দামাইক্ষেত্র গণহত্যা (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর)
দামাইক্ষেত্র গণহত্যা (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ৮ই জুলাই। এতে ভারতগামী বেশ কয়েকজন আশ্রয় গ্রহণকারী নিহত হন।
বীরগঞ্জ উপজেলার ৬নং নিজপাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম দামাইক্ষেত্র। সাহাপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, পূর্বডাঙ্গাপাড়া, কালিতলাডাঙ্গা, ডাক্তারপাড়াসহ আরো কয়েকটি পাড়া নিয়ে দামাইক্ষেত্র গ্রাম। সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এ গ্রামে ৮ই জুলাই (২৩শে আষাঢ়) গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন সকালে ভারতে যাওয়ার জন্য এলাকার অবস্থাপন্ন ব্যক্তি ভুবন মোহন রায় (পিতা লক্ষীকান্ত রায়) ও পার্শ্ববর্তী কামিনী রায়ের বাড়িতে গ্রামের কিছু লোক এসে জড়ো হয়। কিন্তু স্থানীয় রাজাকার পাচু মোহাম্মদ ও মেহেদীর মাধ্যমে পাকসেনাদের কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। তাদের একটি দল সকাল ১০টার দিকে ঐ বাড়িতে এসে হাজির হয়। তাদের দেখে যে যেভাবে পারে পালাতে থাকে এবং ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে নিজেদেরে রক্ষা করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে নারীরা তাদের সম্ভ্রম বাঁচাতে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু এর মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে। রাজকারকাররা ঐ দুটি বাড়িসহ বিভিন্ন বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
দামাইক্ষেত্র গণহত্যায় শহীদরা হলেন- ভুবন মোহন রায় (৬৫) (পিতা লক্ষ্মীকান্ত রায়, পূর্বডাঙ্গাপাড়া), সমেশ্বর রায় (৩৫) (পিতা ভুবন মোহন রায়, ঐ), শশী মোহন রায় (৬২) (পিতা কালিদাস রায়, ঐ), উজানু রায় (২২) (পিতা হরিদাস রায়, চকবেনারশী), গোপাল চন্দ্র রায় (৫৫) (পিতা আইতু রায়, সাহাপাড়া), টুকুরু রায় (৬০) (পিতা গগন চন্দ্র রায়, পূর্বডাঙ্গাপাড়া), হরেকান্ত রায় (৬১) (পিতা হেমচরণ রায়, ঐ) প্রমুখ।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরো ১২ জন লোক নিহত হন। তাদের মধ্যে ৫ জন হলেন— বেনী মাধব রায় (৫০) (পিতা গোপল চন্দ্র রায়, পূর্বডাঙ্গাপাড়া; কৃষক), জগদু বানিয়া রায় (৫২) (পিতা গোপাল চন্দ্র রায়, ঐ; কৃষক), জিতেন রায় (২৫) (পিতা ভদ্র মোহন রায়, দামাইক্ষেত্র), নসি প্রসাদ রায় (৬০) (পিতা শিব প্রসাদ রায়, ডাক্তারপাড়া) ও কালিচরণ রায় কেটি। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে কালিতলাডাঙ্গার একটি পাটক্ষেতে কাজ করছিল বেনী মাধব রায়। এমন সময় পাকসেনারা সেখানে এসে হাজির হয় এবং বেনী মাধবকে ধরে একটি গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে জগদু বানিয়া রায় বেনী মাধবকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে পাকসেনারা তাকেও গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এরপর দুজনের পেট বেয়নেট দিয়ে চিড়ে ফেলে এবং গুলি করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ দড়িবাঁধা অবস্থায়ই ফেলে রেখে পাকিস্তানি হানাদাররা চলে যায়। একই সময়ে গ্রামের পাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জিতেন রায় নামক অপর একজনকে লক্ষ করে পাকিস্তানি সেনাদের টহলরত জিপ থেকে গুলি করা হলে, সে ঘটনাস্থালেই মারা যায়।
এলাকার একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন নসি প্রসাদ রায়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ৪-৫ জন পাকসেনা ও কয়েকজন রাজাকার তার বাড়ির বাইরের খোলানে এসে উপস্থিত হয় এবং সেখানে অবস্থান করা কালিচরণ রায় কেটি ও সত্যেন রায়কে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরা ছিল নসি প্রসাদের কাজের লোক। পাকসেনারা সত্যেনের কাছে নসি প্রসাদের খবর জানতে চায় এবং বলে যে, নসিকে এনে দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সত্যেন নিজেকে বাঁচানোর আশায় পাকসেনাদের কথায় রাজি হয় এবং নসিকে খুঁজে আনার জন্য তাকে ছেড়ে দিতে বলে। সত্যেন ছাড়া পেয়ে নসি প্রসাদকে একটি আঁখক্ষেতে লুকানো অবস্থায় খুঁজে পায়। তাকে সে বলে যে, কেটিকে পাকসেনারা ধরেছে, টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। কেটির কথায় বিশ্বাস করে নসি প্রসাদ বাড়ির দিকে রওনা দেন। খোলানে আসার সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে এবং কেটির পেটে ধারলো অস্ত্র চালিয়ে তাকেও হত্যা করে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে। রাজাকার বাহিনী ও জামায়াতে ইসলামী-র লোকেরা নসি প্রসাদের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালায়। স্বাধীনতাপরবর্তী দামাইক্ষেত্র গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড