You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর সদর উপজেলা

দিনাজপুর সদর উপজেলা ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের জনগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-কে পূর্ণ সমর্থন জানায়। এর ফলে দিনাজপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী এমএনএ এবং মো. আব্দুর রহিম এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ডাকে যে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হয়, তাতে উপর্যুক্ত জনপ্রতিনিধিদ্বয় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা আবদুত (তোয়াব ভাই), আমজাদ হোসেন প্রমুখ। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও নবগঠিত সেচ্ছাসেবক বাহিনী অসহযোগ আন্দোলকে সর্বাত্মক সফল করার জন্য একযোগে কাজ করে।
৮ই মার্চ ঢাকা রেডিও থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ- প্রচারিত হওয়ার পর সারাদেশের মতো দিনাজপুরের জনগণও স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত হয়। এ- সময় দিনাজপুরের বিহারি ও অবাঙালিদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। পাকবাহিনী গোপনে দিনাজপুর ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স-এর প্রধান লে. কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে ঐদিন (৮ই মার্চ) গঠিত হয় দিনাজপুর জেলা সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী এমএনএ, মো. আব্দুর রহিম এমপিএ, শাহ মাহাতাব, শাহ মো. ইউসুফ, আমানুল্লাহ্ সরকার, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, ডা. নইমুদ্দিন, হবিবর রহমান, জিল্লুর রহমান, মিজানুর রহমান, আব্দুস সামাদ, আহম্মদ হোসেন, মোকসেদ আলী, গুরুদাস তালুকদার, গোলাম রহমান, ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল, মতিয়ুর রহমান, মজিদ চৌধুরী, এ টি এম মকবুল হোসেন, তেজন নাগ, রাদিক চৌধুরী, আজিজুল ইসলাম, মিয়া রিয়াজুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন, আব্দুল লতিফ, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, এস এ বারী এ টি প্রমুখ। এঁদের পরিচালনায় এখানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয় এবং পরবর্তীকালে এঁরাই এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন।
৯ই মার্চ সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য পাড়ায়-পাড়ায় রাতের বেলা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। ১০ই মার্চ থেকে দিনাজপুর সদরে লাঠি-সোঁটা, তীর-ধনুক, বল্লম, তরবারি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র তৈরির ধুম পড়ে যায়। এদিন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র ব্রিগেড ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ-দুটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছিলেন— ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রহিম, সাধারণ সম্পাদক মো. মহিদুল ইসলাম, জাফর আলী, সরিফুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান মানিক, তৌহিদুল ইসলাম, মো. জাকারিয়া, মোকছেদ, নুরু প্রমুখ। এঁদের উদ্যোগে দিনাজপুর একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ছাত্র ইউনিয়নের আর্য পুস্তকাগার প্রাঙ্গণে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পাশাপাশি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা তাঁদের গণেশতলাস্থ কার্যালয়ে গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম-কানুন, আক্রমণভাগ রচনা, সম্মুখ যুদ্ধ, ককটেল মলোটভ বোমা তৈরির কৌশল, যুদ্ধ বিষয়ক গোল টেবিল আলোচনা, গোপন প্রশিক্ষণ, চেগুয়েভারার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে ছাত্র- যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গণযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। এ কার্যক্রমের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুস সামাদ, মিজানুর রহমান, মঞ্জুর হোসেন, সৈয়দ মাহবুব হোসেন প্রমুখ।
১১ই মার্চ দিনাজপুর জেলার অবসরপ্রাপ্ত আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও সেনা সদস্যবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য এগিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে অসহযোগ কর্মসূচিও অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ ও অফিস- আদালত বন্ধের কর্মসূচি জোরদারভাবে পালিত হতে থাকে। ১৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন- ‘লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ তাঁর এ বিবৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দিনাজপুরবাসী স্ব-স্ব এলাকায় অসহযোগ কর্মসূচিকে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। ১৬ই মার্চ পর্যন্ত পাড়ায়- পাড়ায় পাহারা অব্যাহত থাকে। মানুষজন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। দিনাজপুরের এমএনএ ও এমপিএ- দের প্রায় সকলেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ঢাকা থেকে স্ব-স্ব এলাকায় চলে আসেন। ১৭ই মার্চ দিনাজপুর শহরে একটি সশস্ত্র মিছিল বের হয়, যা অসহযোগ আন্দোলনরত দিনাজপুরবাসীর মনে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে। ১৯শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ কর্মসূচি অপরিবর্তিত থাকে।
অপরদিকে দিনাজপুরের নেতৃস্থানীয় অবাঙালিদের মধ্যে জোহা, ফরিদী, ইরাকী, সামাদ, এডভোকেট শামীম, বাচ্চা খান প্রমুখ দিনাজপুর ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স-এর প্রধান লে. কর্নেল কোরেশীর নেতৃত্বে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ২০শে মার্চ পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি ফাস্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট দিনাজপুর সার্কিট হাউজে অবস্থান নেয়। এদিন দিনাজপুর শহরে কয়েকটি জঙ্গি মিছিল বের হয়। বালুবাড়ি বলাইয়ের মোড় থেকেও একটি জঙ্গি মিছিল বের হয়, যাতে অনেক মহিলা অংশগ্রহণ করেন। মিছিলে অনেকের হাতে লাঠি, বল্লম, সড়কি, তরবারি ও তীর-ধনুক ছিল। সেদিন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত ছিল দিনাজপুর শহর। ২১শে মার্চ বালুবাড়ির অবাঙালি ব্যবসায়ী ঈসা মিঞা তার ডিজেল বাসের চাকায় আগুন দিয়ে থানায় এজাহার দেয় যে, বাঙালিরা তার গাড়িতে আগুন দিয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্নেল কোরেশী ও মেজর তারেক ডেপুটি কমিশনার ফয়েজ আহমেদকে কারফিউ জারি করার জন্য চাপ দেয়। এর প্রতিবাদে দিনাজপুরবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২২শে মার্চ আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বুকে তীরবসানো একটি কুশপুত্তলিকা নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে দিনাজপুর জেলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা ওড়ানো হয়।
২৫শে মার্চ খবর আসে যে, পাকসেনারা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী অস্ত্র নিয়ে দিনাজপুর শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। এ-খবরে জনসাধারণ দিনাজপুর শহরসহ অন্যান্য থানার মহল্লায়-মহল্লায় সারারাত পাহারার ব্যবস্থা করে। কিন্তু আনুমানিক রাত ১টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে ভয় পেয়ে পাহারারত জনগণ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই পাকসেনাদের সাঁজোয়া গাড়ি ও মেশিনগানের গুলির শব্দ শোনা যায়। প্রায় সারারাত এলোপাতাড়ি গুলি চলে। ভয়ে, আতঙ্কে ও উৎকণ্ঠায় সকলের রাত কাটে। পরের দিন সকালে দেখা যায়, জনমানবহীন রাস্তায় শুধু পাকসেনাদের সাঁজোয়া গাড়ির বহর, আর বাড়িতে-বাড়িতে টেলিফোন লাইন কাটা।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার খবর ২৬শে মার্চ ভারতীয় বেতারে প্রচারিত হলে দিনাজপুরের নেতৃবৃন্দ গোপন স্থানে মিলিত হন এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। অন্যদিকে পাকসেনাদের একটি দল দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করে আস্তানা গাড়ে। এর প্রতিবাদে জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে দিনাজপুর শহর প্রকম্পিত করে তোলে। দশমাইল এলাকার রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে পাকসেনারা হবিবুর রহমান চেয়ারম্যানের ছোটভাই মনু মিঞাসহ ৫ জনকে ধরে এনে দিনাজপুর মিশন হাসপাতালের উত্তর-পশ্চিমস্থ পুলের কাছে হত্যা করে। এর ফলে সাধারণ মানুষ চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দিনাজপুর কুঠিবাড়িস্থ ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা। ২৮শে মার্চ এ সম্মিলিত বাহিনী -দিনাজপুর কুঠিবাড়ি ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণ- করে পাকিস্তানপন্থী ইপিআর-দের হটিয়ে দেয়। ২৯শে মার্চ প্রায় সারারাত হানাদারদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে। ৩০শে মার্চ ভোরের দিকে হানাদাররা সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে গেলে দিনাজপুর শত্রুমুক্ত হয়। এরপর কে বি এম কলেজে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেন মোহাম্মদ মোহসীন, ইসমাইল হোসেন, মকবুল হোসেন ও সাদেক আখতার। এ ক্যাম্পে জেলার অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর, পুলিশ ও আর্মির সদস্যগণ প্রশিক্ষণ দেন। স্থানীয় জনগণ খাদ্য-সামগ্রী ও টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করে। ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে শিকদারগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়েও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। এছাড়া দিনাজপুর শহরের স্টেডিয়ামে আনসার এডজুট্যান্টের সহায়তায় কয়েকশ যুবক ল্যান্স নায়েক জর্জের নিকট রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়।
৩০শে মার্চ দিনাজপুরে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। এদিন জেলখানার গেট খুলে সকল বাঙালি আসামি ও কয়েদিদের মুক্ত করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নিযুক্ত করা হয়। ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চতর যুদ্ধকৌশল রপ্ত করার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে গমন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দিনাজপুর সদর উপজেলায় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ল্যান্স নায়েক জর্জ দাস, বেশার উদ্দীন আহমেদ (বেশার মাস্টার), মহিউদ্দিন মাস্টার, আনোয়ারুল কাদের জুয়েল, আবু তোরাব আমানুল্লাহ (লায়ন), মো. আবুল হাসেম তালুকদার, অধ্যাপক সফর আলী প্রমুখ।
৩০শে মার্চ দিনাজপুর সদর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর নতুন করে হানাদারদের প্রবেশ প্রতিহত করার জন্য দশমাইল, ভুষিরবন্দর, মহারাজার মোড়, ফুলবাড়ি মোড় এবং কাউগা মোড়ে প্রতিরোধ তৈরি করা হয়। দশমাইল ও ভুষিরবন্দর এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে যে প্রতিরোধ তৈরি করা হয়, তাতে কে বি এম কলেজ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাও অংশগ্রহণ করেন। এখানকার প্রতিরোধ ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীন মাস্টার। প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারীদের সাহায্যের জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ শুকনো খাবার, চালভাজা, মুড়ি, চিড়া, গুড় ইত্যাদি জেলা সংগ্রাম পরিষদের নিকট জমা দেয়।
৩১শে মার্চ দিনাজপুর ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে পাকসেনাদের প্রতিরোধকল্পে একটি সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের দাবি এবং জনগণকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ সভায় আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী এমএনএ, মো. আব্দুর রহিম এমপিএ, গোলাম রহমান, এ এম আই জেড ইউসুফ, গুরুদাস তালুকদার প্রমুখ নেতা ভারতে গিয়ে ভারত সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন এবং বাংলাদেশের অন্যান্য নেতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করবেন। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উক্ত নেতারা ২রা এপ্রিল ভারতে যান। এ-সময় মুন্সিপাড়ায় অবাঙালি সৈয়দ হাসমত উল্লাহর পরিত্যক্ত বাড়িতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অফিস চালু করা হয়। ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত দিনাজপুর জেলা হানাদারমুক্ত ছিল। এ-সময় স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে সবকিছু পরিচালিত হতো।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংকসহ দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। তারা বৃষ্টির মতো গোলাগুলি করতে-করতে রাস্তার সমস্ত অবরোধ ভেঙ্গে অগ্রসর হতে থাকে। এ-সময় রাস্তার দুপাশের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে ধ্বংসলীলা চালায়। এতে মাহাতাব বেগসহ শতাধিক মুক্তিসংগ্রামী শহীদ হন। পার্বতীপুর-দিনাজপুর ও ফুলবাড়ী-দিনাজপুর রোড ধরেও সাঁজোয়া পাকবাহিনী অগ্রসর হতে থাকে। তদের আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে দশমাইল, গাবুরা ও কাউগাঁ মোড়ের প্রতিরোধ চৌকির মুক্তিসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হন। সারা শহরের লোকজন সন্ধ্যার মধ্যেই সীমান্তের দিকে চলে যায়। পাকবাহিনী পুনরায় কুঠিবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। দিনাজপুর রাজবাড়িকেও তারা অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া দশমাইল, মোহনপুর ও খানপুরে তারা স্থায়ী বাংকার নির্মাণ করে।
উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিরা হলো- রহমান মিয়া (নতুন শহর), আবদুস সাত্তার (নতুন শহর), রফিকুন নেসা (নতুন শহর), ফজল ইমান (নতুন শহর), ইসমাইল (নতুন শহর), আবদুস সামাদ (ঘুঘুডাঙ্গা), আবদুল হক (লালবাগ), তসলিম ওরফে বুধু (লালবাগ), মনিরুদ্দিন (রামনগর), আবদুর রহমান (বাহাদুর বাজার), আবদুল আজিজ (গোবরাপাড়া), মুকলেসুর রহমান (গোবরাপাড়া), শামসুল আবেদিন (বাহাদুর বাজার), মোহাম্মদ নাজির (নতুন শহর), আবদুল লতিফ (নতুন শহর), সিরাজুল ইসলাম (চৌধুরী বালুবাড়ি), আব্বাস আলী (নিউ টাউন), গোলাম রাব্বানী (সদর হাসপাতাল), রাব্বুউল হোসেন (সদর হাসপাতাল), ফজলে হক (পাহাড়পুর), আমিনুর রহমান মন্টু (মুন্সিপাড়া), মীর আবদুল মজিদ (গণেশতলা), তাহেরউদ্দিন আহমেদ (গণেশতলা), মোহাম্মদ হাফিজ ইব্রাহিম (রামনগর), মোজাম্মেল হোসেন (ওমরপাইল), মাহাতাব (মাহাতুল্লাহপুর), আবদুল জাব্বার (ওমরপাইল), গিয়াসউদ্দিন (ওমরপাইল), খোদা বকস, জাবদুল হক (করনাই), নাদের হোসেন (করনাই), সোহরাব আলী (খালখল্লী), জিলুর রহমান (করনাই), মোয়াজ্জেম হোসেন (শাহাপাড়া), আফজল হোসেন (বাকরীপুর), লাল মোহাম্মদ (জয়ানন্দ), আবদুর রহমান (সুবনা), মোহাম্মদ সিদ্দিক (করনাই), মজিরউদ্দিন (কালীবাড়ি), গিয়াস মোহাম্মদ (মেরীগঞ্জ), ফাতেমা বেগম (মিশন রোড), মেহেরুন নেসা (চাষীপাড়া), ইকবাল হোসেন (চুড়িপট্টি), ওয়াসিম (আলমনগর), মতিয়ার রহমান (কাটাবাড়ি), রোস্তম আলী (মুন্সিপাড়া), মালিক শওকত হায়দার (মুন্সিপাড়া), শুকরা বিবি (নতুন শহর), জাহেদা খাতুন (নতুন শহর), আবদুল বশির (কাটাবাড়ি), আবদুল ওয়াহেদ (মারগ্রাম), আবদুল লতিফ (উত্তর মাহৎপুর), মোহাম্মদ আসানুলাহ সিদ্দিক (নিউ টাউন), আবদুল আজিজ (খানপুর), ওমর আলী (খানপুর), নূর মোহাম্মদ (কুটিরি), আবদুল মজিদ (গোপালপুর), আবদুল মোমেন (দক্ষিণ রূপপুর), আবদুল হামিদ জিলানী (পাহাড়পুর), শামসের আলী (বালুবাড়ি), কাজী মোহাম্মদ নূরুল হুদা (বালুয়াডাঙ্গা), জোহা, ফরিদি, ইরাকী, সামাদ, শামীম, বাচ্চাখান, রিয়াজুল ইসলাম (শান্তি কমিটির সভাপতি), আবুল কাশেম (শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), নঈম, হাবিবুল্লাহ, আফতাব মেম্বার, ইছা মিঞা, ডা. গফুর, হাবিবুল্লাহ মৌলভী, মাঈনুদ্দিন মৌলভী, ইসমাইল হোসেন সরকার প্রমুখ। এরা প্রথমে শান্তি কমিটি এবং পরে -রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে শহরে জ্বালাও-পোড়াও, ধর্ষণ, লুটপাট ইত্যাদি তাণ্ডব চালায়। উপশহর এলাকায় রাজাকার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। পাকবাহিনীর এ দোসররা আওয়ামী লীগের নেতা- কর্মী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা এবং হিন্দু পরিবারের মানুষজনের সন্ধান করে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় কারো-কারো বাড়িতে আস্তানা গেড়ে নিরীহ মানুষদের নির্যাতন ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে। সেই সঙ্গে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাসের শুরু পর্যন্ত দিনাজপুর সদরে ব্যাপক নির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। এ-সময় তারা বহু নারীকে নির্যাতন করে এবং পরিকল্পিতভাবে এ অঞ্চলের বরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, এডভোকেটসহ বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর দিনাজপুর সদর উপজেলার প্রতিটি গ্রামের মাঠ-ঘাট, ডোবা-নালা, নদী- পুকুর, শহর-শহরতলী সর্বত্র শুধু মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় দেখা গেছে। পাকবাহিনীর বাংকারগুলোতে পাওয়া গেছে মানুষের কংকাল, নারীদের দীর্ঘ চুল, বসন, চুড়ি ইত্যাদি। শহরে খুব কম বাড়িই পাওয়া যায় যা লুণ্ঠিত হয়নি। পাকসেনা ও তাদের দোসরদের নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে আজো টিকে আছে দিনাজপুর শহরের বেশ কয়েকটি পাড়া, মহল্লা ও এলাকা। ১৪ই এপ্রিল পাকসেনারা দিনাজপুর শহর পুনরায় দখলে নিয়ে নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ আহত ছাত্রনেতা আবু আহমেদ আসাদুল্লাহ ‘৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঘরে বসে পোস্টার লিখে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু পাকসেনারা তাদের দোসরদের মাধ্যমে এ-খবর জানতে পেরে ১৪ই এপ্রিল মুন্সিপাড়াস্থ তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে ধরে এনে প্রথমে বেয়নেট চার্জ করে, পরে জিপের পেছনে বেঁধে দিনাজপুর জেলা স্কুলের কাছে নিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ১৭ই এপ্রিল পাকসেনাদের একটি সাঁজোয়া গাড়ি দিনাজপুর শহর থেকে এলোপাতাড়িভাবে গুলি করতে-করতে ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু চেরাডাঙ্গীর লক্ষ্মীজল সাঁকোর কাছে তারা বেরিকেডের সম্মুখীন হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা দূরপাল্লার শক্তিশালী রকেট নিক্ষেপ করে মহব্বতপুর, পাইকপাড়া, তাজপুর ও মহররমপুরের বেশকিছু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এদিনই তারা পাইকপাড়া নিবাসী তরুণ শিক্ষক রুস্তম আলীকে ধরে নিয়ে লক্ষ্মীজলের সাঁকোর কাছে হত্যা করে। ২৯শে এপ্রিল রাজাকাররা রোগী দেখানোর কথা বলে দিনাজপুর সদর হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. আব্দুল জব্বারকে তাঁর বাসভবন থেকে চেম্বারে ডেকে নিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে
মে মাসের প্রথমদিকে পাকসেনা ও তাদের দোসররা বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করে দিনাজপুরের উপকণ্ঠে বালুয়াডাঙ্গার নিকটবর্তী কুঠিবাড়ির গা-ঘেঁষা কাঞ্চন নদীতে ফেলে দেয়। রাজাকাররা শহরের বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এডভোকেট সুমঙ্গল কুমার কুণ্ডুকে তাঁর বড়বন্দরের বাসভবন থেকে রেলবাজার হাটে নিয়ে হত্যা করে। দিনাজপুরের বিশিষ্ট সংগীত শিক্ষক ও শিল্পী সতীশ সরকার (মনুদা)-এর দুচোখ তুলে নিয়ে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করে। তারা ইউনাইটেড ব্যাংকের স্থানীয় শাখার ডেভেলপমেন্ট অফিসার সজির উদ্দীন, দিনাজপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ওয়াহেদুর রহমান, ওয়াপদার প্রকৌশলী ওবায়দুল হক, বিশিষ্ট ভাসানী ন্যাপ- কর্মী ইসমাইল হোসেন (পল্টু), এডভোকেট হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক শাহ সোলায়মান, মোক্তার জহির উদ্দীন আহমদ, বিশিষ্ট সমাজসেবী মো. আমিন, ডা. সুজাউদ্দীন, ডা. আব্দুল গফুর প্রমুখ কৃতী সন্তানকে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে।
নভেম্বর মাসে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা দিনাজপুর সদরের খানপুর, জামালপুর, বড়গ্রাম, ঘুঘুডাঙ্গা, উথরাইলসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে অত্যাচার, লুণ্ঠন, হত্যা ও নারীনির্যাতন চালায়। এদের নির্যাতন ও গণহত্যা এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে, ঢেপা, পুনর্ভবা ও করতোয়া নদী বাঙালিদের লাশে ভরে উঠেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২০শে নভেম্বর পবিত্র ঈদের দিনও নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালাতে দ্বিধাবোধ করেনি। পাকসেনা ও তাদের দোসরদের হাতে এ জেলায় কয়েক হাজার লোক নিহত হয়।
দিনাজপুর সদরের কুঠিবাড়ি ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সকে পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে শতশত মানুষকে বন্দি করে তারা নির্যাতন চালায়। তাছাড়া রাজবাড়ির অস্থায়ী ক্যাম্পেও পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা বাঙালিদের বন্দি করে এনে নির্যাতন করত। সদরের মোহনপুর ডাকবাংলোটিকেও পাকবাহিনী বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে।
দিনাজপুর সদরের সার্কিট হাউজের পেছনে জুলুম সাগর ও তার চারদিকের পাড়কে পাকবাহিনী বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। হত্যার পর সেখানে তারা শতশত লাশ কবর দেয়। কাঞ্চন নদীর পাড়েও একটি বধ্যভূমি ও গণকবর ছিল, যা নদীভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। দক্ষিণ কোতোয়ালির তীরশুলায় একটি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। দিনাজপুর শহর থেকে দশমাইল যাওয়ার পথে খালখল্লী ব্রিজের নিচে পাকবাহিনী ২৭শে মার্চ একটি গণহত্যা চালায়, যা খালখল্লী ব্রিজ গণহত্যা নামে পরিচিত। এ স্থানটিও একটি বধ্যভূমি ছিল। দিনাজপুর সদর হাসপাতালের নতুন ভবনটি পাকসেনা ও তাদের দোসররা হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করে। দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার গোদাগাড়ি হাট ও মোহনপুর ব্রিজের কাছে একটি এবং বকসী দীঘিতে একটি গণকবর রয়েছে। দশমাইল মোড় ও চেহেলগাজী মাজার শরীফে দুটি গণকবর রয়েছে। স্বাধীনতার পরপর ২দিনাজপুর মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি-তে শহীদ ১৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে চেহেলগাজী মাজার গণকবর-এ সমাহিত করা হয়।
মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে ১১-১৭ জুলাই পর্যন্ত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তাহব্যাপী ঐ সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। দিনাজপুর অঞ্চল ৬ ও ৭ নং সেক্টরের অধীনস্থ হয়।
সম্মেলনে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কেও ব্যাপক আলোচনা হয়। অবশ্য এর আগেই মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দিনাজপুরে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় যেসব যুবক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন, জুন মাসের প্রথমদিকে তাঁদের অনেকেই ফিরে আসেন এবং জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বিরল ও ঘুঘুডাঙ্গায় গেরিলা অপারেশন চালান। জুলাই মাসের ৪ তারিখ মেজর নাজমুল হক কাঞ্চন সেতুর ওপরে অবস্থিত পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ আক্রমণ সফল না হলেও এতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৯ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পাকসেনাকে হতাহত করে। এরপর শান্তি কমিটির সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। অবাঙালিরা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করতে থাকে। পাকসেনারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রচার চালায় যে অবস্থা স্বাভাবিক, অফিস-আদালত খোলা। তারা আরো ঘোষণা করে যে, ২৮শে জুলাইর মধ্যে বালুয়াডাঙ্গা ও বালুবাড়ির অধিবাসীরা নিজ-নিজ বাড়িঘর ও দোকানপাটে ফিরে না এলে তাদের মালিকানা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এ- দুটি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ছিল বেশি। তাঁরা মাঝে-মধ্যেই গেরিলা আক্রমণ চলাতেন।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে গেরিলা আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এ-সময় এমন একটি কথা প্রচারিত হয় যে, ১৪ই আগস্টের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াবেন। এ-কথা দিনাজপুরের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে নতুন আশার আলো সঞ্চার করে। এ কারণে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই বেশার উদ্দীন মাস্টারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের বড়গ্রাম ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে কোয়ার্টার মাইল উত্তরে একটি বাঁশঝাড়ে লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানে এলএমজি নিয়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্সে ছিলেন। তাঁদের হাতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। এ-সময় শাজাহান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৪ই আগস্ট দিনাজপুর সদরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এদিন পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ছিল বলে দিনাজপুর শহরে পাককর্তৃপক্ষ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পালন করার নির্দেশ দেয়। শহরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা রামসাগর এলাকায় গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান, যা দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এরপর ২৪শে আগস্ট দিনাজপুরের দক্ষিণ কোতোয়ালির কুতোর গ্রামে একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মহিউদ্দীন মাস্টার, নঈমুল হুদা ও আব্দুল হাকিম নামে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এরপর থেকে বিরল, ফুলবাড়ি, হিলি ও রামসাগর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। তাঁরা ভারতীয় আর্টিলারির সহায়তায় একের পর এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। এ কারণে ভারতীয় সীমান্ত-সংলগ্ন, বিশেষত বোচাগঞ্জ, বিরল, কমলপুর, তাজপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পাকসেনারা তাদের ক্যাম্প সরিয়ে নেয়।
৩০শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণ কোতোয়ালির ঘুঘুডাঙ্গার লালমাটিয়ায় অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত লালমাটিয়া পাকক্যাম্প যুদ্ধ-এ অর্ধশতাধিক পাকসেনা নিহত হয় এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শহীদ হন।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্বপরিস্থিতি পাকিস্তানের প্রতিকূলে যেতে শুরু করে। ফলে, পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে ৩রা অক্টোবর ঘুঘুডাঙ্গার স্কুল পাড়ায় পাকসনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস, লে. সাইদুল্লাহ, লে. আমিন, লে. কায়সার, সুবেদার এম এ রহমান, সুবেদার ইয়াসিন, হাবিলদার হাসান, হাবিলদার আজিজ, প্লাটুন কমান্ডার দেলোয়ার হোসেন, এফ এফ বাবুল, আব্দুল লতিফ, আব্দুর রাজ্জাক, নূর মোহাম্মদসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা বহু গোলা-বারুদ, এক ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এলএমজি, দুই ইঞ্চি মর্টার এবং কয়েকটি চাইনিজ অটো রাইফেল হস্তগত করেন। এ সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ব্যাপক অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে এ বিজয়বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।
নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ দিনাজপুর সদরের কমলপুর ইউনিয়নের বড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন মো. লুৎফর রহমান, শাহাবুদ্দিন, সাহেব আলী, অহিদুল ইসলাম, রতন, মামুন, ইব্রাহিম, মফিজ, ইলিয়াস, সোহরাব প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করেন। একটি দল স্কুলে এবং অন্যটি কিছু দূরে একটি বাঁশঝাড়ে অবস্থান নেয়। বড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যুদ্ধ-এ ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং পাকমেজর নাসির আহত হয়। এ-সময় সীমান্তবর্তী বোচাগঞ্জ, বিরল ও কমলপুর অঞ্চলে রাজাকার, আলবদর ও পাকসেনাদের লুঠতরাজ বন্ধ করার জন্য ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হতো। তাঁরা অপারেশন চালিয়ে আবার ভারতে ফিরে যেতেন।
মুক্তিযোদ্ধারা ১২ই নভেম্বর থেকে দিনাজপুর সদর দখলের যুদ্ধ শুরু করেন। এ উদ্দেশ্যে হামজাপুর সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নির্দেশে ল্যান্স নায়েক জর্জ দাস ৯৮ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শিববাড়ি ক্যাম্প থেকে হামজাপুর ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হন। ঐদিনই বিকেল ৪টার দিকে ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে তাঁরা খানপুর এলাকা দখল করেন। ১৫ই নভেম্বর পাকসেনারা ট্যাংক নিয়ে খানপুর দখলের চেষ্টা করলে তিন স্কোয়াড্রন ভারতীয় ট্যাংক মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয় এবং এক পর্যায়ে পাকসেনারা পিছিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষের কয়েকটি ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা খানপুরে তাঁদের অবস্থান আরো দৃঢ় করেন এবং ঘুঘুডাঙ্গা তাঁদের দখলে আসে।
২০শে নভেম্বর পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনও দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে খণ্ডযুদ্ধ হয়। ২৩শে নভেম্বর পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। এদিন পাকিস্তানের চারটি জঙ্গিবিমান আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে ভারতীয় বিমান বাহিনী তিনটিকে ভূপাতিত করে। অন্যদিকে দিনাজপুর সদরের রামসাগরের দক্ষিণ পাড়েও প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
২৬শে নভেম্বরের পর থেকে বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ ও খানপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেন। পঞ্চগড় অঞ্চল দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর একটি যৌথ দল দিনাজপুর সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ২৭শে নভেম্বর থেকে সেতাবগঞ্জ, বিরল ও খানপুরে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেন। ১লা ডিসেম্বর ভারতীয় আর্টিলারি ও ট্যাংক বহর সেতাবগঞ্জ, বিরল ও খানপুর বর্ডার দিয়ে এগিয়ে আসে। এদিন দুপুরের পর ঘুঘুডাঙ্গা, রামসাগর ও খানপুর এলাকায় তুমুল যুদ্ধ হয়। এ- যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হন। ১লা থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত ঠাকুরগাও-দিনাজপুর অক্ষ বরাবর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ৫ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী বীরগঞ্জ মুক্ত করে দক্ষিণ-পশ্চিমে এগিয়ে গেলে কান্তনগর সেতু এলাকায় পাকবাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাকবাহিনী সেতুটি ধ্বংস করে নদীর অপর পাড়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ৬ই ডিসেম্বর সেখানে যুদ্ধের পর অভিযান পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা রামসাগর অঞ্চলের কাছাকাছি চলে এলেও দিনাজপুর সদরে তখনো প্রবেশ করতে পারেননি। ৯ই ডিসেম্বর রাত্রিবেলা যৌথবাহিনীর দলটি কান্তনগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে এগিয়ে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ১০ই ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে তাঁরা পাকসেনাদের তীব্র গোলাগুলির সম্মুখীন হন এবং খানসামা হয়ে নীলফামারীর দিকে অগ্রসর হন। এ-সময় পাকবাহিনী দিনাজপুর থেকে খানসামায় রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠায় মিত্রবাহিনীর পর্যবেক্ষণ বিমানের পাইলটরা পাকিস্তানিদের গতিবিধি লক্ষ করে কামানের গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে পাকসেনাদের অনেকে হতাহত হয় এবং বাকিরা দিনাজপুর সদর অভিমুখে পালিয়ে যায়। ১১ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী হিলি সীমান্তে আক্রমণ চালালে তাঁদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১২ই ডিসেম্বর ব্যাপক চেষ্টার পর হিলি সীমান্ত মিত্রবাহিনীর দখলে আসে এবং তাঁরা ট্যাংক বহর নিয়ে দিনাজপুর শহর অভিমুখে রওনা হন। অন্যদিকে, ১১ই ডিসেম্বর বিরল থানায় একটি ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে যৌথবাহিনী ঐ অঞ্চল মুক্ত করে দিনাজপুর শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ১২ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর এ দলটি থেকে একটি উপদল ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও লে. সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে বিরল রেললাইন ধরে দিনাজপুর সদর অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। এক পর্যায়ে হঠাৎ সামনে থেকে শত্রুপক্ষ গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পাকসেনাদের গুলিবর্ষণ কমে গেলে মুক্তিসেনাদের কয়েকজন ক্ষেতের নালা দিয়ে ক্রলিং করে একটি গ্রামের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে কভারিং ফায়ার করতে থাকেন। ফলে, মাঠে আটকেপড়া মুক্তিযোদ্ধারা পেছনের দিকে সরে গিয়ে ডিফেন্স নেন। এ-সময় ক্যাপ্টেন ইদ্রিস গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য রায়গঞ্জ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৩ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কাঞ্চন ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে একটি অস্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করেন। কিন্তু পাকসেনারা ডিনামাইট দিয়ে সেতুটি ধ্বংস করে দিলে তাঁরা আর অগ্রসর হতে পারেননি। এদিনই যৌথবাহিনী খানসামা দখল করে নেয়। সেখান থেকে যৌথবাহিনীর একটি দল দিনাজপুর সদর অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। এ অভিযানে অংশ নেয়ার জন্য খানসামা থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের দুজন পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হলে বাকিরা খানসামায় ফিরে যান। ১৪ই ডিসেম্বর রাতে খানসামায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি শুরু করেন।
কাঞ্চন ব্রিজে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ই ডিসেম্বর সকাল থেকে দিনাজপুর সদরে প্রবেশের চেষ্টায় যুদ্ধ চালিয়ে যান। মিত্রবাহিনী রামসাগরের পাশ দিয়ে দিনাজপুরের খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেলে পাকসেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এদিন হিলি সীমান্ত থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি দল ফুলবাড়ি দখল করে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খানসামা থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে শত্রুসেনাদের ওপর আঘাত হানলে দিনাজপুর শহরে দখলদার পাকসেনাদের ডিফেন্স ভেঙ্গে পড়ে। ফলে, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করে। বেশিরভাগ পাকসেনা সৈয়দপুরে গিয়ে বিহারিদের আশ্রয় নেয়। এদিকে, কাঞ্চন নদীর পশ্চিম পাড়ের মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি ১৬ই ডিসেম্বর দিনাজপুর সদরে প্রবেশ করে এবং এদিনই দিনাজপুর সদর উপজেলা হানাদরমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মাহবুবুর রহমান, বীর উত্তম (পিতা অধ্যক্ষ মো. তছির উদ্দীন আহমেদ, ঈদগাহবস্তি) ও শাহজাহান মজুমদার, বীর প্রতীক (পিতা রজব আলী মজুমদার, কালিতলা)।
দিনাজপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (কানাইঘাট আক্রমণে শহীদ), মো. আবুল কালাম আজাদ (পিতা মো. আইয়ুব আলী, ফাসিলাডাঙ্গা), মো. আজাহার আলী (পিতা আজিমউদ্দীন, মহতুল্যাপুর), মো. আব্দুল হাই (পিতা কছিরউদ্দীন, কিসমত মাধবপুর), মো. সমির উদ্দীন (পিতা জরিপউদ্দিন মিস্ত্রী, খোদ মাধবপুর), মো. আইয়ুব আলী (পিতা খতিব উদ্দীন, খোদ মাধবপুর), মো. রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ (দিঘন), মোখলেস (পিতা বাহার উদ্দীন, দিঘন), মো. আব্দুর রশীদ (পিতা ফজির মোল্লা, দাইনুর কমলপুর), সুলতান আলী (পিতা তিন কড়িয়া, বড়গ্রাম কমলপুর), মো. মোকাররম হোসেন (পিতা শাহাজ উদ্দীন, দক্ষিণ রামনগর), মো. সফর আলী (পিতা আব্দুল মজিদ, ঘুঘুডাঙ্গা), মো. মুনির উদ্দীন আহমেদ (পিতা নবীর উদ্দীন, মহব্বতপুর), মো. মফিজুল ইসলাম (পিতা মসি উদ্দীন, করমুল্লাপুর), মো. জবেদ আলী (পিতা খাতির মোহাম্মদ, জতবহবল), মো. ফয়জুর রহমান (পিতা মো. আ. বাছের মিঞা, মুরাদপুর), মো. আবুল কাশেম (পিতা মো. সলেমন মিয়া, বিশ্বস্তপুর), মো. আফাজউদ্দীন (পিতা হাজী আমাশু মোল্যা, নুনাইচ), মো. ইরশাদ আলী (পিতা মো. তুছিরউদ্দীন, উথরাইল), মো. দেলাবর হোসেন (পিতা বাহাজউদ্দীন, খানপুর), মো. আনিছ মিয়া (পিতা চান মোহাম্মদ, খানপুর), মৌলবি ভবান চৌকিদার (পিতা করিম বকস, খানপুর), মো. লকসের আলী (পিতা ধনতুল্যাহ মিয়া, খানপুর), মো. আনোয়ার আলী (পিতা মহির মুন্সি, সরস্বতীপুর), মো. আজহার আলী (পিতা আ. কুদ্দুস, সরস্বতীপুর), মো. ইব্রাহিম হোসেন (পিতা হাজী ফজর মহাম্মদ, সুনদরা), মোহাম্মদ আলী (পিতা তিনকুডু মিয়া, সুনদরা), মো. মজিবর রহমান (পিতা মো. গফার, তাজপুর), শিশির কুমার রায় (পিতা গোবিন্দ চন্দ্র রায়, গোপালগঞ্জ), মুছা আহমেদ (গোপালগঞ্জ), কাঞ্চন কুমার রায় (পিতা গোবিন্দ চন্দ্র রায়, গোপালগঞ্জ), মো. জয়নাল হোসেন (পিতা গোলাম হোসেন খান, উত্তর মুন্সিপাড়া), মো. হাবিবর রহমান (মুন্সিপাড়া), সুমঙ্গল কুণ্ডু (পিতা যতীন্দ্ৰ মোহন কুণ্ডু, বড়বন্দর), হরিপদ (পিতা অবিরাম পাল, রাজবাড়ি), মোকলেছুর রহমান (পিতা খলিল উদ্দীন আহমেদ, সরদার পাড়া), আ ন ম গোলাম মোস্তফা (বালুবাড়ি), মো. মোজাম্মেল হক (ঈদগাহবস্তি), শেখ আলতাফ হোসেন (ঈদগাহবস্তি), অধ্যাপক মো. ওয়াজেদুর রহমান ওরফে ডাবুয়ার (ঈদগাহবস্তি), শেখ আলতাফ আলী (পিতা শেখ আকবর আলী, ঈদগাহবস্তি), মো. রমজান আলী তালুকদার (পিতা নেসারত আলী তালুকদার, ঈদগাহবস্তি), মো. হাফিজ (পিতা সিরাজুল ইসলাম, ঈদগাহবস্তি), এ এ মো. মোজাম্মেল হক (পিতা মৌলবি মো. জাফর আলী, ঈদগাহবস্তি), ডা. খোরশেদ আলী (কালিতলা), এডভোকেট আব্দুল ওয়াহাব (দিঘন শেখপুরা), শরিফ উদ্দীন আহমেদ (বালুবাড়ি), শাহনেওয়াজ (পিতা আফতাব উদ্দীন, বালুবাড়ি), মো. আমিন (পিতা পচা মোহাম্মদ, বালুবাড়ি), মো. শামসুল হক ভুটু (পিতা মোহাম্মদ আমিন, বালুবাড়ি), সতীশ চন্দ্র সরকার ওরফে মনু সরকার (বালুবাড়ি, কণ্ঠশিল্পী), ছাইফুর রহমান (বালুয়াডাঙ্গা), মো. আসাদুর রহমান (পিতা মফিজ উদ্দীন আহমেদ, বালুয়াডাঙ্গা), মিজানুর রহমান (পিতা মফিজ উদ্দীন আহমেদ, বালুয়াডাঙ্গা), মো. হামিদুর রহমান (ঘাসিপাড়া), মো. আব্দুল লতিফ (পিতা মফিজ উদ্দীন আহমেদ, ঘাসিপাড়া), অধ্যাপক মো. সোলায়মান (পিতা মফিজ উদ্দীন আহমেদ, ঘাসিপাড়া), আবু আহমেদ আসাদুল্লাহ (পিতা আল হাজ্জ্ব আফতাব উদ্দীন, মুন্সিপাড়া), মৌলবি ছাইফুদ্দিন আহমেদ (মুন্সিপাড়া), এ কে এম বরকত উল্লাহ (পিতা মৌলবি ছাইফুদ্দিন আহমেদ, মুন্সিপাড়া), এ কে এম আব্দুর রউফ (পিতা মৌলবি ছাইফুদ্দিন আহমেদ, মুন্সিপাড়া), মিজানুর রহমান (পিতা বজলার রহমান, মুন্সিপাড়া), ওবায়েদুর রহমান (পিতা বজলার রহমান, মুন্সিপাড়া), আব্দুস সালাম আবু (পিতা সামসুদ্দিন আহমেদ, মুন্সিপাড়া), আফতাব উদ্দীন আহমেদ (পিতা জনু আহমেদ, মুন্সিপাড়া), অধ্যক্ষ আবুল কাশেম (পিতা বশির উদ্দীন আহমেদ, সাদিপুর, মুরাদপুর), ডা. আবুল আমজাদ (পিতা অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, সাদিপুর, মুরাদপুর), ইসরাফিল সরকার (পিতা খসরু সরকার, গোপীনাথপুর, মুরাদপুর), আব্দুল জলিল সরকার (পিতা রহিমুল্লাহ সরকার, দানীহারী, কমলপুর), মো. ইরশাদ আলী (পিতা মো. ইমান আলী, কমলপুর), মো. ইসমাঈল পলটু (পাটুয়াপাড়া), শাহাবুদ্দীন আহমেদ(পাটুয়াপাড়া), মো. আসাদুর রহমান (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, পাটুয়াপাড়া), মো. মকবুল হোসেন (পিতা আলহাজ্জ্ব নাসির উদ্দীন আহমেদ, পাটুয়াপাড়া ছয়রাস্তার মোড়), মাহিজান (স্বামী মো. আব্দুল আজিজ, এনায়েতপুর, পাটুয়াপাড়া), মো. মিজানুর রহমান (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, পাটুয়াপাড়া), মো. মনোয়ার রহমান মনু (পিতা ফুলু সরকার, সুইহারী), মো. পেতুব উদ্দীন শাহ (পিতা তকি মো. সরকার, ঝানঝিরা), মো. সুকুম উদ্দীন (পিতা রিঝাল শাহ, ঝানঝিরা), মো. হালিম উদ্দীন (পিতা মণ্ডল, মোহাম্মদ, ঝানঝিরা), মো. হালিম উদ্দীন (পিতা শাহাবুদ্দীন, ঝানঝিরা), আছির উদ্দীন (পিতা গোফারু মোহাম্মদ, ঝানঝিরা), মো. গিয়াস উদ্দীন (পিতা ইজিবুল্লাহ, ঝানঝিরা), মো. নজিমুদ্দীন (পিতা মো. বেশার উদ্দীন, ঝানঝিরা), জাফিরণ বেওয়া (পিতা আফুদ্দীন মোল্লা, ঝানঝিরা), আব্দুল মজিদ (পিতা ফরিদুর রহমান, ঝানঝিরা), আইনুল হক (পিতা জাহাজতুল্লা, ঝানঝিরা), দীনবন্ধু রায় (পিতা ধনেশ্বর রায়, ঝানঝিরা), তমিজ উদ্দীন কাচ্চু (পিতা লাল শেখ, ঝানঝিরা), দ্বীন রায় (পিতা বাবু চান রায়, ঝানঝিরা), মো. আব্দুল গফর ডাক্তার (পিতা মো. সেরাজ উদ্দীন, ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), দারাজ তুল্লা (পিতা খাজের মো. শাহ, ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), মো. কমিদ্দিন (পিতা চান্দু মোহাম্মদ, ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), জেকেরিয়া (পিতা নেশার উদ্দীন, রাণীগঞ্জ), নেশার উদ্দীন (পিতা নহর মোল্লা, রাণীগঞ্জ), রহিম উদ্দীন (পিতা নজির মোল্লা, রাণীগঞ্জ), মো. দাবাজ উদ্দীন (পিতা মো. সাবেত শাহ, ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), শুকু মোহাম্মদ (পিতা মিনহাল মোহাম্মদ, ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), মো. শামসুদ্দীন (ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), মো. আছির উদ্দীন (পিতা মো. ফকরুদ্দীন, ঝানঝিরা, রাণীগঞ্জ), মমতাজ উদ্দীন (পিতা আবেদীন, রাণীপুর), জমিল উদ্দীন (পিতা তছির, রাণীপুর), পাঞ্চ মোহাম্মদ (পিতা জিয়াবুল্লাহ, উত্তর মহেশপুর), জবির উদ্দীন (পিতা মীর শাহ, মহারাজপুর), ডা. মো. আব্দুল জব্বার (পাহাড়পুর), মোছা. ফিরোজা খাতুন (স্বামী মো. আনিছুল হক, পাহাড়পুর), মো. মাসুদ আলম (পিতা মো. আনিছুল হক, পাহাড়পুর), মো. নূর এ আলম (পিতা মো. বদরুল আলম, পাহাড়পুর), মো. আবিবুর রহমান (পিতা রহিম উদ্দীন আহমেদ, গণেশতলা), মো. আফরাহিম (পিতা ইউসুফ আলী সরকার, গণেশতলা), আমিরুল হুদা জিন্নাহ (পিতা শামসুল হুদা, ক্ষেত্রীপাড়া; কণ্ঠ শিল্পী), মো. রেজাউল ইসলাম (পিতা মো. রফিক উদ্দীন, পাহাড়পুর), মো. মোকাররম হোসেন (পিতা শাহজাউদ্দীন, যুগীবাড়ি, চেরাডাঙ্গী), মো. মহীদ (যুগীবাড়ি, চেরাডাঙ্গী), মো. আইনুল হক (যুগীবাড়ি, চেরাডাঙ্গী), আব্দুর রশীদ (পিতা খাজির মোহাম্মদ, দাইনুর), সুলতান আলী (পিতা তিন কড়িয়া, বড়গ্রাম), মফিজ উদ্দীন (পিতা ছালমান গণি, ছালাপুকুর), আব্দুল আজিজ (পিতা আব্দুল জব্বার, আইহাই), মতিয়ার রহমান (পিতা মুজাফ্ফর রহমান, আইহাই), হাফিজ উদ্দীন (পিতা লাল মোহাম্মদ, বড়গ্রাম), আব্দুল লতিফ (পিতা হাফিজ উদ্দীন আহমেদ, চাউলিয়াপট্টি), রইসুল ইসলাম (পিতা আব্দুল রাজ্জাক, মুরাদপুর), রহমত আলী (পিতা জসিমউদ্দীন, মালিগ্রাম), আনোয়ার হোসেন (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, জামালপুর, শ্রীচন্দ্রপুর), মো. দেলোয়ার হোসেন (পিতা ওয়াজুদ্দীন মিয়া, কল্যাণপুর, শ্রীচন্দ্রপুর), সৈয়দ আইয়ুব আলী (পিতা সৈয়দ আব্দুল জব্বার, কাউগাঁ), মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা মো. জমির আলী, রাজারামপুর, শেখপুরা), আব্দুল আজিজ (পিতা আলহাজ্জ্ব আমীর উদ্দীন আহমেদ), মো. মনির উদ্দীন (পিতা রহিম উদ্দীন আহাম্মদ), আজিজুল হক মজনু (চুড়িপট্টি), রামপদ কুণ্ডু (চুড়িপট্টি), এহেসানুল ইসলাম (চুড়িপট্টি), আবুল খয়ের (চুড়িপট্টি), নিতাই চন্দ্র দাস (বড়বন্দর), নেপাল সাঁও (চকবাজার), কামাখ্যা চন্দ্র দে (চকবাজার) এবং হীরা লাল দে (চকবাজার)।
দিনাজপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। চেহেলগাজী মাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মারক ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, যা চেহেলগাজী মাজার স্মারক ভাস্কর্য নামে পরিচিত)। মোহনপুর ব্রিজের প্রবেশদ্বারে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। দিনাজপুর সদর হাসপাতালের সামনে শহীদ আসাদুল্লাহ স্কোয়ার নির্মিত হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতিস্তম্ভ। দিনাজপুর পৌরসভার ফুলবাগানে স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য – সূর্যসৈনিক। কমলপুরে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিফলক। জেলা প্রশাসন প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক। এছাড়া খাজা নাজিমউদ্দীন মুসলিম হল ও মিউজিয়ামে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক কর্নার তৈরি করা হয়েছে। [মাসুদুল হক]
দিনারপুর হাইস্কুল যুদ্ধ (নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের শেষদিকে। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নবীগঞ্জ থানার অন্তর্গত গজনাইপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম দিনারপুর। এটি শতক গ্রাম নামেও পরিচিত। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সহায়তায় দিনারপুর হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প স্থাপনের পর তারা স্থানীয় জনসাধারণের ওপর নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই হানাদার বাহিনী গজনাইপুর পাহাড় থেকে ৬-৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে আনে এবং তাদের মধ্যে ৩ জনকে স্কুল ভবনের পূর্ব কোণে হত্যা করে। এমনি অবস্থায় নভেম্বর মাসের শেষদিকে সুবেদার দেলোয়ার আলী, মাহবুবুর রহমান ও আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এ ক্যাম্প আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয় এবং নায়েক তৈয়ব আলী (১নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)-সহ ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!