You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.01.06 | দিনাজপুর মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি (দিনাজপুর সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

দিনাজপুর মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি (দিনাজপুর সদর)

দিনাজপুর মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি (দিনাজপুর সদর) সংঘটিত হয় ১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র বিশ দিন পরে। এতে প্রায় পাঁচশত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিনাজপুর শত্রুমুক্ত হলে দিনাজপুর শহরের পূর্বপ্রান্তে মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল শাহরিয়ার হামজাপুর, বাঙালিবাড়ি ও তরঙ্গপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর, রানিশংকৈল, হরিপুর, ফুলবাড়ি ও দিনাজপুর সদর থানার মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্পে সমবেত হয়ে শত্রুবাহিনীর ফেলে যাওয়া ও পুঁতে রাখা গোলা-বারুদ-মাইন-বোমা-অস্ত্র প্রভৃতি উদ্ধারে তৎপর হন। স্কুলমাঠে একটি বিরাট বাংকার ছিল। সেখানে উদ্ধারকৃত ৩৬ ইঞ্চি গ্রেনেড, ২ ও ৩ ইঞ্চি শেল, মর্টার, এন্টি-ট্যাংক মাইন, এন্টি-পারসনাল মাইন, জাম্পিং মাইন এবং অন্যান্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা হতে থাকে। এর ফলে স্কুলটি অস্ত্র ও গোলাবারুদের এক বিরাট ভাণ্ডারে পরিণত হয়।
১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারি ঘোড়াঘাট ও হিলি সীমান্ত থেকে উদ্ধারকৃত দুই ট্রাক অস্ত্র আনা হয়েছিল। ট্রাক থেকে অস্ত্র নামানো শুরু হয় বিকেল ৪টার দিকে। বাংকার থেকে ট্রাকের দূরত্ব মাত্র ১০০ গজ। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন। তাঁরা হাতে-হাতে ধরে-ধরে ট্রাক থেকে অস্ত্র নামিয়ে বাংকারে রাখছিলেন। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি এন্টি-পারসোনাল মাইন মাটিতে পড়ে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে-সঙ্গে বাংকারে রাখা মাইন ও গোলা-বারুদসহ অন্যান্য অস্ত্রগুলোও বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। সমস্ত এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। তীব্র অন্ধকারে পুরো এলাকা ঢেকে যায়। স্কুল ও তার পার্শ্ববর্তী প্রায় অর্ধমাইল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণের স্থানটিতে এক বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয় এবং নিচ থেকে পানি বেরিয়ে আসে। ক্যাম্পে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়। তাঁদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চতুর্দিকে প্রায় অর্ধ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় জনগণ উদ্ধার কাজ শুরু করে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে উদ্ধার কাজ চালানো দুরূহ হয়ে ওঠে। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী এসে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে সঙ্গে টর্চ, হ্যাজাক ও লণ্ঠনের আলোতে রাতভর উদ্ধার কাজ চলে। শহীদদের কারো লাশই সনাক্ত করা যায়নি। পরদিন কারো মাথা, কারো হাত, কারো পা মিলিয়ে এক-একটি পুরো লাশের রূপ দিয়ে মোট ১৬০টি লাশ চেহেলগাজী মাজার গণকবর-এ সমাহিত করা হয়। ধ্বংস্তূপ থেকে প্রায় ৪ মণ পোড়া মাংসও উদ্ধার করা হয়।
মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তাঁদের নাম-সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুল প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে। ২০০১ সালের ৬ই জানুয়ারি স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করা হয়। উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা আ ন ম ফজলুর রহমান। এতে সভাপতিত্ব করেন ৬ই জানুয়ারি পালন কমিটির আহ্বায়ক আলহাজ্ব এম আব্দুর রহিম। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি এডভোকেট আমজাদ হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দিনাজপুর জেলা ইউনিটের তৎকালীন কমান্ডার আব্দুল মালেক সরকার, প্রাক্তন সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ, তৎকালীন জেলা প্রশাসক আজিজুর রহমানসহ দিনাজপুরের মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর জনসাধারণ।
মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ট্র্যাজিডিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ১১৪ জনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন: মোসলেমউদ্দিন (পিতা চেমটা মোহাম্মদ, মালগাঁও, পীরগঞ্জ), ইরশাদ আলী (পিতা ইমান আলী, কমলপুর, দিনাজপুর সদর), মকবুল হোসেন (পিতা মো. মনসুর আলী, মৌপুকুর, বিরামপুর), এ কে এম মোজাহারুল ইসলাম (পিতা জহুরুল হক, খানগহর, রানিশংকৈল), মো. সৈয়দ আলী (পিতা মো. হামির উদ্দিন, বোধগাঁও, আটোয়ারী, ঠাকুরগাঁও), মিজানুর রহমান (পিতা খয়ের উদ্দিন মণ্ডল, হরিল্যাপুর, নবাবগঞ্জ), মো. আ. ছামাদ (পিতা মো. দারাজ উদ্দিন, দাউদপুর, নবাবগঞ্জ), মো. সুলেমান আলী (পিতা গফুর মোহাম্মদ, ভোমরাদহ, পার্বতীপুর), সৈয়দ আলী (পিতা মফিজ উদ্দিন, মৌপুকুর, বিরামপুর), মো. আ. জব্বার (পিতা মো. রহমান মোল্লা, বিরামপুর, বিরামপুর), মো. আলতাফ হোসেন (পিতা মো. আফান উদ্দিন, বড়মাগুড়া, নবাবগঞ্জ), গোলাম মোস্তফা (পিতা আমর আলী, কালিপুর, রানিশংকৈল), আলাউদ্দিন (পিতা জমির উদ্দিন, মধুডাংগী, হরিপুর), মো. ওবায়দুল হক (পিতা মো. নুরুল হক, জগন্নাথপুর, ঠাকুরগাঁও সদর), আবু বকর (পিতা বাচ্চা মিয়া, খয়েরগণি, নবাবগঞ্জ), আ. রহমান (পিতা চয়ন মোহাম্মদ, কালিপুর, রানিশংকৈল), আবুল ফজল (পিতা ফকিরা, চকমুশা, চিরিরবন্দর), কর্নেল মার্ডি (পিতা শাম মার্ডি, মালার পাড়া, নবাবগঞ্জ), আ. কুদ্দুস (পিতা আমান আলী তালুকদার, বুজিগঞ্জ, তেঁতুলিয়া), গোলাম মোস্তফা (পিতা সিরাজ উদ্দীন, দগরবাড়ী, তেঁতুলিয়া), আজিম উদ্দিন (পিতা মফিজ উদ্দিন সরকার, বীরগঞ্জহাট, হরিপুর), মো. শামসুল হক (পিতা ছকির উদ্দিন, খয়েরগণি, নবাবগঞ্জ), মোমতাজুল আলম (পিতা খেতাব উদ্দিন, হেয়াতপুর, দাউদপুর, নবাবগঞ্জ), মো. আমিনুল ইসলাম (পিতা খাজের উদ্দিন আহমেদ, মহেষপুর, নবাবগঞ্জ), নূর মোহাম্মদ (পিতা মেছের উদ্দিন, কুন্দন, নবাবগঞ্জ), বিধান চন্দ্র রায় (পিতা সুভেন্দু রায়, হরশুনা, নাসিরগঞ্জ), নুরুল ইসলাম (পিতা চান মোহাম্মদ, আমগাঁও, হরিপুর), মো. নুরুল ইসলাম (পিতা বকসু মোহাম্মদ, বীরগঞ্জ, হরিপুর), মো. নুরুল হক (পিতা বিশু মণ্ডল, মল্লিকপুর, হাকিমপুর), মো. নুরুল হক (পিতা লেবরু মোহাম্মদ, হরিণমারী, বালিয়াডাংগী), আমির উদ্দিন (পিতা গফুর উদ্দিন, বেলহার, বালিয়াডাংগী), মো. ফারাদ উদ্দিন (পিতা মো. আ. গফুর, দনগাঁও, হরিপুর), মো. আজিজুল হক (পিতা মো. আতিয়ার রহমান মণ্ডল, দোয়াপুর, চিরিরবন্দর), আ. লতিফ (পিতা তমেজ উদ্দিন, রামচন্দ্রপুর, ফুলবাড়ী), আজাহার আলী (পিতা আজর উদ্দিন, মহতুল্লাপুর, দিনাজপুর সদর), মো. জহির উদ্দিন (পিতা আছির উদ্দিন, ভেরম, ফুলবাড়ী), মো. আবুল কাশেম (পিতা মো. কবির মিয়া, মিরপুর, ফুলবাড়ী), খাজির উদ্দিন (পিতা নহর উদ্দিন, হরিপুর, নবাবগঞ্জ), আব্দুল ছাত্তার (পিতা আব্দুল আজিজ, শিহিরপুর, হরিপুর), মো. সজির উদ্দিন আহমেদ (পিতা পিয়ার মোহাম্মদ, বহতি, হরিপুর), মো. তমিজ উদ্দিন (পিতা বশির উদ্দিন, দেবনগর, তেঁতুলিয়া), মো. আমান উল্লা (হরিপাড়া, বালিয়াডাংগী), আ. আজিজ (পিতা মলি বক্স, কারিপুর, রানিশংকৈল), মো. নজরুল ইসলাম (পিতা মোবারক আলী, রঞ্জয়পুর, নবাবগঞ্জ), হবিবর রহমান (পিতা তসর মোহাম্মদ, বকুরা, হরিপুর), ব্রজমোহন (পিতা গদাধর বর্মণ, গোরকই, রানিশংকৈল), মো. আব্দুল জলিল (পিতা মো. তজির উদ্দিন, বালিহারা, হরিপুর), মো. ইব্রাহিম মিয়া (পিতা ফজর মোহাম্মদ, সুন্দরা, দিনাজপুর সদর), সফিউর রহমান (পিতা সাইদুর রহমান, জামগ্রাম, ফুলবাড়ী), মো. সমির উদ্দিন (পিতা মো. জবির উদ্দিন, খোদমাধবপুর, দিনাজপুর সদর), মো. মতিয়ার রহমান (পিতা অহির উদ্দিন, মিরপুর, ফুলবাড়ী), মো. রহিমউদ্দিন মণ্ডল (পিতা আরেফ উদ্দিন মণ্ডল, ভেরম, ফুলবাড়ী), বছির উদ্দিন সরকার (পিতা বহমুদ্দিন সরকার, সুন্দরনগর, পার্বতীপুর), মো. আসাদুজ্জামান (পিতা বানু মোহাম্মদ মণ্ডল, হেলেঞ্চা, নবাবগঞ্জ), দারাজ উদ্দিন (পিতা মো. তছির উদ্দিন, দাউদপুর, বিরামপুর), মো. মফিজ উদ্দিন (পিতা ফলি মোহাম্মদ, কালীপুর, রানিশংকৈল), মজিবুর রহমান (পিতা ইয়াকুব আলী চৌধুরী, পূর্বজগন্নাথপুর, বিরামপুর), ইয়াদ আলী (পিতা তালেব আলী মুন্সি, মুহাড়াপাড়া, হাকিমপুর), ফয়জুর রহমান (পিতা আব্দুল বাছেদ, সুবাদপুর, কোতোয়ালি, দিনাজপুর), সাফিয়ার রহমান (পিতা সৈয়দুর রহমান, জামগ্রাম, ফুলবাড়ী), রিয়াজুল ইসলাম (পিতা আব্দুর রাজ্জাক, মুরাদপুর, কোতোয়ালি, দিনাজপুর), আব্দুর রশিদ খোকা (পিতা হাজী আজিমুদ্দিন, বিন্যাকুড়ি, ঘোড়াঘাট), এরশাদ আলী (গোয়ালহাট, কোতোয়ালি, দিনাজপুর), শামা (খোদমাধবপুর, মিস্ত্রিপাড়া, বিরল), আমিনুল ইসলাম (মহেষপুর, নবাবগঞ্জ), কুদ্দুস আলী (ঠাকুরগাঁও, আনসার সদস্য), হাসান আলী (সেতাবগঞ্জ চিনিকলের ড্রাইভার), মোহাম্মদ আলী (সুন্দরগ্রাম, কোতোয়ালি, দিনাজপুর), লোকমান হাসান, গাজী রহমান, রবিউল হক (সেনাসদস্য), আবু হানিফ তাজ (ঐ), আব্দুল জব্বার (ঐ), আকবর মিয়া (ঐ), ফজলুল বারি (ঐ), রোকন উদ্দিন (ঐ), মজিবর রহমান (ঐ), আব্দুল খালেক (ঐ), সোনা মিয়া, নায়েক হারিস আলী, গোলজার রহমান, আবু বক্কর সিদ্দিক, সিরাজুল ইসলাম (সিনিয়র কুক), সুবেদার রওশন মোল্লা, হাবিলদার হারিস, হাবিলদার ইয়াসিন মিয়া, মো. আবু বকর, মো. নুর মোহাম্মদ, আতিয়ার রহমান, মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন, আলতাফ হোসেন, সজিবর রহমান, সাখাওয়াত হোসেন, মাজহারুল হক (পিতা জহুরুল হক, রানিশংকৈল), একরামুল হক (বোয়ালদার, হাকিমপুর), সৈয়দ আইয়ুব আলী (পিতা সৈয়দ আ. জব্বার আলী, চকদেওতৈড়, দিনাজপুর সদর), নায়েক সুবেদার রওশনউদ্দিন (পানিঘাটা, মোহাম্মদপুর, যশোর), নায়েক সুবেদার ফয়জুদ্দিন (পশ্চিম লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী), হাবিলদার ইয়াসিন আলী (শিবপুর, রায়পাড়া, নোয়াখালী), নায়েক আলমগীর কবির (পিতা আ. মান্নান, রাজপট বরিহাট, আশিয়ানী, ফরিদপুর), নায়েক হাসমত আলী (পিতা ইউসুফ আলী, গোবিন্দপুর, বুড়িচং, কুমিল্লা), আ. বারেক (পিতা আবুল হোসেন, সরদারপাড়া, মহারাজারহাট, পঞ্চগড়), তফিজুদ্দিন (কালাকাটা, রংপুর), হানিফউদ্দিন (পিতা আফতাবউদ্দিন, শালবাগান, তেঁতুলিয়া), মো. হাফিজউদ্দিন (ধাক্কামারা, বোদা), শরিফউদ্দিন (হারাদিঘী, তেঁতুলিয়া), কমলাকান্ত বর্মণ (পিতা বিশ্বনাথ বর্মণ, চারোল, বালিয়াডাংগী), সৈয়দ আহমেদ (বোধগাঁও, আটোয়ারী, পঞ্চগড়), আবুল কাশেম (পিতা বরকতুল্লাহ, শালখুরিয়া, নবাবগঞ্জ), জহুরুল ইসলাম (বাজিতপুর, নবাবগঞ্জ), তোফাজ্জল হোসেন (পিতা কামাল খন্দকার, বেড়ামালিয়া, নবাবগঞ্জ), মো. নজরুল ইসলাম (পিতা তছির উদ্দিন মণ্ডল, মীরপুর, ফুলবাড়ী), মো. আফজাল হোসেন (পিতা পরমাসু মণ্ডল, মীরপুর, ফুলবাড়ী) এবং মোজাফফর আহমেদ মণ্ডল (পিতা রহস্যে মণ্ডল, মীরপুর, ফুলবাড়ী)। [মাসুদুল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড