You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে দিরাই উপজেলা (সুনামগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে দিরাই উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

দিরাই উপজেলা (সুনামগঞ্জ) সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি উপজেলা। ব্রিটিশ আমল থেকে এ উপজেলার জনগণ রাজনীতি-সচেতন। অতীত আন্দোলন-সংগ্রামের চেতনা হাওর অধ্যুষিত দিরাইয়ের জনগণকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন- আহ্বান কারন। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিরাই উপজেলার মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে দিরাই আসনে ন্যাপ (ওয়ালী) থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে দিরাই উপজেলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবং অপারেশন সার্চলাইট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর বর্বরোচিত পৈশাচিক আক্রমণে মেতে ওঠে। এর প্রতিবাদে দিরাই উপজেলায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিএ। অপর সদস্যরা ছিলেন- আব্দুল লতিফ সর্দার (সাকিতপুর), আব্দুল কুদ্দুছ (চণ্ডীপুর), নেজাবত আলী (চণ্ডীপুর), রণদা প্রসাদ চৌধুরী (দোওজ), আব্দুল আউয়াল (চণ্ডীপুর) এবং আব্দুল লতিফ (রাধানগর)। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (চণ্ডীপুর), সুজাত আহমেদ চৌধুরী (তাড়ল), নজরুল ইসলাম (তাড়ল), আব্দুস শহীদ চৌধুরী প্রমুখ। এপ্রিল মাসে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী (গচিয়া) ঢাকা থেকে দিরাই এসে মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেন এবং প্রাক্তন আনসার বাহিনীর সদস্যদের সংগঠিত করেন। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে অসংখ্য ছাত্র, যুবক, পুলিশ ও আনসার স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে সাড়া দেয়।
বরুণ রায় ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন দিরাই অঞ্চলের প্রাণপুরুষ। পাকসেনা অনুপ্রবেশের আগেই তাঁদের নেতৃত্বে দিরাইয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। সাবেক সৈনিক মন্তাজ মিয়া (বাগবাড়ি), ইয়াসিন মিয়া (মজলিশপুর), আনসার আব্দুল (বাগবাড়ি) ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিকামী জনগণ সংগঠিত হয়। স্থানীয় তরুণদের তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য গড়ে তোলা হয়। এপ্রিল মাসে সুনামগঞ্জ থেকে ১৫-১৬টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এই রাইফেলগুলো দিয়ে প্রাথমিকভাবে আনসার সদস্যরা স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন।
মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য অর্থ যোগানের দায়িত্ব সংগ্রাম পরিষদের আব্দুল আউয়ালের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ ব্যাপারে তিনি নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। বাজারের ব্যবসায়ীরা উদার হস্তে অর্থ সাহায্য করেন। রাজনগর ও চরণাচরের মিশু ও নিশি চৌধুরী অর্থ সংগ্রহ করে সংগ্রাম পরিষদের ফান্ডে জমা দেন। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সাধারণ মানুষের অঙ্গীকার ও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়।
সুনামগঞ্জ শহরসহ পূর্বাঞ্চলে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল পাকসেনারা সেসব জায়গায় দ্রুত পৌঁছে যায়। দুর্গম এলাকার কারণে দিরাই, শাল্লা, ধরমপাশা, তাহিরপুর, মধ্যনগর ও বিশ্বম্ভরপুরে পাকসেনাদের আগমনে বিলম্ব ঘটে ততদিনে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ২৭শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি দল সিলেট থেকে জগন্নাথপুর আসে। তারা জগন্নাথপুর থেকে গয়না নৌকা করে দিরাই পথে অগ্রসর হয়। হানাদার বাহিনীকে বড় নৌকায় করে আসতে দেখে আনসার কমান্ডার মন্তাজ আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। প্রতিরোধের জবাবে হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে। এতে প্রতিরোধ যোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটেন। ২৮শে আগস্ট পাকসেনারা দিরাই উপজেলায় প্রবেশ করে।
দিরাই উপজেলাটি ছিল ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাব- সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী (পরবর্তীতে লে. জেনারেল)। প্রাথমিক পর্যায়ে সাব-সেক্টরের বেসামরিক কমান্ডার ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিএ। পরে ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে এ সাব- সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি স্থানীয়ভাবে মেজর দীন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী আঞ্চলিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম, আতাউর রহমান, সুধীর দাস, মানিক চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, জোবের চৌধুরী প্রমুখ কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেন।
২৮শে আগস্ট পাকসেনারা দিরাই উপজেলায় প্রবেশ করে ক্যাম্প স্থাপন করে। থানা সদর ছাড়া পুরো দিরাই এলাকা হাওর ও নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় থানা সদরের মধ্যে তারা পরিখা নির্মাণ করে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে। থানায় প্রবেশ করে পাকসেনারা প্রথমেই স্কুল শিক্ষক গোকুলমণি বর্মণকে হত্যা করে। দিরাই থানা সদরের পাশে কালনি নদীর অপর পাড়ে চাঁদপুর গ্রামে ছিল এই শিক্ষকের বাস। হানাদাররা অবসরভোগী এই বৃদ্ধ মানুষটিকে ধরে এনে দিরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। গোকুলমণি ছিলেন এ স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৭ই জুন সুনামগঞ্জ জেলা শান্তি কমিটির সভায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্য উপজেলা পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দিরাই উপজেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি গঠনে সিলেটে বসবাসরত আইনজীবী গোলাম জিলানি চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তার বাড়ি দিরাই উপজেলার তাড়ল গ্রামে। পাকসেনারা দিরাইয়ে আসার পর গোলাম জিলানি চৌধুরী দিরাই এসে সমমনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শান্তি কমিটি গঠন করে। শান্তি কমিটির অপর সদস্যরা হলো- ইরশাদ মিয়া (রাড়ইল), আব্দুস সামাদ (রাড়ইল), দানিস মিয়া (বরইত্তর), আব্দুল ওয়াহাব (কাইমা মধুপুর), লেচু মিয়া চৌধুরী (সরমঙ্গল), আব্দুল হেকিম চৌধুরী (সুজানগর), মাছুম মিয়া (মাটিয়াপুর), সাইফুদ্দিন মিয়া (চণ্ডীপুর), আবারক উল্লা (চণ্ডীপুর), আবু সালেহ চৌধুরী (ভাটিপাড়া), আব্দুল বারীক (শরীফপুর), আলাউদ্দিন চৌধুরী (চণ্ডীপুর), ওয়ারিছ উদ্দিন (করিমপুর), আব্দুল হক চৌধুরী (সরমঙ্গল), আবুল কালাম (রফিনগর), আব্দুল ওহাব (রাজানগর) এবং নজরুল ইসলাম চৌধুরী (ভাটিপাড়া)। পাকসেনাদের রাজাকার সহযোগীরা হলো— শ্যামারচরের আব্দুল হাশেম, রুস্তম আলী, সুবুদ মিয়া, তুরাব আলী, আব্দুল হাশিম, মো. রহমান মিয়া, মো. মোক্তার হোসেন মিয়া, মো. ধন মিয়া মাস্টার, মো. নুরুল ইসলাম, কদ্দুছ মিয়া, ইমাম জলিল, রাকাব মিয়া, আব্দুল মন্নান মিয়া, আব্দুল মালেক, শামছু মিয়া, মতি মিয়া, লৌলারচরের নিরু মিয়া, আরিফ মিয়া, হিদাত উল্লা, উজানগাও-এর মো. হেকিম মিয়া, আব্দুল লতিফ, তারা মৌলভী, আব্দুল খালেক, তোতন মিয়া, আব্দুল গফুর, নুরুজ্জমান মিয়া, মাইতুল মিয়া, দৌলতপুরের মো. মুকিত মিয়া, মো. আনন্দ মিয়া, মো. সোনা মিয়া, মো. মতু মিয়া, ডা. ছোবান মিয়া, মো. শহীদ মিয়া, মো. লাল মিয়া, মো. সোনা মিয়া, হাসনাবাদের মো. আনন্দ মিয়া, ইয়াছিন মিয়া, আব্দুল গণি, সুরুজ আলী, নোয়ারচরের মো. আরজান, পেরুয়ার গোলাম মোস্তফা, মো. খালেক মিয়া, মো. নবী হোসেন, মাইতির আলী মেম্বার, ভোদাই মিয়া, কার্তিকপুরের মো. আজমান মিয়া, উকিল আলী, রাড়ইলের ইর্শাদ মিয়া চৌধুরী, মো. মফরুজ চৌধুরী, দৌলা আনোয়ারপুরের আব্দুছ ছামাদ চৌধুরী, আব্দুল ওহাব মিয়া, ফাতেমাপুরের গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, বকসীপুরের দানিছ মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যান, দাউদপুরের গোপেশ চৌধুরী, জারুলিয়ার আব্দুল মতলিব, শরমঙ্গলের আব্দুল হক চৌধুরী ওরফে লেচু মিয়া, সুজানগরের আব্দুল হেকিম চৌধুরী, চণ্ডীপুরের ছইফউদ্দিন, ডা. আলাউদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন, দোওজের সুনুরউদ্দিন মেম্বার, সাজেমান মিয়া, কুলঞ্জের বদিউজ্জমান চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, জানপুরের ইসরাইল মিয়া, আকিল মিয়া প্রমুখ।
পাকসেনারা দিরাইয়ে এসে সংখ্যালঘু ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। দিরাই থানায় প্রবেশের পর স্কুল শিক্ষক গোকুলমণি বর্মণকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের নৃশংসতার সূত্রপাত ঘটায়। এরপর তারা দিরাই বাজারের হাজী নাসির উদ্দিনের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। হাজী নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমানের বৃদ্ধ পিতা সাজিদ উল্লাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় এবং তাঁর ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়। হানাদারদের একটাই কথা ছিল, তাঁর পুত্র আতাউর রহমান আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত এই নির্যাতন চলবে। নিরুপায় হয়ে তাঁকে পুত্র আতাউর রহমানকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করতে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি তৈয়ব উল্লা (পিতা শুকুর উল্লা)-কে পাকসেনারা গুলি করে মারাত্মকভাবে আহত করে। রাজানগরের সুধীর চৌধুরী ও গচিয়ার সালেহ চৌধুরীর বাড়িতে তারা আগুন দেয়। ফলে বাড়িগুলো পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়।
পেরুয়া গ্রামের রামকুমারের বাড়িটি অনুরূপভাবে পুড়িয়ে তারা ভস্মীভূত করে। রামকুমার রায়ের ভাই হেমচন্দ্র রায়, পুত্র চিত্তরঞ্জন রায়সহ একই পরিবারের ৫-৬ জনকে তারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। পেরুয়া গ্রামের অর্ধশতাধিক লোক তাদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে হতাহত হয়। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা দিরাই উপজেলার শতশত মুক্তিকামী মানুষের ঘরবাড়ি লুণ্ঠন করে। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস – ও শান্তি কমিটির লোকেরা ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি দখল করে। দিরাই এবং শাল্লা এলাকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাজাকার ছিল আব্দুল খালেক। তার বাড়ি ছিল শাল্লা উপজেলায়। প্রভাব খাটিয়ে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে সে স্থানীয়ভাবে শতশত লোককে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করায়। দিরাই উপজেলার কার্তিকপুর ও মাউতি গ্রামের সর্বাধিক লোক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। দিরাই ও শাল্লায় রাজাকারদের ঘাঁটি স্থাপন করে রাজাকার খালেক নিরীহ জনসাধারণের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়। হানাদার বাহিনী নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। অগ্রহায়ণ মাসে মাঠে-মাঠে পাকা ধান থাকা সত্ত্বেও পাকসেনা ও রাজাকারদের ভয়ে কেউ ধান কাটতে সাহস করেনি। এ সময় সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর ঘোলা জল পাকিস্তানিদের হত্যার শিকার অগণিত মানুষের রক্তে লাল হয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মহকুমা শহর মুক্ত হলেও খালেক রাজাকার তার বাহিনী নিয়ে দিরাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব চালায়। রাজাকার বাহিনী পেরুয়া গ্রামের শতাধিক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে।
২৮শে আগস্ট পাকসেনাদের হাতে দিরাই থানার পতন ঘটে। এর আগে ৫ই জুলাই ১২জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ দিরাই উপজেলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী ও আব্দুল কুদ্দুস। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা ও পাকবাহিনীর কিছু দালাল পাকহানাদারদের দিরাইয়ে আমন্ত্রণ করে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু এর আগেই সালেহ চৌধুরী, চান মিয়া ও আব্দুল কুদ্দুস তাদের এ অপচেষ্টা প্রতিহত করেন। ৫ই জুলাই দুপুর ১২টায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ভাঙ্গাডহর গ্রাম থেকে রওনা দিয়ে বিকেল ৩টায় দিরাই পৌঁছায়। তাঁরা দিরাই বাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে নৌকা ভেড়ান। তারপর একটি ছোট খাল দিয়ে তাঁদের নৌকা কালনি নদীতে প্রবেশ করে। নৌকা দিরাই থানার দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে থানা আক্রমণ করেন। আক্রমণে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়। থানার সব অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তাঁরা নৌকা বোঝাই করে প্রাপ্ত অস্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী এমএনএ-এর নিকট হস্তান্তর করেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুধীর দাশের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ৬ই ডিসেম্বর পেরুয়া গ্রাম থেকে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন। তাঁর সঙ্গে ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি গ্রুপের যোগদানের কথা থাকলেও কোনো কারণে তাঁরা যোগদান করতে পারেননি। এ সময় রাজাকারদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং সুধীর দাশসহ ৩ জন গুলিবিদ্ধ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আব্দুল হান্নান, মো. আব্দুল কুদ্দুস, মো. আব্দুল হামিদ ও হেমেন্দ্র পুরকায়স্থ।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মধ্যে যুদ্ধ শেষে রাজাকাররা পেরুয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। পেরুয়া গণহত্যায় ২৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। তারা হলেন- ব্রজেন্দ্রগঞ্জ রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রামকুমার রায়, শিক্ষক উপেন্দ্র কুমার রায়, ডা. রামানন্দ রায়, চিত্তরঞ্জন রায়, সমরেন্দ্র রায়, হিমাংশু শেখর রায়, মিলন চন্দ্র রায় প্রমুখ। গণহত্যার দিন ভোরে ডা. রামনন্দ রায়ের স্ত্রী পরিমল বালা এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান জন্ম দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর রাজাকাররা তাদের বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। রামনন্দ রায়ের ভাই রামকুমার রায় তাঁর জীবনের বিনিময়ে পুত্র চিত্তরঞ্জনকে বাঁচানোর আবেদন করলেও পিতার সামনে নির্মমভাবে পুত্রকে তারা হত্যা করে। এ সময় চিত্তরঞ্জনের মা কনকপ্রভা রায় পুত্রকে বাঁচানোর জন্য রাজাকারদের নিকট শত অনুনয় বিনয় জানালে তারা তাকে লক্ষ করে গুলি করে তার মুখমণ্ডল ঝাঝরা করে দেয়। তারা মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র পুরকায়স্থের পিতা সুখলাল পুরকায়স্থকে রূপশি গাছে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে দিরাই মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। ৭ই ডিসেম্বর দিরাইকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় আক্রমণ চালান। সেদিন ছিল মনসা পূজার দিন। মুক্তিযোদ্ধারা দিরাই সার্কেল অফিসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ৫নং সেক্টরের অধীন টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি গ্রুপ দিরাই রওনা হয়। তিন গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যথাক্রমে ৩০, ৬০ ও ৭৫ জন। এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন সুধীর কুমার দাস, দলন কুমার পাণ্ডে ও সুভাসচন্দ্র দাস। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সংখ্যা ছিল ৬৫ জন। ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধারা দিরাই সার্কেল অফিসে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। ৮ ঘণ্টার মতো যুদ্ধ হয়। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে নদীপথে শেরপুর ও আজমিরিগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ হন। ৬ই ডিসেম্বর দিরাই উপজেলা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হলেও রাজকার বাহিনী এ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা ও তাণ্ডব চালায়। পরের দিন ৭ই ডিসেম্বর দিরাই সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়।
পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে দিরাই উপজেলার যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা হচ্ছেন— তালেব উদ্দিন (পিতা মো. আব্দুল ওয়াহেদ, হাতিয়া), অনিল কুমার তালুকদার (পিতা অনন্ত কুমার তালুকদার, শ্রীনারায়ণপুর), আব্দুল করিম (পিতা সৈয়দ উল্লা, হলিমপুর), আব্দুল হান্নান (পিতা মো. আব্দুল জব্বার, কালধর), বৃষকেতু দাস পুরকায়স্থ (পিতা কর্ণকুমার পুরকায়স্থ, খাগাউড়া), মুজিবুর রহমান (পিতা আফজল মাসুদ, সাকিতপুর), নুরুল ইসলাম (পিতা আফসর উদ্দিন, রফিনগর), আব্দুল বাছিত (পিতা মো. আব্দুস শুকুর, কদমতলী), হারুন রশীদ চৌধুরী (পিতা মানিক মিয়া চৌধুরী, কুলঞ্জ), হেমেন্দ্র কুমার দাশ (পিতা শত্রুঘ্ন দাশ, জটিচর), আব্দুল হামিদ (পিতা শাদত মিয়া, জগদল), আজিম উল্লা (পিতা আজিমুল হক, জালিয়া), ধীরেন্দ্র দাস (খাগাউড়া) ও হরিপদ দাস (রামজীবনপুর)।
সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ অঞ্চল হাওর-বাওর ও নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। পাকহানাদারবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হাওরে কবর দেয়ার জন্য উঁচু মাটি না পাওয়ায় কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কোনা-কোনো মুক্তিযোদ্ধার লাশ সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চলে কবর দেয়া হয়।
দিরাই উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণে প্রথম উদ্যোগ নেন। তাঁর নিজ গ্রাম গচিয়ার পাশের গ্রাম জটিচরের হেমেন্দ্র তালুকদার ৬ই ডিসেম্বর শ্যামারচর এলাকায় রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর স্মরণে সালেহ চৌধুরীর উদ্যোগে জটিচর গ্রামে ‘দীপ্তস্মৃতি’ নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই স্মৃতিসৌধে একই তারিখে শহীদ আরো তিনজন মুক্তিযোদ্ধার নাম খোদাই করা হয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামের আব্দুল হামিদ, কালধর গ্রামের আব্দুল হান্নান এবং জগন্নাথপুর থানার শ্যামারগাও গ্রামের আব্দুল মোকাদ্দস।
দিরাই অঞ্চলে যুদ্ধে শহীদ হন দক্ষিণ সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলী। তাঁকে কালিকুটা হাওরের মধ্যবর্তী স্থানের উঁচু জায়গায় কবর দেয়া হয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ আরশ আলীর কবর সনাক্ত করতে সমর্থ হন। আরশ আলীর কবরে তাঁর উত্তরাধিকারীরা ‘দীপ্তস্মৃতি’ নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। [বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড