দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দয়াল কৃষ্ণ চাকমা
দয়াল কৃষ্ণ চাকমা (জন্ম ১৯৩০) বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের শাহাদতবরণ যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি তাঁর মৃতদেহ নিজ হাতে দাফন এবং দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে কবরটি রক্ষাণাবেক্ষণ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার অধীন ৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের ভাঙ্গামুড়ো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র চাকমা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। মা চিক্ক পুদি চাকমা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দয়াল কৃষ্ণ সবার বড়। দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়নি। নিজ বাড়িতে বাল্যশিক্ষা নেন এবং অল্প বয়েসেই তাঁকে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়। ২১ বছর বয়সে তিনি রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়িস্থ বনবিভাগের গাড়িচালক প্রেম রঞ্জন চাকমার মেয়ে মানিক পুদি চাকমাকে বিয়ে করেন। তাঁদের সংসারে পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে ছেলে-মেয়েদেরও বেশিদূর পড়ালেখা করাতে পারেননি তিনি।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নানিয়ারচর হয়ে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে যাতায়াত শুরু করেন। চল্লিশোর্ধ সহজ-সরল দয়াল কৃষ্ণ চাকমা সেসব দেখতেন। তবে দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতেন না। কাপ্তাই হ্রদের অথৈ জলের মাঝখানে ভাঙামুড়ো গ্রামে ছিল তাঁর বসবাস। সপ্তাহে একদিন চাষের ফল-ফলাদি বিক্রি করার জন্য তিনি নানিয়ারচর বাজারে যেতেন। এ সুযোগে বাজারে বসে জানতে পারেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে এদেশের মানুষের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দেশটা জালিমদের হাত থেকে রেহাই পাক; তাই মনেপ্রাণে পাকিস্তানিদের পরাজয় কামনা করতেন। তবে এক অজানা ভয় তাঁর ওপর ভর করে। ঘরে ফিরে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করতেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাজারে না যেতে নিষেধ করেন স্ত্রী মানিক পুদি চাকমা।
যে স্থানে শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে মুন্সী আব্দুর রউফ শাহাদতবরণ করেন, সেটি হচ্ছে কমতলি গ্রাম। এটি নানিয়ারচর উপজেলার ৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের অন্তর্গত রাঙ্গামাটি জেলা (তখন মহকুমা) থেকে এর দূরত্ব ৪০-৪৫ কিমি-এর মতো। চেঙ্গীখালের পাড়ে এর অবস্থিতি। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পর চতুর্দিক পানিবেষ্টিত হয়ে একটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে মূল ভূখণ্ড থেকে হাঁটু পানি ভেঙ্গে পৌঁছানো যায়। তবে নৌযান হচ্ছে যাতায়াতের স্বাভাবিক বাহন।
১৪ই এপ্রিল চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের আহ্বানে পাকিস্তানি বাহিনী রাঙ্গামাটিতে অনুপ্রবেশ করে। তাদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে মহালছড়ি মুক্তিযোদ্ধা হেডকোয়ার্টার্সের অধিনায়ক মেজর মীর শওকত আলী পূর্ব থেকে তাঁর অধীনস্থ অফিসারদের নেতৃত্বে একটি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন। সে অনুযায়ী লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ১০০ সদস্যের একটি দলকে বুড়িঘাটে মোতায়েন করা হয়। ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ তাঁর দলে ছিলেন।
১৯শে এপ্রিল লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে সেনা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি নানিয়ারচর বাজারে আসে। সেখানে স্থানীয় চেয়ারম্যান তিলক চাকমা তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। বিকেলে তাঁরা বুড়িঘাটের চেঙ্গীখালে যান এবং শত্রুবাহিনীকে ঠেকাতে সেখানে বাংকার তৈরি করেন। কীভাবে, কোথায় পজিশন নেবেন সে সম্পর্কেও তাঁদের লে. খালেকুজ্জামান বিস্তারিত ব্রিফিং দেন। এ-সময় স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দয়াল কৃষ্ণ চাকমাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া-দাওয়া সেরে কেউ-কেউ স্থানীয়দের বাড়িঘরে রাত্রি যাপন করেন। তাঁদের খাবার পরিবেশনে অন্যান্যদের সঙ্গে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার সহযোগিতা করা ছাড়াও নিজ ঘর থেকে পেঁপে, শসা ও অন্যান্য ফলমূল যা কিছু ছিল তা দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করেন। খুব ভোরে ঘর থেকে বের হন দয়াল কৃষ্ণ চাকমা। মুক্তিযোদ্ধাদের সকালের খাবার পরিবেশনে তিনি সহযোগিতা করেন। সকালে রণসাজে মুক্তিযোদ্ধারা বোটে আর লঞ্চে করে বুড়িঘাটের দিকে রওনা হন। পিছুপিছু নৌকা নিয়ে ছুটে যান দয়াল কৃষ্ণ চাকমাও। তখন লেকে পানি ছিল কম। তাই কিছুটা পথ গিয়ে পায়ে হেঁটে সেখানে যেতে হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ২০শে এপ্রিল এখানে এক ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ হয়। স্থানটিতে তিনটি টিলা ছিল। মুন্সী আব্দুর রউফ ৯-১০ জন যোদ্ধাসহ হ্রদের মাঝখানে অবস্থিত বুড়িঘাট টিলার কমতলীতে অবস্থান নেন। তিনি ছিলেন লে. খালেকুজ্জামান বাহিনীর মেশিনগানার। অপর দুটি টিলায় অন্যরা অবস্থান নেন।
পাকসেনাদের ২য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ভারী অস্ত্র নিয়ে ৩টি লঞ্চ ও ২টি স্পিডবোট বোঝাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। একদিকে হানাদারদের ভারী অস্ত্র, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্র ও অস্ত্রের গুলি ফুরিয়ে আসা এমনি অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রত্যাহার করে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন দলের কমান্ডার লে. খালেকুজ্জামান। নির্দেশ অনুযায়ী অন্যরা সবাই নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও মুন্সী আব্দুর রউফ একা হালকা মেশিনগান হাতে অসীম সাহসের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এমনই এক অবস্থায় হঠাৎ শত্রুদের মর্টারের গোলা এসে মুন্সী আব্দুর রউফের শরীরে আঘাত হানে। মুহূর্তে তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকহানাদাররা রাঙ্গামাটি হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে যায়। যুদ্ধে ২টি নৌযান ও ১টি স্পিডবোট ছাড়াও পাকবাহিনীর বেশকিছু সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং এন্ড্রু এন বাড়ৈ (রাঙ্গুনিয়া কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র) নামে অপর একজন আহত হন। শহীদ দুই মুক্তিযোদ্ধাকে পাহাড়ের ফাঁকে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো যুদ্ধটি আমগাছের উঁচু ডালে বসে দয়াল কৃষ্ণ চাকমা দেখছিলেন। রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু (তখন রাঙ্গুনিয়া কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র)-সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পশ্চাদপসরণকালে তাঁকে দেখতে পান। তাঁরা খুবই ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত থাকায় দয়াল কৃষ্ণ চাকমা তাঁর বাড়িতে তাঁদের নিয়ে শসা, ফল ইত্যাদি খেতে দেন। এরপর তাঁদের মহালছড়ির পথে এগিয়ে দেন। ঘটনার পরের দিন সকালে তিনি যে টিলায় মুন্সী আব্দুর রউফ যুদ্ধ করেছিলেন, সেখানে যান। গিয়ে দেখেন একজন সৈনিকের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে একটি এলএমজি ও গুলির খোসা। দয়াল কৃষ্ণ চাকমা দেহাংশগুলো কুড়িয়ে গর্ত করে করবস্থ করেন আর একটি খুঁটি দিয়ে স্থানটি চিহ্নিত করে রাখেন। ঐ পথ দিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রায়ই সেখানে গিয়ে তিনি কবরটি দেখে আসতেন। এভাবে কেটে যায় ২৬টি বছর।
১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ১নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম মুন্সী আব্দুর রউফসহ বাংলাদেশের ভেতরে ও ভারতের মাটিতে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর অচিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে, সরেজমিনে সেসব কবর সন্ধানের উদ্যোগ নেন এজন্য তিনি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্যদের নিযুক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সে-সময় বুড়িঘাট যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা, পরবর্তীতে রাঙ্গামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার ও রাঙ্গামাটি স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর মাধ্যমে প্রথমে খোঁজ মিলে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার। তাঁর সহায়তায় চিহ্নিত হয় মুন্সী আব্দুর রউফের কবর। অতঃপর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে কবরটি পাকা করা হয়। বর্তমানে সরকারের উদ্যোগ ও অর্থানুকূল্যে সেখানে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।
যেখানে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন এবং চাকমা সম্প্রদায়ের অনেকেই রাজাকে অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে, সেখানে একই সম্প্রদায়ভুক্ত দয়াল কৃষ্ণ চাকমা পথহারা মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চিনিয়ে দেন, ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা কররন, সর্বোপরি একজন বীরশ্রেষ্ঠের মৃতদেহ নিজ হাতে দাফন ও তাঁর কবর দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এটি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য ভূমিকা, এক কথায়, দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও তিনি জনমুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। স্বজন না হয়েও দেশপ্রেমের আদর্শে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারি উপজেলার সালামতপুর গ্রামের সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সঙ্গে পার্বত্য রাঙ্গামাটির দুর্গম নানিয়ারচর উপজেলার ভাঙ্গামুড়া গ্রামের দয়াল কৃষ্ণ চাকমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। [হারুন-অর-রশিদ ও ইয়াছিন রানা সোহেল]
তথ্যসূত্র: দয়াল কৃষ্ণ চাকমা ও রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর সঙ্গে লেখকদের একাধিক সাক্ষাৎকার; মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম-এর সাক্ষাৎকার (৪-১১-২০১৮); Lt. Gen. Mir Shawkat Ali, BU, The Evidence, vol. one, Dhaka, Somoy Prakashan 2008
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড