You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে দশমিনা উপজেলা (পটুয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে দশমিনা উপজেলা (পটুয়াখালী)

দশমিনা উপজেলা (পটুয়াখালী) মুক্তিযুদ্ধের সময় গলাচিপা থানার একটি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৭৯ সালে রণগোপালদী, আলীপুর, বেতাগী-সানকিপুর, বহরমপুর ও বাঁশবাড়ীয়া ইউনিয়ন নিয়ে দশমিনা থানা গঠিত হয় এবং পরে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। তাই এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড প্রধানত পটুয়াখালী জেলা সংগ্ৰাম কমিটির নির্দেশেই পরিচালিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর সারা দেশের ন্যায় দশমিনা উপজেলার মানুষও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২২শে মে দশমিনার হাজির হাটের গুলু হাজির বাড়ির মৃত সেকান্দার হাওলাদারের স্ত্রী রিজিয়া বেগমের ঘরে বসে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট পটুয়াখালী জেলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হন বাঁশবাড়ীয়া ইউনিয়নের গছানী গ্রামের অধিবাসী এডভোকেট কাজী আবুল কাসেম। এর সদস্য ছিলেন দশমিনা সদর ইউনিয়নের কৃষক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কমরেড আব্দুর সাত্তার খান, জেলা আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আশরাফ আলী, ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ- সভাপতি আবদুল করিম মিয়া, জেলা সভাপতি সৈয়দ আশরাফ, সাধারাণ সম্পাদক কমরেড মোকছেদ প্রমুখ। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়েও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বেতাগী-সানকিপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মো. ইব্রাহিম হাওলাদার ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাবুদ্দিনের উদ্যোগে কলাগাছিয়া এলাকার সাবেক সেনাসদস্য হানিফ সিকদার ও আলাউদ্দিন সরদার ২৫-৩০ জন যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান নেন। দশমিনা ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুর রহমান তালুকদার (ইউনুচ মিয়া) ও সাধারণ সম্পাদক সেকান্দার আলী জোমাদ্দারের উদ্যোগে আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার (মানিক মিয়া) দশমিনা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে অর্ধশতাধিক যুবককে প্রশিক্ষণ দেন। বহরমপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মো. খলিলুর রহমান তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান মোল্লার উদ্যোগে স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণের পর সাবেক বিমান বাহিনী সদস্য এডভোকেট আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া গ্রামের নবাব কাচারী এলাকার আসমত আলী হাওলাদারের বাড়িতে, নুরুল হক (নুরু মাস্টার)-এর নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আলী হাওলাদারের বাড়িতে এবং সাবেক পুলিশ সদস্য সেরাজ সরদার ও আক্রাম আলী মোল্লার নেতৃত্বে ১৫ জন ও হাসেম রাড়ীর নেতৃত্বে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ আদমপুরার সৈয়দ আবুল হাসনাত (কালা মিয়া)-এর বাড়িতে অবস্থান নেন। বাঁশবাড়ীয়া ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম খান (সিরাজ) ও সাধারণ সম্পাদক কাজী আমির হোসেনের উদ্যোগে গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকার সাবেক সেনাসদস্য আবদুর রাজ্জাক রাড়ীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজী আলমগীরসহ ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম কমিটির সহ-সভাপতি কাজী আলাউদ্দিন তালুকদারের বাড়িতে এবং বাউফল কালিশুরীর মেজর (অব.) নজরুল ইসলাম ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাঁশবাড়ীয়া ইউনিয়নের চরহোসনাবাদ এলাকার আমির হোসেনের বাড়িতে অবস্থান নেন। রণগোপালদী ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হারুন রাড়ী ও সাধারণ সম্পাদক মো. বারেক হাওলাদারের উদ্যোগে মাহাবুর রহমান তালুকদারের নেতৃত্বে ৭-৮ জনের একেকটি দল বুড়াগৌরাঙ্গ নদ ও সুতাবাড়ীয়া নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান নেয়। আলীপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি সামসুল হক (চাঁদপুরা এবিসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) ও সাধারণ সম্পাদক খালেকের (শিক্ষক) উদ্যোগে আবদুল হাই, হাবিব মুন্সি, সেলিম মৃধা, রফিক মাতব্বর, সেকান্দার মৃধা, মনিবর মাস্টার, আলী আকবর খান ও কাসেম প্যাদার নেতৃত্বে ছোট-ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান নেন। পটুয়াখালী জেলা সংগ্রাম কমিটির দপ্তর সম্পাদক আব্দুর সত্তার খান ৩১ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে আবদুল লতিফ হাওলাদার (লতিফ ডিপটি), সুরুবালা, রাজেন্দ্র মণ্ডল ও চিত্ত দাসের বাড়িতে অবস্থান নেন। উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ দশমিনা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন পঞ্চম আলী (পি আলী), এ কে এম নুরুল হুদা এবং হাবিবুর রহমান শওকত।
দশমিনা উপজেলায় পাকবাহিনী পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে মাঝে-মধ্যে অপারেশনে আসত। তবে এখানে তাদের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে তাদের সহায়তা করে। দশমিনা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মো. শাহজাহান সিকদার (নয়া মিয়া), রণগোপালদীতে অলিউল ইসলাম (ছেনু তালুকদার), আলীপুরে দলিল উদ্দিন হাওলাদার, বেতাগী-সানকিপুরে গিয়াস উদ্দিন মৃধা, বহরমপুরে সৈয়দ আবুল হাসনাত (কালা মিয়া ) মাওলানা মোকলেছুর রহমান মল্লিক এবং বাঁশবাড়ীয়ায় আবুল কাশেম মৃধা (কল কাশেম)। এসব কমিটির সদস্য ছিল মনোয়ার হোসেন হাওলাদার, মন্নান কাজী, দলিল উদ্দিন মেলকার, মোতাহার, ভুট্ট, জব্বার শরিফ, মতি মৃধা, আশ্রাব আলী, ছিদ্দিক মুন্সি, মুজাফ্ফর, মজিবর রহমান (হাজিরহাট), খাদু সিকদার (গোলখালী) প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল বড়গোপালদীর আবুল হাসেম রাজা (কমান্ডার), তার ছোটভাই লালু রাজা, আবদুল গনি প্যাদা, তার ছোটভাই লালু প্যাদা, আবদুল জব্বার, রামভল্লবের ফারুক ফরাজী, বেতাগীর আবু জোমাদ্দার, সামু, তাফালবাড়ীয়ার মো. সোহরাব প্রমুখ।
উপজেলা সদর, আলীপুর ও বেতাগী-সানকিপুরসহ আরো ৩টি ইউনিয়নে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতন চালায়। ১১ই জুন উপজেলা সদর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের নিবারণ চন্দ্র রায় (নিবারণ কবিরাজ)-এর বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে নগদ ১১ লাখ টাকা, ২৪টি মহিষ ও ১৬টি গরুসহ মূল্যবান আসবাবপত্র নিয়ে যায়। নিবারণ চন্দ্র, তাঁর দুই ভাই বৃন্দাবন চন্দ্র, রাধাচরণ, সৈয়দ আলমগীর ও সৈয়দ আব্দুল মনিম ওরফে শাহানুরসহ মোট ৩৬ জনকে গ্রেফতার করে পটুয়াখালী নিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলা শত্রুমুক্ত হলে তাঁরা মুক্তি পান। ১২ই নভেম্বর সকালে বেতাগী-সানকিপুর ইউনিয়নের বেতাগী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। একই দিন গভীর রাত্রে আলীপুর ইউনিয়নের চাঁদপুরা গ্রামের মন্নান মিলিটারীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং শরীবালী হাওলাদার, আয়েনালী হাওলাদার, জবেদ হাওলাদার, তাঁর ছেলে খালেক হাওলাদার ও রত্তন মৃধাকে নির্যাতন ও গ্রেফতার করে পটুয়াখালী নিয়ে যায়। এদিনই বেতাগী-সানকিপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মো. ইব্রাহিম হাওলাদারের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব কাজে পটুয়াখালী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন ও সেক্রেটারি সুলতান, পটুয়াখালীর আউলিয়াপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন, দশমিনা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান সিকদার (নয়া মিয়া), বেতাগী-সানকিপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন মৃধা, রাজাকার কমান্ডার আবুল হাসেম রাজা, আবুল হোসেন বিশ্বাস, মধু তালুকদার, দেলোয়ার হোসেন, আকতার মোল্লা প্রমুখ পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে।
দশমিনা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সময় রফিক বাহিনী নামে একটি স্থানীয় বাহিনী ছিল। বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি এবং পটুয়াখালী জেলা সংগ্রাম কমিটির দপ্তর সম্পাদক কমরেড আব্দুর সত্তার খানের ছদ্মনাম ছিল রফিক। তাঁরই নামে এ বাহিনী পরিচিত ছিল। এ বাহিনীতে বরিশালের নলিনী দাস, গোলাম মোস্তফা, বাউফলের মোকছেদুর রহমানসহ ৩১ জন সদস্য ছিল। তবে দুর্গম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দশমিনা উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের তৎপরতা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তাই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছাড়াই এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। যেহেতু এখানে পাকবাহিনী কিংবা রাজাকারদের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না, সেহেতু ৮ই ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলা মুক্ত হওয়ার দিনকে এ উপজেলা হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। [এইচ এম ফোরকান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড