You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দামুড়হুদা উপজেলা (চুয়াডাঙ্গা)

দামুড়হুদা উপজেলা (চুয়াডাঙ্গা) মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে একটি ছোট শহর। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলার সব থেকে প্রাচীন জনপদ। চুয়াডাঙ্গা শহর প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বে দামুড়হুদার পত্তন হয়। দামুড়হুদা চুয়াডাঙ্গা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ঘেঁষে অবস্থিত জেলার তৃতীয় বৃহত্তম থানা। এটি একটি সীমান্তবর্তী থানা। এ থানার পশ্চিম-দক্ষিণে ভারতের নদীয়া জেলা। দামুড়হুদার উত্তরে আলমডাঙ্গা থানার গোকুলখালী ও চুয়াডাঙ্গা সদর থানা, পশ্চিমে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর থানা ও পূর্বে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার বেগমপুর ইউনিয়ন। ৭১ সালে নদীয়া সীমান্ত উন্মুক্ত ছিল। দর্শনা থেকে হাটখোলা, সুলতানপুর, বাড়াদী, বড়বলদিয়া, ফুলবাড়ীয়া, মুন্সিপুর ও সীমান্ত চৌকি পার হয়ে সে- সময় বাংলাদেশের লক্ষ-লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে যায়। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দামুড়হুদা থানার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ভৈরব ও মাথাভাঙ্গা দামুড়হুদা থানার প্রধান নদী। ভৈরব নদ থানার জগন্নাথপুর, নাটুদহ, বেড়বাড়ীয়া, চারুলিয়া, হাতিভাঙ্গা, মুক্তারপুর, উত্তরচাঁদপুর, কার্পাসডাঙ্গা, নিশ্চিন্তপুর ও সুবলপুর গ্রামের নিকট মাথাভাঙ্গায় মিশেছে। এছাড়া এ থানায় বোয়ালিয়া, তালবাড়ীয়া, কালিয়া, ভেদাগাড়ী, পাকুরিয়া, জিওলগাড়ী, সোনাতলা, দলিয়া, দুধপাতিলা, শহিদখালীসহ আরো কিছু বিল আছে। ৭১-এর বন্যায় এ-সকল নদী-নালা ও খাল-বিল পানিতে পূর্ণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে দামুড়হুদার নদ-নদী ও খাল-বিলের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে।
৫২-এর ভাষা-আন্দোলন এ ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি হলে ঢাকাসহ সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সে-সময় দামুড়হুদা-দর্শনার ছাত্রজনতাও ফুঁসে ওঠে। তখন এখানে নেতৃত্ব দেন নজির আহম্মদ বিশ্বাস (কুডুলগাছি), মির্জা সুলতান রাজা (ছঘরিয়া), এডভোকেট ইউনুস আলী, বদিউর রহমান বাদশা (দর্শনা) প্রমুখ। দামুড়হুদা থানায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় দর্শনা রেলওয়ে রানিং রুমের সম্মুখে রেলের স্লিপার পুঁতে। পরে শহীদ মিনার গার্লস স্কুলে স্থানান্তর করা হয়। পাকিস্তান আমলে গার্লস স্কুলে শহীদ মিনার প্রতিবছর তৈরি হতো এবং তা পুলিশ ভেঙ্গে দিত।
৫৪-র নির্বাচনে দর্শনা-দামুড়হুদার মানুষ যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ভোট দেয়। এ নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা ২ আসন থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ওহিদ হোসেন জোয়ারদার বিজয়ী হন। ১৯৬২ সালের ৮ই জুন আইয়ুবের সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হলে চুয়াডাঙ্গা- দর্শনায় সক্রিয় রাজনীতি শুরু হয়। দর্শনায় চিনিকল থাকায় শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। এখানে ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) ইত্যাদি দল/সংগঠনের তৎপরতা ছিল।
৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ৬ দফা প্রদান করলে এর পক্ষে সারাদেশে জনমত তৈরি হয়। দামুড়হুদা-দর্শনায় ৬-দফার পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। ৬ দফা ও পরে ছাত্রদের ১১ দফার পক্ষে দর্শনার রাজপথে অনেক মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব মিছিল-সমাবেশে নেতৃত্ব দিতেন এডভোকেট শহিদুল ইসলাম, রেজাউল করিম, সামসুল ইসলাম, নুর হাকিম প্রমুখ।
দামুড়হুদা থানায় নাটদহ হাজারদুয়ারী হাইস্কুল, দামুড়হুদা কে ডি হাইস্কুল ও কেরু উচ্চ বিদ্যালয় থাকলেও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কোনো কলেজ ছিল না। ১৯৬৯ সালের ১৫ই জুলাই কিছু বিদ্যোৎসাহী সমাজসেবক ও আখচাষীর অর্থানুকূল্যে দর্শনা কলেজ স্থাপিত হয়। দর্শনা কলেজ স্থাপিত হওয়া ও দর্শনায় চিনিকল থাকায় ৬৯-এর গণআন্দোলন ও ৭০-এর নির্বাচনের জোয়ার দামুড়হুদা থানার দর্শনাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। দর্শনা কলেজকে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়ন-র সংগঠন জোরদার হয়। এখানে মোজাফ্ফর ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের বেশ প্রভাব ছিল।
ন্যাপের প্রভাব বেশি থাকায় ৭০-এর নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা ২ আসনে আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী থাকলেও এডভোকেট শহিদুল ইসলাম ন্যাপের পক্ষ থেকে কুঁড়েঘর মার্কায় নির্বাচন করেন। ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এডভোকেট ইউনুস আলী জয়যুক্ত হলেও ন্যাপ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম সম্মানজনক ভোট পান।
৭০-এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এসবের বিরুদ্ধে সারাদেশের মতো দামুড়হুদা-দর্শনায়ও প্রতিবাদ হয়। ৭১- এর ১লা মার্চ দর্শনায় বিশাল মিছিল হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন এডভোকেট শহিদুল ইসলাম, রেজাউল করিম, সামসুল ইসলাম, তাহের উদ্দীন খান, ডা. এস আলম, রঞ্জু আহাম্মেদ (পাঠানপাড়া, মূলবাড়ী পাবনায়) প্রমুখ। ৩-৬ই মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত দর্শনা ও দামুড়হুদা শহরে কঠিনভাবে হরতাল পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- চুয়াডাঙ্গা ও দামুড়হুদাবাসী রেডিও-র মাধ্যমে ৮ই মার্চ শুনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক দামুড়হুদা থানার প্রতিটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কুড়ুলগাছি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ক্লাসের ছাত্র রহমতুল্লাহ (কুড়ুলগাছির)-র নেতৃত্বে। সংগ্রাম কমিটির অফিস হয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের একটি রুমে। কুড়ুলগাছি ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ডা. নজীর আহমেদ (চাকুলিয়া) ও রহমতুল্লাহ। সদস্য ছিলেন আনছার উদ্দীন (কুডুলগাছি), মহাবুবুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক (চণ্ডিপুর) প্রমুখ।
দামুড়হুদা থানার সংগ্রাম কমিটির প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয় দর্শনায়। অফিস করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমের পিতা জামাল উদ্দীন কন্ট্রাক্টরের বাসভবনে। তিনি পুরো বাড়ি সংগ্রাম কমিটির অফিসের জন্য ছেড়ে দেন। দর্শনা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ডা. এস আলম (কেরুর ডাক্তার, মূলবাড়ি টাঙ্গাইলে) ও এডভোকেট শহিদুল ইসলাম (মুজাফ্ফর ন্যাপ)। সদস্য ছিলেন তাহের উদ্দীন খান (কেরুর শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক), রেজাউল করিম সবুর (দর্শনা পুরাতনপাড়া; ছাত্র ইউনিয়ন), জাহাঙ্গীর আলম (ছাত্র ইউনিয়ন), জয়নাল আবেদীন (ছাত্রলীগ) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ পর্যায়ে দর্শনা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে ভারত থেকে অর্থ, ডিজেল, পেট্রোল, রেডক্রসের দেয়া ওষুধ, চাল-ডাল, সাবান, কাপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সাহায্য হিসেবে আসত। এসব সাহায্য চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা ও জীবননগর থানার সংগ্রাম কমিটির মধ্যে বণ্টন করা হতো। সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য দর্শনা সংগ্রাম পরিষদ ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্য ছিলেন এডভোকেট শহিদুল ইসলাম, তাহের উদ্দীন খান ও ডা. এস আলম।
জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতকরণ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন- এরূপ পরিস্থিতিতে ২৩শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগ অফিসে চুয়াডাঙ্গা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। বৈঠকে দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, জীবননগর ও চুয়াডাঙ্গা সদর থানার সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক চলাকালে আওয়ামী লীগের ঢাকা কেন্দ্রীয় অফিস থেকে টেলিফোনে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে ও জনগণকে প্রস্তুত করতে নির্দেশ আসে। এ বৈঠকে চুয়াডাঙ্গায় প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে নেতৃবৃন্দ মুক্তিকামী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে টাউন ফুটবল মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। চুয়াডাঙ্গা মহকুমা ছাত্রলীগ সভাপতি নুর-উল-ইসলাম মালিক ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক জামাল লাল্টুকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ডামি রাইফেল দিয়ে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রহমান জোয়াদ্দার লাল্টু গার্ড অব অনারে নেতৃত্ব দেন।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপর দর্শনার কেরুর মাঠে স্থানীয় বন্দুক ও থানার অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বেশকিছু নারীও প্রশিক্ষণে অংশ নেন। নারীদের প্রশিক্ষণ হতো গার্লস হাইস্কুল মাঠে। প্রশিক্ষণ দিতেন আবু বকর (রামনগর) ও জহির কমান্ডার (চাঁদপুর)। নারীদের মধ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন দর্শনার রাশেদুন্নাহার, মমতাজ আরা তাঁরা, নাজমা বেগম, সুফিয়া খাতুনসহ আরো অনেকে।
২৭শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় ‘বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি’র জন্ম হলে এর যাবতীয় সাহায্য দর্শনা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ মারফত জেলার সকল থানা ও সংগ্রাম কমিটির কাছে পৌঁছানো হয়। ২৭শে মার্চ চুয়াডাঙ্গাকে প্রধান টেলিফোন এক্সচেঞ্জে পরিণত করা হয়। বহির্বিশ্বে যোগাযোগ করার জন্য ‘জয় বাংলা কোড’ স্থাপন করা হয়। দর্শনা রেল স্টেশন থেকে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ-সময় চুয়াডাঙ্গার জয় বাংলা কোডের কতকগুলো সাংকেতিক নাম স্থির হয়, যেমন কুষ্টিয়া-জুট, আলমডাঙ্গা-ঝিঙা, জীবননগর-জীন, দর্শনা (দামুড়হুদা)-ডিঙ্গা, মাগুরা-মদিনা, চুয়াডাঙ্গা-জয়বাংলা ইত্যাদি।
২৭শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা চতুর্থ উইং-এর অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক দর্শনা ও জীবননগরের বিওপি ক্যাম্পগুলোর বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করার দুরভিসন্ধি নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্য আনার ব্যবস্থা করে। এসব সৈন্য প্রথমে মাচলিয়া ক্যাম্পে উপস্থিত হলে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা ক্যাপ্টেন সাদেকের দুরভিসন্ধি বুঝে ফেলেন। সেখানে বাঙালি ও অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মাচলিয়া যাবদপুর-বেনিপুর বিওপি-তে সম্মুখ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সঙ্গীরা নিহত হয়। এ- যুদ্ধে বাঙালি ইপিআর সদস্য আশরাফ শহীদ হন। দর্শনা দামুড়হুদার অন্যান্য বিওপি ক্যাম্প পাকিস্তানিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
৩০শে মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম দর্শনা সংগ্রাম কমিটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মীদের তত্ত্বাবধানে চ্যাঙখালী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান।
কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে দর্শনার শহিদুল ইসলামসহ অনেকে অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধের পর দর্শনার অবাঙালিরা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবে বলে ঘোষণা দেয়। সংগ্রাম কমিটি তাদের বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ যশোর ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সংগ্রাম কমিটি তাদের ১০ জন নেতাকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাস্তবে দর্শনার প্রায় সব বিহারিকে ধরে ট্রানজিট ক্যাম্পে (ইউনিয়ন পরিষদ) আটক রাখা হয়। তাদের তখন ছাড়াও যাচ্ছিল না আবার কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছিল না। এ অবস্থায় বেশ কয়েকদিন তারা আটক থাকে। তারপর দেশের অন্যান্য স্থানে যেমন খুলনা, সৈয়দপুর ও চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে বিহারিরা বাঙালিদের হত্যা করে মালগাড়ির ওয়াগন লাশে পরিপূর্ণ করেছে বলে খবর আসতে থাকে। এসব খবর দর্শনায় পৌঁছলে বিক্ষুব্ধ মানুষের হাতে অনেক বিহারি নিহত হয়। ১২ই এপ্রিল মদনা-কুড়ুলগাছির দিকে পালিয়ে যাওয়া ২ শতাধিক বিহারি বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে মারা যায়। এদের রায়সা বিলের ধারে কুড়ুলগাছি ইউনিয়ন কাউন্সিলের পেছনে কবর দেয়া হয়। কিছু বিহারি ভালাইপুর মোড়ে নিহত হয়। এ-সময় প্রায় ২৫০ জন বিহারি ছয়ঘরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল হোসেনের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চাইলে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সহযোগিতায় নিজ গ্রাম ছয়ঘরিয়ার লতিফ মিয়ার বন্দুক ও কর্মীদের নিয়ে পাহারা দিয়ে তাদের রক্ষা করেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন লুৎফর রহমান (পারকৃষ্ণপুর) ও ছঘরিয়া গ্রামের মোজাম, ট্যাকারদ্দিন, আলতাব হোসেন, জাহামত ও আছের উদ্দীন। ১৩ই এপ্রিল পাকসেনারা দর্শনা শহরে অনুপ্রবেশ করলে ছঘরিয়ায় অবস্থানরত বিহারিরা দর্শনায় যায়।
চুয়াডাঙ্গা পাকবাহিনীর দখলে যায় ১৪ই এপ্রিল। তখন দামুড়হুদা-দর্শনার সকল প্রতিরোধযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভারতে গমন করেন। পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে অসংখ্য মানুষ দামুড়হুদা থানার সীমান্ত অতিক্রম করে শরণার্থী হিসেবে ভারতে প্রবেশ করে।
নজির আহম্মদ (চাকুলিয়া, দামুড়হুদা)-সহ দামুড়হুদা থানার অন্য নেতৃবৃন্দ চুয়াডাঙ্গার নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে (বৈদ্যনাথতলা, মেহেরপুর) ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’-এর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এবং কয়েক হাজার স্থানীয় মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে চুয়াডাঙ্গা জেলার নেতারা ভারতে গিয়ে নদীয়া জেলার বেতাই লালবাজারে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যে ডোমপুকুর, মাজদিয়া, ভোজনঘাট, করিমপুর (পরে নাটনাই-এ স্থানান্তর), জামসেদপুর ও কড়ুইগাছিতে মুক্তিযুদ্ধের অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করা হয়। দামুড়হুদা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগ ভারতের ডোমপুকুর ও মাজদিয়াতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
বানপুর ও শিকারপুরে একশন ক্যাম্প তৈরি হয়। দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গা সদর থানার মুক্তিযোদ্ধারা হাটখোলা (ভারত সীমান্তে) গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের একটি একশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্যাম্প থেকে চুয়াডাঙ্গা মহকুমাসহ মেহেরপুর, গাংনী, মিরপুর, কুষ্টিয়া, হরিণাকুণ্ডু ইত্যাদি স্থানে থানায় মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে যেতেন। সোলায়মান হক জোয়াদ্দার ছেলুন কঠোরভাবে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করতেন। দামুড়হুদা থানার বাড়াদী গ্রামকে মুক্ত এলাকা ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে রানাঘাটের সন্নিকটে চুর্ণি নদীর তীরে আঁইশতলায় একটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। দামুড়হুদা থানার ছাতিয়ানতলা, লক্ষ্মীপুর, নতীপুতা, কেষ্টপুর, কালিবাড়ী, ইব্রাহিমপুর প্রভৃতি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্র ছিল।
দামুড়হুদা থানার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডাররা হলেন- আমিনুল ইসলাম (ভগীরথপুর), লিয়াকত আলী (দর্শনা), রবিউল হক (চন্দ্রবাস), গোলাম নবী (কালিদাসপুর), রেজাউল করিম (মদনা মাঝেরপাড়া), আমিরুল ইসলাম (বোয়ালমারি), আহসানুল হক (আরামডাঙ্গা), আব্দুস সামাদ (হল্টচাঁদপুর), সদর আলী (মুন্সিপুর), সফিউদ্দীন (জগন্নাথপুর) ও ইসরাফিল (হুদাপাড়া)। এ থানার মুজিব বাহিনী-র কমান্ডার ছিলেন রহমতুল্লাহ (কুড়লগাছি)।
১৪ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা পাকবাহিনীর দখলে যাওয়ার পরপর তারা মহকুমার বিভিন্ন থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের ১ম সপ্তাহের মধ্যে তারা দামুড়হুদা থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। দর্শনার কাস্টমস অফিস, কার্পাসডাঙ্গা তহসিল অফিস ও নাটুদহ হাজারদুয়ারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের ক্যাম্প ছিল।
দামুড়হুদা থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার কুখ্যাত রাজাকাররা হলো- দর্শনা পৌরসভা: মাওলানা আব্দুস সাত্তার (পেশ ঈমাম, দর্শনা বড় মসজিদ; শান্তি কমিটি র চেয়ারম্যান), হাজী লাল মোহাম্মদ (দর্শনা পুরাতন বাজার), সিরাজুল ইসলাম (ইউপি মেম্বার), রাজাকার রবনিকিরি, আওরঙ্গজীব বিহারি, কুদ্দুস (ডিলার), ওয়াজেদ চেয়ারম্যান, আমজাদ হোসেন, ফজলুল হক, সৈয়দ আলী মণ্ডল, নুর ইসলাম, ওয়াজেদ, রিয়াজ, আনু, লাল মোহাম্মদ (দর্শনা পুরাতন বাজার), ওসমান মণ্ডল, সাইদুর রহমান তাজু (থানাপাড়া), গোলাম আলী, গুলবটি, ওমর আলী (মোবারেক পাড়া), জামি বিহারী (রেল কলোনি), ইসমাইল হোসেন (ইসলাম বাজার), আব্দুল জলিল, আব্দুর রব, ছাত্তার মাওলানা, মাহারুল ইসলাম চান্দু, খালিদ (দর্শনা কাস্টমস), আব্দুল কুদ্দুস (বড় দুধপাতিলা), সিরাজুল ইসলাম (রামনগর), ইউসুফ নবী, সৈয়দ মণ্ডল (ঈশ্বরচন্দ্রপুর), বাক্কা সরদার (শ্যামপুর), ওসমান মণ্ডল (ঘুঘুডাঙ্গা), আয়ুব (চণ্ডিপুর; এখানকার যাবতীয় অপকর্ম করত নজির সিকিউরিটি এবং চুড়িওয়ালী নামে পরিচিত এক বাঙালি মহিলা); হাউলী ইউনিয়ন: মঈনদ্দীন আহমেদ (জয়রামপুর; শান্তি কমিটির সভাপতি, ওদুদ শাহ (লোকনাথপুর; শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), মতিন মাওলানা (জয়রামপুর; শান্তি কমিটির সদস্য), হাবিবুর মাওলানা (লোকনাথপুর), রবিউল (জয়রামপুর মানিকপাড়া), আফিল উদ্দীন (রাজাকার বাহিনীর সদস্য), রাজ্জাক, বাবুর আলী, তাঁরাচাঁদ (ইব্রাহিমপুর), ছোট খোকা (জয়রামপুর), মতিউর রহমান (জয়রামপুর), আবু সাইদ, সলেমান (লোকনাথপুর); কুড়ুলগাছি ও পারকৃষ্ণপুর মদনা ইউনিয়ন: আয়ুব আলী, আলী হোসেন, আব্দুর রহমান (বুইচিতলা), আব্দুর রব (রামনগর), আবু বক্কর (কুড়ুলগাছি); কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন: আকবার আলী বিশ্বাস (কুতুবপুর), মো. শফি (পাটাচোরা), ফতে আলী (শ্যামপুর), গোলাম রহমান (আরামডাঙ্গা); দামুড়হুদা ইউনিয়ন: আলম মাস্টার (দামুড়হুদা), মাওলানা হাবিবুর রহমান (পূর্ব নিবাস হোগলডাঙ্গা), লুতফর রহমান লুথু (দামুড়হুদা), শাহাজান (বাস্তপুর); জুড়ানপুর ইউনিয়ন: মাদার মোল্লা (জুড়ানপুর; খুবই অত্যাচারী রাজাকার); নতীপোতা ইউনিয়ন: ওমর আলী (চারুলিয়া), খোদা বকস মোল্লা (লক্ষ্মীপুর), নজীর আহম্মদ, মহিউদ্দীন (হোগলডাঙ্গা), রহমতুল্লা (কালিয়া বকরি), শফি (মহাজনপুর, মেহেরপুর থানা) ও কাফি (মহাজনপুর, মেহেরপুর থানা; শফি ও কাফি এ দুই সহোদর রাজাকার নতীপোতা ও নাটদহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে চরম অত্যাচার করত); নাটদহ ইউনিয়ন: তফসির, রাজ্জাক, বাবুর আলী, জয়নাল (জগন্নাথপুর) প্রমুখ।
৭ই ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত হলে ১১ই ডিসেম্বর মোস্তফা আনোয়ারকে মহকুমার প্রশাসক নিযুক্ত করে বেসরকারি প্রশাসন চালু করা হয়। এরপর চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, জীবননগর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতাবিরোধীদের ধরে পর্যায়ক্রমে চুয়াডাঙ্গা কোর্ট থেকে কুষ্টিয়া জেল হাজতে পাঠান। দামুড়হুদা থানা থেকে আটক করে চুয়াডাঙ্গা কোর্টের মাধ্যমে যাদের কুষ্টিয়া জেল হাজতে পাঠানো হয়, তারা হলো- আতা মোহাম্মদ (দর্শনা), মো. হোসেন (দর্শনা কাস্টমস কলোনি), শওকত (দর্শনা ইসলাম বাজার), ওয়ালী মো. মোস্তফা, গোলাম হোসেন, পাচু মিয়া (দর্শনা সুগার মিলস), দীন মোহাম্মদ (দর্শনা শান্তিপাড়া), মো. ইসলাম (দর্শনা শান্তিপাড়া), মো. জুবাইল (দর্শনা কেরুজ লাইন), কামরুদ্দিন (দর্শনা মিলস), আসমাতুন নেসা (দর্শনা), হাবিবুন বিবি (দর্শনা), খাতেকুন (দর্শনা), কামরুন নেসা (দর্শনা), মেহেরুন নেসা (দর্শনা), খাজা মঈনুদ্দিন (জয়রামপুর; সদস্য, পিডিপি), এস এম মনজুরুল হক (দর্শনা), আকবর আলী বিশ্বাস (কুতুবপুর; সদস্য, পিএমএল), সালাউদ্দিন (দর্শনা কাস্টমস কলোনি), রাবেয়া (পরানপুর কলোনি), নাসরিন (মেমনগর), ইউসুফ নবী (দর্শনা), আনসার আলী (দর্শনা), মাওলানা আবদুস ছাত্তার (দর্শনা), মাওলানা আব্দুল মতিন (জয়রামপুর), আবু তায়েব (দর্শনা), ওয়াজেদ হোসেন (দর্শনা), মো. সোহেল হোসেন (দর্শনা), সাইদ আলী (দর্শনা), এ কাইয়ুম (দর্শনা), বাকা সরদার (শ্যামপুর), সাইদ আলী (ঈশ্বরচন্দ্রপুর), শাহ আলম (দর্শনা), এস এম ইব্রাহীম (দামুড়হুদা; প্রাক্তন ওসি, দামুড়হুদা থানা), ফতেহ আলী (শ্যামপুর; সদস্য, পিএমএল), ওসমান আলী (দর্শনা; সদস্য, পিএমএল), হামিদা খাতুন (দর্শনা), আনোয়ারা বেগম (দর্শনা), মো. জলিল (দর্শনা) খাইরুন নেসা (দর্শনা), সুলতানা (দর্শনা), আবু আজাদ (দর্শনা), নাজির আহমেদ (দর্শনা), আক্তারী খাতুন (দর্শনা), মুস্তারী খাতুন (দর্শনা) এবং আনোয়ারা খাতুন (দর্শনা)।
দালাল আইনে চুয়াডাঙ্গা জেলার ৭ জনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের রায় হয়। তাদের মধ্যে ১ জন চুয়াডাঙ্গা সদর থানার এবং বাকি ৬ জন দামুড়হুদা থানার। এ ৬ জন হলো- আব্দুল ওয়াদুদ শাহ (রেলপাড়া, চুয়াডাঙ্গা), আবদুল ওয়াদুদ মিয়া (লোকনাথপুর), আবু সাঈদ ওরফে ইলু (লোকনাথপুর), সোলেমান (লোকনাথপুর), ইয়াজরাত (লোকনাথপুর) ও আবদুস সাত্তার (লোকনাথপুর)। পরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় এরা সকলে ছাড়া পায়।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা দামুড়হুদা থানার বিভিন্ন গ্রামে নির্মম অত্যাচার, অগ্নিসংযোগ, সম্পদের ক্ষতি এবং অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তারা কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের রিয়াজউদ্দীন বিশ্বাসের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তার ছেলে আজিজুল বিশ্বাসকে আটক করে দর্শনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। এ বাড়ির মনোয়ারা বেগম নামের এক মহিলা ও তার কিশোরী কন্যাকে ধরে অত্যাচারের পর মা-মেয়েকে একসঙ্গে ওড়না দিয়ে বেঁধে মাথায় কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করে। এরপর তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। রিয়াজ উদ্দীন বিশ্বাসকে ঢাকার জয়বেদপুর ক্যাম্পে ছয় মাস রেখে তার ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়। কার্পাসডাঙ্গার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আকবর আলী বিশ্বাস পাকসেনাদের নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন সংঘটিত করে।
৫ই জুলাই জেনারেল টিক্কা খান চুয়াডাঙ্গা সফরে আসে। এদিন সশস্ত্র রাজাকাররা দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ারদার, বাংলার শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, অর্থনীতির শিক্ষক ফজলুল হক ও কেরু এন্ড কোম্পানির ৩ জন কর্মকর্তাকে বাসা থেকে ধরে এনে পাকবাহিনীর দর্শনা ক্যাম্পে হত্যা করে।
হৈবতপুর যুদ্ধের পর ১২ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী মদনা গ্রামের প্রায় ১৫০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এদিন তারা গ্রাম থেকে কয়েকজনকে ধরে এনে কার্পাসডাঙ্গা ক্যাম্পে নির্যাতনের পর হত্যা করে। ক্যাম্পে জিরাট গ্রামের এম মনসুর আলী, আসান, আহম্মদ আলী, পঁচা এবং রহিম (রামনগর)-কে হত্যা করা হয়। পরের দিন ভারত থেকে এসে এডভোকেট ইউনুছ আলী, শহিদুল ইসলামসহ অনেক নেতা ও ভারতীয় সাংবাদিক এ গ্রাম পরিদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধা ইসরাফিল, রবিউল (চন্দ্রাবাস), শফিউদ্দীন (জগন্নাথপুর) ও বাবলু (খলিশাগাড়ি) সীমান্তবর্তী গুমড়া অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থানকালে নাটদহ থেকে এসে এক দল পাকসেনা হুদাপাড়ার সাধারণ মানুষকে মারধর, বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তখন গুমড়া ক্যাম্পের প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের আক্রমণ করলে তারা নাটদহের দিকে পালিয়ে যায়।
কার্পাসডাঙ্গা থেকে চন্দ্রাবাস গ্রামে এসে এক দল পাকসেনা বেছে-বেছে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এদিন তারা গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে। তারা গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে থাকা একজন সদ্যপ্রসূতী নারীকে হত্যার হুমকি দেয়। জুড়ানপুর গ্রামের ৪ জন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘর পাকসেনারা পুড়িয়ে দেয়। গ্রাম থেকে ৮ জন নিরীহ মানুষকে ধরে স্কুল প্রাঙ্গণে নিয়ে নির্যাতন করে। অবর্ণনীয় নির্যাতনের পর ৫ জনকে ছেড়ে দিলেও গ্রামের মোবারেক আলী, সর্দ্দার ভদু, আজিজুল হক ও নিজামদ্দীনকে নিয়ে হত্যা করে। তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। বর্গীখালী যুদ্ধের পূর্বে হোগলডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আলাল উদ্দীনের বাড়িসহ প্রায় ৩০টি বাড়ি পাকসেনারা পুড়িয়ে দেয়। জয়রামপুর গ্রামের শেখপাড়ায় শৈলেন কর্মকারের বাড়ি লুটপাটের পর পাকসেনারা তাতে অগ্নিসংযোগ করে।
জিন্নাতপুর গ্রামে এসে পাকসেনারা ৭ জন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। মুক্তারপুর বেদেপাড়ায় ৫ জন নারী তাদের হাতে নির্যাতিত হন। হোগলডাঙ্গা গ্রামে অগ্নিসংযোগের সময় ১০ জন নারী পাকসেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হন। দর্শনা শহরে প্রচুর অবাঙালির বাস ছিল। দর্শনায় পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ায় পর সেখানে আরো অবাঙালি এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা এখানকার বাঙালি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ওপর বিশেষ করে নারীদের ওপর নানা নির্যাতন চালায়। এ কাজে তাদের সহায়তা করত চুড়িওয়ালী নামে পরিচিত এক বাঙালি মহিলা। সে মহল্লায়-মহল্লায় ঘুরে নারীলোলুপ ক্যাপ্টেন মুনসুরের জন্য নারী জোগাড় করত।
দামুড়হুদা থানায় কাস্টমস অফিস, কার্পাসডাঙ্গা তহসিল অফিস ও হাইস্কুল এবং নাটদহ হাজারদুয়ারী স্কুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সব ক্যাম্পেই মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ধরে এনে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা নির্যাতন ও হত্যা করত। এ ৩টি ক্যাম্পেই গণকবর আছে। নাটদহ হাইস্কুলের উত্তর পার্শ্বে অপেক্ষাকৃত বড় গণকবর রয়েছে। ৩০শে জুন ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদা থানায় আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে অংশ নেন বারেক শিকদার, হাসানুজ্জামান, রবিউল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন ও মনিরুজ্জামান মনি। মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের বাড়িতে তাঁরা থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বৃষ্টির রাতে ঘন অন্ধকারের মধ্যে আক্রমণ পরিচালিত হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিউল টেলিফোনের তার কাটেন, হাসান আর জাহাঙ্গীর থানার উত্তর মেইন গেটে অবস্থান নেন এবং বারেক আর মনি পুলিশ কোয়ার্টার্সে গ্রেনেড চার্জ করেন। প্রথম গ্রেনেড চার্জ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে যে যাঁর পজিশন থেকে গুলিবর্ষণ করেন। দ্বিতীয় গ্রেনেড চার্জের পর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি অব্যাহত থাকে এবং তৃতীয় গ্রেনেডের শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা সকলে ঘাটে বাঁধা নৌকায় গিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনামতো আক্রমণ সফল হয়। এ আক্রমণে ১ পুলিশ নিহত ও ২ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে ফিরে আসেন।
থানার জগন্নাথপুর গ্রামের বাগুয়ানমাঠে ৫ই আগস্ট পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বাগুয়ানমাঠ দামুড়হুদা থানার সীমান্তবর্তী স্থান। চুয়াডাঙ্গা ও দামুড়হুদা থানার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের গুংড়া সীমান্ত সংলগ্ন জ্বপুর গ্রামে (বাংলাদেশের মধ্যে) অস্থায়ী ক্যাম্প করেন। ৩রা আগস্ট জ্বপুর গ্রামের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হলে হোসেন আলী (সিলেট)-র ডান হাতের তর্জনী উড়ে যায়। এর বদলা নিতে মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার হাফিজুর রহমান জোয়ারদারের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সভাপতি বাগুয়ানের কুবাদ খাঁ-কে ৪ঠা আগস্ট ধরে নিয়ে জ্বপুর ক্যাম্পে আটক রাখেন। পরদিন ৫ই আগস্ট সকালে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, রাজাকাররা জোরপূর্বক জগন্নাথপুর গ্রামের নিরীহ মানুষের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বাগুয়ানমাঠের দিকে অগ্রসর হন। তাঁরা দুদলে ভাগ হয়ে হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি দল আক্রমণে ও ১৬ জনের অন্য দলকে কুষ্টিয়ার কমান্ডার নওশের আলীর নেতৃত্বে কভারিং পার্টি হিসেবে রেখে রতনপুর ঘাট পার হয়ে মাঠের দিকে যান। কিছুদূর এগুতেই হাসানের দল পূর্ব থেকে ডিফেন্স করে থাকা পাকসেনাদের সম্মুখে পড়ে যায়। তারা গুলি ছুড়লে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেন। ফলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। পেছনের কভারিং পার্টি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। এ-যুদ্ধে হাসানসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন-। হাসানুজ্জামান (গোকুলখালি), কিয়াম উদ্দীন (রুয়াকুলি, আলমডাঙ্গা), আলাউল ইসলাম খোকন (বড়বাজার, চুয়াডাঙ্গা), আবুল কাশেম (মাঝেরপাড়া, চুয়াডাঙ্গা), রওশন আলম (বটিয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা), রবিউল ইসলাম রবি (মোমিনপুর, নীলমনিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা), খালেদ সাইফুদ্দিন (কাঠদহ, পোড়াদহ, মিরপুর, কুষ্টিয়া) এবং আফাজ উদ্দীন। পাকসেনারা লাশগুলোর ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করে পরদিন জগন্নাথপুর এনে গ্রামবাসীকে দিয়ে দুটি গর্তে মাটিচাপা দেয়। এটি বর্তমানে জগন্নাথপুর আট কবর- হিসেবে পরিচিত।
১১ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা চন্দ্রাবাস গ্রামে ৫ জন রাজাকারকে আক্রমণ করলে তারা ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছে থাকা সকল অস্ত্র জব্দ করেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লিয়াকত আলীর একটি দল ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে মদনা গ্রামের নদীর ঘাটে নোঙ্গর করা সব নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার জন্য ১২ই আগস্ট সেদিকে রওনা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, পাকহানাদাররা যেন নদী পারাপারে এসব নৌকা ব্যবহার করতে না পারে। পথে টহলরত পাকসেনাদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকসেনারা পিছু হটে।
১৪ই আগস্ট দামুড়হুদা থানার প্রধান গেরিলা কমান্ডার লিয়াকত আলী সীমান্তবর্তী গ্রাম জয়নগরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলনের পর ২৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে বাড়াদী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে দামুড়হুদা থানার ইব্রাহিমপুর ও কলাবাড়ীয়ার মুক্তিযোদ্ধারা আলমডাঙ্গা থানার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান মন্টুর সঙ্গে যোগ দিয়ে গোকুলখালী ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে চুয়াডাঙ্গা- মেহেরপুরে পাকবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
২৪শে আগস্ট নাটুদহ ক্যাম্প থেকে একদল হানাদার পাকিস্তানি সেনা মুজিনগরের দিকে রওনা দেয়। পূর্ব থেকে খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মানিকনগর-বাগুয়ান মাঠে এম্বুশ করেন। বেলা ১০টায় পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশের আওতায় এলে আক্রমণ শুরু হয়। উভয় পক্ষে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তীব্র যুদ্ধ হয়। এ- যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও ১২ জন আহত হয়। এখানে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সেপ্টেম্বর মাসে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা ডাববিক্রেতা সেজে কার্পাসডাঙ্গা পাকক্যাম্পে বিষাক্ত ডাব বিক্রি করেন। এ ডাব খেয়ে ক্যাম্পের ৫-৬ জন পাকসেনা মারা যায়। এ ঘটনা স্থানীয়ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ‘ডাবের মধ্যে মুক্তিফৌজ’ শিরোনামে কলকাতার পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়।
৭ই সেপ্টেম্বর কমান্ডার রেজাউল করিম (মদনা মাঝেরপাড়া) তাঁর দল নিয়ে ছোট বলদিয়া শেল্টার থেকে গিয়ে চণ্ডিপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে সব রাজাকার পালিয়ে যায়। রাজাকার কমান্ডার আয়ুব আলী আহত অবস্থায় ধরা পড়ে। তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে মদনাগ্রামে পৌঁছলে সে মারা যায়। কমান্ডার রেজাউল করিম পালিয়ে যাওয়া রাজাকারদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরদিন কুড়ুলগাছির আবু বক্কর চেয়ারম্যানের ভাই আলি হোসেন ৬ জন রাজাকার অস্ত্রসহ কমান্ডার রেজাউল করিমের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১২ই সেপ্টেম্বর কমান্ডার রেজাউল গ্রুপের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে হৈবৎপুরে আশ্রয় নেন। হৈবৎপুরে পৌঁছলে এলএমজি-সহ খাইরুল কমান্ডার (পারকৃষ্ণপুর) তাঁর গ্রুপ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। আরো যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা নুর হাকিম ও মুজাহিদ গোলাম মোস্তফা। সবাই মিলে হৈবৎপুর কবরস্থানে ডিফেন্স নেন। এ খবর পেয়ে পাকসেনারা হৈবৎপুর তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে। দুপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের সময় খড়ের মাঠ থেকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান (হরিশচন্দ্রপুর), জুড়ন, ইছা, দাউদ ও বাহার (মদনাগ্রাম) পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তারা তাঁদের বেয়নেট খুঁচিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে হৈবৎপুরের এক জলাশয়ে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ছোট বলদিয়ায় এসে আশ্রয় নেন।
১৩ই সেপ্টেম্বর ৫০-৬০ জন পাকসেনা হোগলডাঙ্গা গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মাস্টার মফিজুদ্দীন ও খোসাল মণ্ডলকে ধরে নিয়ে যায়। এদিন তারা অনেক নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটায়। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হোগলডাঙ্গা গ্রামের মাঝে বর্গিখালী খালের ব্রিজের ওপর এম্বুশ করেন। পাকসেনারা তাঁদের আওতায় আসামাত্র গুলিবর্ষণ করা হয়। তারা পাল্টা আক্রমণ করলে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন নিহত এবং কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার আহত হয়।
২৪শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কুতুবপুর এলাকায় এম্বুশ করে গুলিবর্ষণ করলে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর ধান্যঘরা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শামসুল মালিতা এবং গ্রামবাসী চাঁদ আলী শহীদ হন। গ্রামের কালু মণ্ডল আহত হন। কার্পাসডাঙ্গা ক্যাম্প থেকে সদাবরি গ্রামের দিকে টহল দিতে যাওয়া একদল পাকসেনাকে মাত্র ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ধান্যঘরা গ্রামের ব্রিজের পাশে এম্বুশ করেন। এ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন- সামসুল মালিতা, আতিয়ার (কুড়ুলগাছি), আব্দার ও অন্য একজন। এখানে প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আব্দুস শুকুর বাঙালি, মসলেম, আতাউল হকসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কার্পাসডাঙ্গার ভৈরব ব্রিজ ধ্বংস করেন। কার্পাসডাঙ্গা হাইস্কুল ও তহসিল অফিসে পাকবাহিনীর ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এ অপারেশনে সফল হন।
২৫শে নভেম্বর পারকৃষ্ণপুর বড় মসজিদের সন্নিকটস্থ কবরস্থানের কাছে পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনী-র মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদিন ভুল রেকির কারণে মিত্রবাহিনী পাকবাহিনীর এম্বুশে পড়লে ১৮ জন মিত্রসেনা শহীদ এবং ২০ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। পারকৃষ্ণপুর কবরস্থান যুদ্ধ- নামে পরিচিত এ-যুদ্ধ এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধে একটি বড় ঘটনা।
২৪শে নভেম্বর একদল মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদা থানা আক্রমণ করেন। থানার পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। এক সময় থানার অফিসারসহ সকল পুলিশ আত্মসমর্পণ করে। থানার সমস্ত অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। সস্ত্রীক অবাঙালি অফিসারসহ সব পুলিশকে শিকারপুর একশন ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন কমান্ডার মতিয়ার রহমান মন্টু (কয়রাডাঙ্গা)। ৪ঠা ডিসেম্বর দামুড়হুদা উপজেলা সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়।
এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মান্নান (পিতা ইমান আলী, হরিশ্চন্দ্রপুর; বাড়াদী গ্রামে পাকিস্থানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে ধরা পড়ে পাকসেনাদের হাতে ১৮ই অক্টোবর শহীদ), সামসুল মালিতা (পিতা করিম মালিতা, ফুলবাড়ী কুড়লগাছি; ধান্যঘরা গ্রামে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আনসার আলী (পিতা ইব্রাহিম মণ্ডল, দেউলী; আলমডাঙ্গা শহরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে ১২ই নভেম্বর শহীদ), ভোলা মল্লিক (পিতা খেদের মল্লিক, জিরাট), গোলাপ (পিতা আব্দুল হক, দর্শনা), আব্দুল হক (পিতা হযরত আলী, দর্শনা), আলি আহম্মদ (দর্শনা), টুকু মিয়া (পিতা আসাদ, দর্শনা) ও আব্দুস শুকুর (পিতা বাদল মণ্ডল, পুরন্দরপুর)। এছাড়া দামুড়হুদা থানার আনসার বাহিনীর কিছু সদস্য দেশের বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে শহীদ হন।
দামুড়হুদা থানার বীরাঙ্গনারা হলেন- রূপছন বিবি (হাতীভাঙ্গা; তিনি কার্পাসডাঙ্গা ক্যাম্পের পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা নির্যাতিত হন), সুফিয়া খাতুন (জিরাট) ও খালেদা (সোনাপুর; নাটদহ ক্যাম্পে নির্যাতিত হন)।
দামুড়হুদার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন -আকরাম আহমেদ, বীর উত্তম- (পিতা মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ, গাছঘাট)। নাটদহ ইউনিয়নের জগন্নাথপুরে বাগুয়ানমাঠ যুদ্ধে শহীদ ৮ জনের কবর আছে (দেখুন জগন্নাথপুর আট কবর-)। সেখানে ১৯৯৭ সালে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। বাড়াদী হুদাপাড়া মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ও ৪ জন কৃষকসহ ৫ শহীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিসৌধটির জমি দান করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জেল হোসেন। এছাড়া পারকৃষ্ণপুর মদনা ইউনিয়নের ৫৩ জন মুক্তিযোদ্ধার নামে ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। পারকৃষ্ণপুর মদনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এ এম জাকারিয়া আলমের উদ্যোগে রাস্তাগুলির নামকরণ করা হয়। [কোরবান আলী মণ্ডল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!