You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে দাকোপ উপজেলা (খুলনা)

দাকোপ উপজেলা (খুলনা) বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থিত। খুলনা জেলা সদর থেকে দাকোপের দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। নদীপথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। রাজনৈতিকভাবে এখানকার মানুষ তেমন সচেতন ছিল না। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল সামান্য। তবে ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষণ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- স্বাধীনতার আহ্বান জানালে এখানকার সর্বস্তরের মানুষ মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ দাকোপের মানুষ ৮ই মার্চ রেডিওর মাধ্যমে শুনতে পায়। এর পরপরই তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মোংলা- বাগেরহাট পাকবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলে দাকোপের মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বসিরহাট, বারাসাত ও টাকি ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় দাকোপের মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য লুৎফর রহমান মনি এমএনএ ও শেখ আব্দুল হামিদ (চেয়ারম্যান, ১নং চালনা ইউনিয়ন পরিষদ) বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। দাকোপে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- লুৎফর রহমান মনি এমএনএ, শেখ আব্দুল হামিদ, সত্যেন সেন, মৃণাল রায়, দুলাল রায়, বিধান মাঝি, আকি উদ্দিন শেখ, হাসান শেখ প্রমুখ। এখানকার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন শেখ আব্দুল মজিদ (স্কুল শিক্ষক)।
২৮শে এপ্রিল পাকবাহিনী নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধ জাহাজে করে এসে দুপুর ১২টায় চালনা বাজারে প্রবেশ করে। এরপর তারা ঢাকি নদীর মোহনায় ওয়াপদা অফিসে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৮শে এপ্রিল চালনা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার শেখ আব্দুল মজিদ। চালনা বাজার যুদ্ধে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ছিল মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর। তার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় এ অঞ্চলে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। খুলনা শহরের টুটপাড়ার ভূতের বাড়ির রাজাকার ক্যাম্পের প্রধান ইউছুপের সহযোগিতায় দাকোপের পানখালী গ্রামের আতিয়ার মোল্লার নেতৃত্বে ৩২ সদস্যবিশিষ্ট রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— হোসেন আলী শেখ (নোয়া), সাইদুল হক, সোহরাব হোসেন, মকবুল গাজী, ইছহাক মোল্লা, রাজ্জাক মোল্লা, ছাত্তার ফকির, শহরত আলী, দলিল শেখ, শাজাহান সরদার, নাজিম বয়াতি, সিরাজ ডাক্তার, হামিদ শেখ, দবির মোল্লা, হাসান মোল্লা প্রমুখ। এরা পরবর্তীতে অস্ত্র ও গোলা- বারুদসহ পানখালী গ্রামে চালনা ইউনিয়ন পরিষদের পরিত্যক্ত ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া চালনা নোলোপাড়া মসজিদের ইমাম মওলানা হাফেজ রাজাকার হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিল।
রাজাকার কমান্ডার আতিয়ার মোল্লার নির্দেশে রাজাকার সাইদুল হক দাকোপ উপজেলার ধীরেন্দ্র নাথ বাছাড় (পিতা অশ্বিনী বাছাড়, তিলডাঙ্গা)-কে গুলি করে হত্যা করে। রাজাকাররা ঝপঝপিয়া নদী দিয়ে ভারতগামী শরণার্থীদের নৌকা গুলি করে ডুবিয়ে দিত। এরপর মালামাল লুট করে শরণার্থীদের হত্যা করত। মুসলিম লীগের সহায়তায় পাকসেনারা এলাকায় ঢুকে আওয়ামী লীগ নেতা পঞ্চানন বিশ্বাসের বাড়িসহ বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়।
পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে পরিচিত ছিল চালনা ইউনিয়ন পরিষদের পরিত্যক্ত ভবন, কাটাবুনিয়া-মৌখালী খেয়াঘাট, বটবুনিয়া ও দাকোপ মোড়ল বাড়ি। রাজাকার আতিয়ার মোল্লার বাড়িও তারা নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়া চালনা ইউনিয়নের খাটাইল-লক্ষ্মীখোলা গ্রামে আবু বকর শেখ নামে এক ব্যাক্তির বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এসব ক্যাম্পে তারা হত্যাকাণ্ড ও নারীনির্যাতন চালায়। দাকোপ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি। তবে মংলা ও দাকোপের মাঝামাঝি বানিশান্তার অদূরে লেফটেন্যান্ট গাজী রহমত উল্লাহ দাদুভাই-এর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি। যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। এটি বানিশান্তা জাহাজ অপারেশন হিসেবে পরিচিত। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে = দাদুভাই-এর নেতৃত্বে খাটাইল-লক্ষ্মীখোলার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করা হয়, যা খাটাইল-লক্ষ্মীখোলা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন নামে পরিচিত। তিনটি নৌকাযোগে ৬০ জনের অধিক মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর টহল ফাঁকি দিয়ে এ ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকজন রাজাকারকে বন্দি করে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। ৭ই নভেম্বর দাকোপ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
দাকোপ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— শিবানন্দ বিশ্বাস (পিতা আনন্দ মোহন বিশ্বাস, পারচালনা), রাজেন্দ্র নাথ দে (পিতা বসন্ত কুমার দে, চালনা বাজার), ধীরেন্দ্র নাথ বাছাড় (পিতা অশ্বিনী বাছাড়, তিলডাঙ্গা), পাচু রায়, উপেন সাহা ও সুধীর সাহা।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এখানে বেশ কয়েকটি সড়ক ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ শিবানন্দ সড়ক (চালনা খালের পাড়), শহীদ শিবানন্দ যুব সংঘ, শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (তালতলা, চুনকুড়ি, বাজুয়া) এবং মোবারক মেমোরিয়াল মহাবিদ্যালয়। এছাড়া পৌরসভার ডাকবাংলো মোড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। [মহিবুর রহমান শেখ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!