করা হয়। ফলে বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। এমনই অবস্থায় বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায়।
১৭ই মার্চ পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন নাজির কুঠিবাড়ির অস্ত্রাগারের সমস্ত চাইনিজ আর্মস ও গ্রেনেড ১৮ই মার্চের মধ্যে ২৬ এফএফ- (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স)-এর কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাঙালি সেক্টর মাস্টার এ নির্দেশ অমান্য করেন। তিনি বাঙালি ইপিআরদের পরিবারগুলোর নিরাপত্তার জন্য গোপনে কিছু চাইনিজ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরণ করেন। অন্যদিকে, বাঙালি সুবেদার মেজর রব কৌশলে কুঠিবাড়ির চারদিকে নিরাপত্তামূলক পরীক্ষা খনন করিয়ে নেন।
১৮ই মার্চ ছাত্র-জনতা ইয়াহিয়া জান্তার বিরুদ্ধে দিনাজপুর শহরে প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পাকবাহিনী তখনই চেয়েছিল শহরে কারফিউ জারি হোক। তাহলে দিনাজপুর সার্কিট হাউজে অবস্থানরত ২৬ এফএফ রেজিমেন্টের অবাঙালি সদস্যরা কারফিউর ভেতর বাঙালিদের বিরুদ্ধে একশনে যেতে পারবে। কিন্তু ডিসি ফয়েজ উদ্দীন কারফিউ জারি করতে অস্বীকৃতি জানান। এদিকে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের প্রতিনিধি হিসেবে সুবেদার মেজর রব একই দিন রাতে শহরের চুড়িপট্টির একটি বাসায় দিনাজপুরে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁকে জানান যে, তাঁরা বিদ্রোহ করবেন এবং এ ব্যাপারে তাঁরা রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তা কামনা করছেন। পুলিশও বিদ্রোহ করবে বলে জানানো হয়। পুলিশ অথবা ইপিআর যে-কোনো পক্ষের আগে বিদ্রোহ করলে অপর পক্ষ সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাঁরা গোপনে বিদ্রোহের একটি রূপরেখাও প্রণয়ন করেন।
২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাতের বেলা কুঠিবাড়িতে এক বড় ভোজের আয়োজন করা হয়। সেক্টর কমান্ডার কোরেশী এতে ইপিআর ছাড়াও ২৬ এফএফ রেজিমেন্টের সৈনিকদের দাওয়াত করেন। কথা ছিল, বেসামরিক পোশাক পড়ে ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয় করবে। কিন্তু কিছু এফএফ সদস্য সামরিক পোশাকে অস্ত্রসহ এলে বাঙালি ইপিআররা প্রতিবাদ জানান। তখন কমান্ডার কোরেশী এফএফ সদস্যদের পোশাক বদলে আসতে বলেন। এ ঘটনাকে বাঙালি ইপিআররা গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। পাকিস্তানি সেনারা খাবার টেবিলেই সব বাঙালিকে একসঙ্গে হত্যার নীলনক্সা করে বলে তাঁদের বিশ্বাস জন্মায়। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক সেদিন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এরপর থেকে বাঙালি সৈন্যরা সবসময় অস্ত্র বহন করতেন, যাতে তাৎক্ষণিক বিপদ মোকাবেলা করা যায়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী শহরে ত্রাস সৃষ্টি করে প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ডিসিকে নজরবন্দি ও তাদের আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করে। বাঙালি ক্যাপ্টেন নাজির ও সুবেদার আতাউল হককে এক প্লাটুন ইপিআরসহ ঠাকুরগাঁওয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও কুঠিবাড়ি থেকে বাঙালি সৈন্যদের বিভিন্ন বিওপিতে পাঠানো হয়। ২৬শে মার্চ পাকসেনারা কুঠিবাড়িতে একটি স্বতন্ত্র ও গোপন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বসায় এবং এখান থেকে পাকিস্তানি সেনা-অফিসারদের বাসায় বাসায় সংযোগ দেয়া হয়। অন্যদিকে, পাকসেনারা রাতের বেলা শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের লাইন কেটে দিয়ে জনগণকে টেলিযোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কুঠিবাড়িতে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
২৬শে মার্চ ভোরে দিনাজপুর পুলিশ লাইন অয়ারলেসে খবর আসে যে, পাকসেনারা ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা করে হাজার-হাজার পুলিশ ও জনতাকে হত্যা করেছে। পুলিশ লাইনের একজন বাঙালি অপারেটরের মাধ্যমে গোপনে ইপিআররা এ খবর পান। তখন থেকে শুরু হয় কুঠিবাড়ি বিদ্রোহের প্রস্তুতি। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ইপিআর সদস্যদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্রোহের সময় পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, জনগণ ও ইপিআরদের ভূমিকা কী হবে, কীভাবে বিদ্রোহ শুরু ও সফল হবে তাও নির্ধারিত হয়।
২৭শে মার্চ জেলার সবগুলো বিওপিতে খবর দেয়া হয় যে, সেখানকার অবাঙালি ইপিআরদের হত্যা করে বাঙালি ইপিআররা যেন সন্ধ্যার মধ্যে সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স কুঠিবাড়িতে চলে আসেন। এ নির্দেশ প্রায় সবগুলো বিওপিতেই কার্যকর করা হয়। দূরের বিওপিগুলো থেকে বাঙালি ইপিআরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সেতাবগঞ্জ চিনিকলের গাড়ি ব্যবহৃত হয় এবং এ ব্যাপরে প্রধান ভূমিকা পালন করেন সেতাবগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা (পরে জেলা কমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী) আব্দুর রউফ চৌধুরী। কুঠিবাড়ি ছাড়াও বাঙালি ইপিআরদের বিভিন্ন বিওপি থেকে বিরল থানার দেওয়ানদিঘিতে এনে রাখা হয়। এখানকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে। ২৮শে মার্চ ভোরবেলা এসব ইপিআরকে কুঠিবাড়ির পেছনে কাঞ্চন নদীর তীরে নিয়ে আসা হয় এবং এখানে তাঁরা কুঠিবাড়ি ও সার্কিট হাউসকে টার্গেট করে পজিশন নেন।
পাকবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল ২৫শে মার্চের মধ্যেই দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স এবং রিজার্ভ কোম্পানিগুলোর বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হবে এবং সীমান্ত ফাঁড়িসহ সব জায়গায় নতুন বাহিনী প্রেরণ করা হবে। কিন্তু তাদের কতিপয় কার্যক্রম সন্দেহজনক হওয়ায় বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণ না করে সতর্ক হয়ে যান। ফলে পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এ অবস্থায় তারা বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের বিভক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন বিওপিতে পাঠাতে থাকে। কিন্তু এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়, কারণ বাঙালি ইপিআররা ইতোমধ্যে বিওপিগুলোতে অবাঙালিদের হত্যা করে ২৭শে মার্চ রাতের মধ্যে কুঠিবাড়ির কাছে এসে কাঞ্চন নদীর পাড়ে পজিশন নেন।
২৮শে মার্চ বেলা ২টা থেকে অপারেশন শুরু হয়। প্রথমে কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরে অবস্থানরত বাঙালি ইপিআররা অতর্কিতে অবাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেয়নেট চার্জ করতে থাকেন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হলে বাইরে থেকে পজিশন নেয়া বাঙালি ইপিআর ও সাধারণ জনগণ কুঠিবাড়িতে পৌঁছে যায়। অবাঙালি ইপিআর-রা তদ্রূপ কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং বাঙালিদের অতর্কিত হামলায় তারা অল্পক্ষণের মধ্যেই পরাস্ত হয় এবং কুঠিবাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থানে জনগণের হাতে তাদের অনেকে নিহত হয়।
দিনাজপুর কুঠিবাড়ি দখলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন মেজর আব্দুর রব, সুবেদার আতাউল হক, নায়েব সুবেদার লুৎফর রহমান, নায়েব সুবেদার মোয়াজ্জেম হোসেন, কোয়ার্টার্স মাস্টার হাবিলদার মুসলিম আলী, হাবলিদার ভুলু প্রমুখ। কুঠিবাড়ি দখলের মধ্য দিয়ে দিনাজপুর শহর ২৮শে মার্চ থেকে ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত ছিল। [মাসুদুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড