You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.23 | দামেরখণ্ড গণহত্যা (মংলা, বাগেরহাট) - সংগ্রামের নোটবুক

দামেরখণ্ড গণহত্যা (মংলা, বাগেরহাট)

দামেরখণ্ড গণহত্যা (মংলা, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ২৩শে মে। বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে মংলা উপজেলার সুন্দরবন ইউনিয়নের দামেরখণ্ড গ্রামে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঘটনার দিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত গ্রাম ও আশপাশের এলাকায় হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুটতরাজ চালানো হয়। এতে শতাধিক মানুষ হত্যার শিকার হন।
২১শে মে রামপাল উপজেলায় সংঘটিত ডাকরা গণহত্যার পর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় বুঝতে পেরেছিল যে, তারা এখানে নিরাপদ নয়। তাই তাদের প্রায় ৩-৪শ লোক ভারতে যাওয়ার অপেক্ষায় দামেরখণ্ড গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এ খবর পেয়ে রজ্জব আলী ফকির তার বাহিনী নিয়ে বড় দোতলা লঞ্চে করে রামপাল থেকে এসে সোনাইলতলা ইউনিয়নের রাজাকার রুস্তম হাওলাদারের বাড়ির পাশে নামে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় ৩০-৪০ জন রাজাকার। তারা হত্যার উদ্দেশ্যে এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করে নিয়ে এসেছিল। দামেরখণ্ড গ্রামের উদ্দেশ্যে ধনখালি গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গুলি ছোড়া শুরু করে। কয়েকটি বাড়িতে আগুনও দেয়। যারা দৌড়ে পালাচ্ছিল তাদের গুলি করে হত্যা করে। যারা আশপাশের ঝোপজঙ্গল, পুকুর ও খালবিলে পালিয়েছিল, তাদের ধরে এনে বড় ছোরা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। রজ্জব আলীর সঙ্গীরা কয়েকটি ছোট- ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের বসতবাড়িগুলোতে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ করতে-করতে দুপুরের দিকে দামেরখণ্ড গ্রামে পৌঁছায়। তখন তাদের হাতে ছিল অস্ত্রপাতি ও মশাল। তারা ‘নারায়ে তকবির’ ধ্বনি দিয়ে এমনভাবে ধেয়ে আসে যে, বেশির ভাগ লোক পালানোর সুযোগ পায়নি। দামেরখণ্ড খালের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে তারা বেশি আক্রমণ করে। প্রথমে তারা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি শশীভূষণ, রসিকলাল ও সতীশ চৌকিদারকে ধরে এনে গুলি করে। বুকে গুলি খেয়ে রসিকলাল আহত হন এবং কিছুদিন যন্ত্রণা ভোগের পর মারা যান। বাকি দুজন সঙ্গে-সঙ্গে মারা যান। এরপর রাজাকাররা গ্রামের আরো কিছু লোককে ধরে এনে তৎকালীন কাঠের পুলের কাছে এনে দাঁড় করায় এবং একে- একে সবাইকে হত্যা করে। এরপর মৌখালি, নিতাখালি, ঢালিরখণ্ডসহ আশেপাশের এলাকায় আরো অনেককে হত্যা করে। রাজাকারদের শক্ত অবস্থানের কারণে এ এলাকায় তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। তাই অসহায়ভাবে তাদের হাতে প্রাণ হারান পরেশনাথ, নকুলেশ্বর, নিশিকান্ত, শরৎ মণ্ডল, চিত্ত মণ্ডল, বীরেন পরামাণিক প্রমুখ। শতশত লোক মাদুরপাল্টা গ্রামের দিকে দৌড়াচ্ছিল। সেখানেও তাদেরকে রাজাকাররা ঘিরে ফেলে। সেখানে দামেরখণ্ডের অজিত মণ্ডল, ভক্ত মাঝি, কাঙাল মণ্ডলসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। কিছু লোক মুসলিম প্রধান ঢালিরখণ্ডের দিকে দৌড়াতে থাকলে সেখানেও তিনজন রাজাকার বন্দুক ও ছোরা নিয়ে গিয়ে বাবুরাম, সহদেব রায়সহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। অত্র এলাকায় সেদিন কমপক্ষে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়। কিন্তু তাদের সকলের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি, যাদের পাওয়া গেছে তারা হলেন: দামেরখণ্ডের শশীভূষণ মণ্ডল (পিতা কার্তিক মণ্ডল), নকুল মণ্ডল (পিতা শম্ভুরাম মণ্ডল), কুমুদ পরামাণিক (পিতা দ্বিজবর পরামাণিক), বীরেন পরামাণিক (পিতা দ্বিজবর পরামাণিক), রসিকলাল রায় (পিতা রামধন রায়), সন্তোষ মজুমদার ওরফে ভক্ত মাঝি (পিতা নিত্যানন্দ মজুমদার), হরিপদ মণ্ডল (পিতা দোয়ারী মণ্ডল), কাঙাল মণ্ডল (পিতা হারান মণ্ডল), দেবেন্দ্র মণ্ডল (পিতা অতুল মণ্ডল), সহদেব রায় (পিতা পূর্ণচন্দ্র রায়), তেঘরিয়ার বাবুরাম মণ্ডল (পিতা ভাগ্যধর মণ্ডল), সুরুজ বৈরাগী (পিতা রসিকলাল বৈরাগী), শচীন বৈরাগী (পিতা রসিকলাল বৈরাগী), দিগরাজের নগেন্দ্রনাথ মহালদার (পিতা গুরুচরণ মহালদার), নিতাখালির সহদেব কীর্তনীয়া (পিতা পাচুরাম কীৰ্তনীয়া), বিনোদ মাঝি (পিতা কালিপদ মাঝি), নরেন মাঝি (পিতা কালিপদ মাঝি), মহানন্দ গাইন (পিতা বলরাম গাইন), অনন্ত ঠাকুর, রজনী মণ্ডল (পিতা প্রসন্ন মণ্ডল), সুধীর চক্রবর্তী (পিতা জগবন্ধু চক্রবর্তী), সদানন্দ মণ্ডল (পিতা রাম মণ্ডল), মৃগেন মৃধা (পিতা বসন্ত কুমার মৃধা), মৌখালির অজিত মণ্ডল (পিতা রাজেন মণ্ডল), দত্তেরমেঠের নিতীশ মণ্ডল (পিতা শশীভূষণ মণ্ডল), ধীরেন মণ্ডল (পিতা সতীশ মণ্ডল), রজনী কীর্তনীয়া (পিতা মধুসূদন কীর্তনীয়া), রণজিৎ মালঙ্গী (পিতা অশ্বিনী মালঙ্গী), সাহেবের মেঠের ভুবন মণ্ডল (পিতা বিপিন মণ্ডল) এবং খাসেরডাঙ্গার যতীন্দ্রনাথ প্ৰামাণিক (পিতা সনাতন প্রামাণিক)।
রাজাকাররা সেদিন অনেক নারীকে ধর্ষণ করে। দামেরখণ্ডের তরু শীলসহ অনেক নারী বালাবাড়ির বাগানে পালিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাদের ধরে এনে নির্যাতন করা হয়। তরু শীলকে চারমাস যাবৎ বাগেরহাটে রজ্জব আলীর বাড়িতে আটকে রেখে নিয়মিত, পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। এছাড়া রীনা, তপতি, রহিমা খাতুন ও নমিতা মণ্ডলকে ধরে নেয়ার পর তাদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। দামেরখণ্ড গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে এখন পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। এলাকাবাসীর উদ্যোগে তাঁদের নামসম্বলিত একটি ফলক দামেরখণ্ড মন্দিরের সামনের রাস্তায় স্থাপন করা হয়েছে। [মনোজ কান্তি বিশ্বাস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড