দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশন (দাউদকান্দি, কুমিল্লা)
দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশন (দাউদকান্দি, কুমিল্লা) পরিচালিত হয় ১৬ই আগস্ট। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলায় পরিচালিত এ অপারেশনে নৌ- কমান্ডোরা পাকবহিনীর দুটি ফেরি ও একটি পন্টুন ডুবিয়ে দেন। দাউদকান্দি ফেরিঘাটের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের এবং পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের যোগাযোগ রক্ষা করাসহ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আনা অস্ত্র ও গোলাবারুদ পারাপার করা হতো। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মজুদ পাকবাহিনীর যুদ্ধসরঞ্জাম ও রসদও এ ফেরিঘাটের মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করা হতো। এসব কারণে পাকবাহিনীর কাছে এ ফেরিঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের এই যোগাযোগ বিঘ্নিত করার জন্য ফেরিঘাটটি ধ্বংস করে দেয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট দাস শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম-কে এ বিষয়টি অবগত করেন। শাহজাহান সিদ্দিকীসহ ১৪৮ জন নৌ-কমান্ডো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পলাশীতে ৩ মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে তাঁদের চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। লেফটেন্যান্ট দাস তাঁদের মধ্য থেকে শাহজাহান সিদ্দিকীকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমান্ডো দল গঠন করেন এবং দলটিকে এই ফেরিঘাট অপারেশনের জন্য পাঠান। কমান্ডোরা ১১ই আগস্ট ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সাবমেরিনার আমিন উল্লাহ, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে চাঁদপুরের একটি গ্রুপও তাঁদের সঙ্গে ছিল। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য দুজন করে গাইড ছিল। শাহজাহান সিদ্দিকীর সঙ্গে ছিল ১টি ম্যাগাজিন ও পর্যাপ্ত গুলিসহ ১টি অটোমেটিক মেশিনগান। প্রত্যেক কমান্ডোর ছিল সাঁতার কাটার জন্য একজোড়া ফিনস, ১টি লিমপেট মাইন ও কমান্ডো নাইফ।
উভয় গ্রুপই রাতের বেলা ধানখেতের আইল ও মেঠোপথ দিয়ে এগুতে থাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর চাঁদপুর গ্রুপ চাঁদপুরের দিকে এবং শাহজাহান সিদ্দিকীর গ্রুপ দাউদকান্দির দিকে অগ্রসর হয়। ভোর নাগাদ শাহজাহান সিদ্দিকীর গ্রুপ ময়নামতির উত্তরে গোমতী নদীর পূর্বপাড়ে যায় এবং নদী পার হয়ে কখনো হেঁটে আবার কখনো নৌকায় করে ফেরিঘাট থেকে ৭-৮ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকের বন্দরামপুর গ্রামের পীর শাহ কামালের বাড়িতে পৌঁছায়। ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার তাঁদের জন্য এ নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৪ই আগস্ট সকালে শাহজাহান সিদ্দিকী ও ডেপুটি কমান্ডার মতিউর রহমান, বীর প্রতীক- নৌকায় করে ফেরিঘাট রেকি করতে যান। তাঁদের সঙ্গে তখন চটের ব্যাগে ফোল্ডিং করা একটি স্টেনগান ছিল। ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদী, আর দক্ষিণে গোমতী নদী। উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদীর মাঝখানে একটি ছোট চর ছিল। সেই চর থেকে ফেরিঘাটের সবকিছু দেখা যেত। চরের পাশে নৌকা রেখে তাঁরা লক্ষ করেন ফেরিঘাটের পন্টুন থেকে একটু দূরে পশ্চিম দিকে নদীতে দুটি ভাসমান ফেরি নোঙর করা আছে। এদুটি ফেরি আর পন্টুনই তাঁদের টার্গেট।
অপারেশন এলাকা ও টার্গেট ঠিক করার জন্য তাঁদের নৌকাটি আবার চলছিল। এক পর্যায়ে নৌকার গতি কমিয়ে শাহজাহান সিদ্দিকী একটি গামছা পরে নদীতে নেমে যান। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি গোসল করতে নেমেছেন। তাঁর পানিতে নামার উদ্দেশ্য নদীর স্রোতের বেগ ও গতিধারা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা। তখন ছিল বর্ষাকাল। তিনি লক্ষ করেন নদীতে তেমন স্রোত নেই। উজানে এবং ভাটিতে সহজেই সাঁতার কাটা যাবে। তবে নদীর তীরবর্তী ফসলের জমিতেও অথই পানি থাকায় কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এভাবে ফেরিতে পাহারত পাকসেনাদের সন্দেহের বাইরে থেকে শাহজাহান সিদ্দিকী এবং মতিউর রহমান ঘটনাস্থল রেকি করে বন্দরামপুরে ফিরে যান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে ধাপে-ধাপে প্রচারিত কয়েকটি গানের মাধ্যমে নৌ-কমান্ডোদের আক্রমণের সাংকেতিক নির্দেশনা দেয়া হয়। এ নির্দেশনা কৌশলগত কারণে নৌ-কমান্ডোদের টিম লিডার ছাড়া অন্য কাউকে জানানো হয়নি। এই গান শোনার জন্য তাঁদের একটি ট্রানজিস্টর দেয়া হয়েছিল।
১৩ই আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে কাঙ্ক্ষিত গানটি প্রচারিত হয়। তা শুনে শাহজাহান সিদ্দিকী বুঝে ফেলেন যে, ৪৮ ঘণ্টা পর তাঁদের অপারেশনে যেতে হবে।
এরপর তিনি দ্বিতীয় গানটি শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। ১৪ই আগস্ট সন্ধ্যার পর তিনি আকাশবাণীর নিয়মিত অনুষ্ঠানে ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি, ও রে! তোরা সব উলুধ্বনি কর’ গানটি শুনতে পান। এর অর্থ এখন থেকে ২৪ ঘণ্টা পর টার্গেটে আঘাত হানতে হবে। তিনি হিসাব করে দেখেন ১৬ই আগস্ট জিরো আওয়ার থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে হবে। ১৫ই আগস্ট সকালে তিনি সবাইকে ডেকে বলেন, আজ রাতে অপারেশনে যেতে হবে। সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে, গায়ে সরিষার তেল মেখে, সুইমিং কস্টিউমসহ যার-যার লিমপেট মাইন ও ফিনস নিয়ে একটি খোলা নৌকায় করে তাঁরা অপারেশনে বের হন। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড ঝড়-তুফানে পড়ে তাঁরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। ফলে অপারেশন বন্ধ রাখতে হয়।
এদিন দিবাগত রাতে তাঁরা দুটি নৌকা করে আবার বের হন। ফেরিঘাটের কাছাকাছি একটি সুবিধাজনক স্থানে এসে তাঁরা ৩ জন করে পানিতে নামেন। ফেরিতে থাকা পাকবাহিনীর পাহারাদারা যখন টর্চ ঘুরাত, তখন তাঁরা পানিতে ডুব দিতেন। নদী দিয়ে কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল। তাঁরা নাকটা জাগিয়ে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলেন। এভাবে তাঁরা টার্গেট পয়েন্টে পৌঁছে যান। ২০ গজ দূরে থাকতে তাঁরা ডুব-সাঁতার দিয়ে ফেরির কাছে যান। ফেরির বডিতে শেওলার আস্তরণ জমেছিল। কমান্ডো নাইফ দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করা হয়। তারপর তাঁরা ডুব দিয়ে পাঁচ কেজি ওজনের লিমপেট মাইন ফিট করেন। এরপর তাঁরা উল্টো সাঁতার কেটে রেসকিউ পয়েন্টে যান। এর ৬-৭ মিটির পর একে-একে ৯টি মাইন বিস্ফোরিত হয়। পুরো দাউদকান্দি কেঁপে ওঠে। পার্শ্ববর্তী লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। পাকবাহিনী মেশিনগানের গুলি এবং মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে তখন তৃপ্তি হাসি, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। নৌকায় উঠে তাঁরা দ্রুত দুই কিলোমিটার দূরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে পাকবাহিনীর জিপ ও লড়ি হেড লাইট জ্বালিয়ে ফেরিঘাটের দিকে এগিয়ে আসে। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নাগালের বাইরে চলে এসেছেন।
দাউদকান্দি ফেরিঘাটে এই সফল অপারেশনের ফলে দেশের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থানরত পাকবাহিনী ঢাকা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গোমতী নদীতে বাড়তি ফোর্স নিয়োগ করে। নদীপথে লঞ্চ ও স্টিমার দিয়ে সৈন্য ও অস্ত্র পারাপারও অনেকটা কমে আসে। পাকিস্তান সরকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে এতদিন বহির্বিশ্বে যে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল, নৌ-কমান্ডোদের এ সফল অভিযানের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের এ নৌ-অভিযানের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। এরপর থেকে কোনো বিদেশী জাহাজ এ অঞ্চলে আসতে রাজি হয়নি। অপারেশন জ্যাকপট নামের এ অপারেশনের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। [বাশার খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড