দক্ষিণ বাংলা স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ (বরিশাল সদর)
দক্ষিণ বাংলা স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ (বরিশাল সদর) দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত একটি পরিষদ এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর বৃহত্তর বরিশালে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৫শে মার্চ রাতে বরিশাল শহরের পেশকার বাড়ির সামনে হেমায়েত মঞ্জিলের মাঠে গণসঙ্গীত চলাকালে জেলা আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ-র কাছে ট্র্যাঙ্ককলের মাধ্যমে মধ্যরাতে নোয়াখালীর খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ-এর নিকট থেকে ঢাকার রাজারবাগ, পিলখানাসহ শহরের অন্যত্র পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার সংবাদ বরিশাল কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে। সঙ্গে-সঙ্গে গণসঙ্গীতের মাইক থেকে ঢাকায় পাকসেনাদের নির্বিচার গণহত্যার খবর প্রচার করা হয় এবং পাকবাহিনীকে প্রতিহতের জন্য সকলকে আহ্বান জানানো হয়।
ঐ রাতেই নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় শহরে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ- দের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান সিএসপি, পুলিশ সুপার ফকরুদ্দিন আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সাহায্যে ২৫শে মার্চ শেষ রাতে তাঁরা জেলা পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগার থেকে রাইফেল সংগ্রহ করেন। ২৬শে মার্চ খুব সকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বস্তরের জনতা দেশকে হানাদারমুক্ত করার অঙ্গীকারে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন বাংলার সর্বপ্রথম মুক্তিবাহিনী। ২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় পুলিশ সুপারের বাসভবনে নীতিনির্ধারণী কর্মসূচি গ্রহণের উদ্দেশ্যে সংগ্রাম পরিষদের সদস্য, নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল সদস্য, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং জেলা প্রশাসনের সকল বিভাগের প্রধানসহ এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক খান। সভায় উপস্থিত সকলেই পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের অঙ্গীকার করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে দক্ষিণ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ বেসামরিক বিভাগ, ক্যাপ্টেন (যুদ্ধকালে মেজর র্যাংকে উন্নীত), এমএ জলিল – প্রতিরক্ষা বিভাগ, আবদুল মালেক অর্থ বিভাগ, মহিউদ্দিন আহমেদ এমপিএ – খাদ্য বিভাগ, এডভোকেট আমিনুল হক চৌধুরী – বিচার বিভাগ, আমির হোসেন আমু এমপিএ ত্রাণ বিভাগ, শামসুল হক এমএনএ জ্বালানি বিভাগ, এডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন – তথ্য বিভাগ, এডভোকেট হাসান ইসলাম চৌধুরী – সিভিল ডিফেন্স বিভাগ, এডভোকেট সরদার জালাল উদ্দিন যোগাযোগ বিভাগ এবং ডা. হুরমত আলী (চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজ) স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ। এটি দক্ষিণ বাংলা স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরিষদের অপর একটি কমিটি ছিল। এর সদস্যরা ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ, সালাউদ্দিন কায়সার এমএনএ, ডা. আজহার উদ্দিন আহম্মেদ এমএনএ, আগরতলা মামলার আসামী ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ, আব্দুল করিম সরদার এমপিএ, এডভোকেট সুধীর চক্রবর্তী ও কাজেম আলী মিয়া। এডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ প্রধান সমন্বয়কারী এবং মাকসুদ আলী খান বাদল ও লুৎফর রহমান কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব পালন করেন।
বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দক্ষিণ বাংলা স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সভায় জরুরিভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন এবং পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২৫শে এপ্রিল বরিশাল শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদের কর্তৃত্ব বহাল ছিল। বাকেরগঞ্জ কালেক্টরেটের কর্মচারীদের একাংশসহ সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারিবৃন্দ পরিষদের সচিবালয়ের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রধান সমন্বয়কারীর সভাপতিত্বে প্রতিদিন উপদেষ্টা পরিষদের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হতো। সভার সিদ্ধান্তগুলো মুক্তিযোদ্ধারা বিজ্ঞপ্তি ও নির্দেশনা আকারে কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। ব্যাংকগুলোও উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশমতো কাজ করত। প্রশাসনিক যাবতীয় কার্যক্রম উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশে পরিচালিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশ অনুসারে এ-সময় বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর সংসদ সদস্যগণ নিজ-নিজ এলাকায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশে প্রতিরক্ষা প্রধান এম এ জলিল এবং সহঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা (হিরু)-র নেতৃত্বে বরিশাল বেলস্ পার্কে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু উদ্যান) প্রধান ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পার্ক সংলগ্ন আইডব্লিউটিএ-র ডাকবাংলোর কাঠের দোতলা বাড়িটিকে ডিফেন্স হেডকোয়ার্টার্স করা হয়। বেলস্ পার্কের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ নুরুল আহসান আবু মিয়া এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন লেফটেন্যান্ট নাসির, জেলা এডজুট্যান্ট মেজবাহ উদ্দিন, মহকুমা এডজুট্যান্ট তৈয়বুর রহমান, সহকারী এডজুট্যান্ট মকবুল হোসেন প্রমুখ। এছাড়া কাশিপুরের নারিকেল বাগান, নবগ্রাম রোডের মিশনারি বিদ্যালয়, তালতলী আমিন বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লাকুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও ভাটিখানায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
১৮ই এপ্রিল বরিশাল শহরের ওপর পাকবাহিনীর প্রথম বিমান হামলার পর উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশক্রমে বরিশাল জেলার সকল বন্দিদের ছেড়ে দেয়া হয়। এদিন হামলার পর সচিবালয়ের পক্ষ থেকে মাইকযোগে নগরবাসীকে শহর ছেড়ে গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) ফজলুল হকের নেতৃত্বে জুনাহারে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম ৩রা এপ্রিল থেকে বরিশাল ত্রিশ গোডাউনের খাদ্য সামগ্রী ডিলারদের মাঝে বরাদ্দের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলে তা সরিয়ে নেয়ার কাজের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। এ-সময় ভোলায় সেকেন্ড অফিসারের বদলিজনিত কারণে সেখানে রিলিফ কাজে অচল অবস্থার সৃষ্টি হলে সচিবালয়ের পক্ষ থেকে কাজী আজিজুল ইসলামকে ভোলায় পাঠান হয়। সচিবালয়ে এসে প্রতিদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবী, সমাজের বিশিষ্ট জন ও সাংবাদিকবৃন্দ এর কার্যক্রমকে বেগবান করতে উৎসাহ দিতেন। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আক্কাস হোসেনের নেতৃত্বে শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান ও গণসংগীতের আয়োজন করেন। এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদিত বাংলাদেশ নামে একটি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সাহসী এবং প্রাণবন্ত ভূমিকা এ- সময় জনগণকে অনুপ্রেরণা জোগায়। স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রথম সচিবালয় স্থাপনের এই গৌরবময় ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধে বরিশালবাসীর সাহসী ভূমিকার পরিচায়ক। [দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী]
তথ্যসূত্রঃ হেমায়েত উদ্দিন আহম্মেদ (প্রধান সমন্বয়কারী, উপদেষ্টা পরিষদ ও দক্ষিণাঞ্চলীয় স্বাধীন বাংলা সরকার, বরিশাল), বরিশালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকেন্দ্র উৎসব ‘৯৩ (স্মারক পুস্তিকা), বরিশাল, মার্চ ১৯৯৩; মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চল, গতিধারা ২০১৫; ওবায়দুর রহমান মোস্তফা, মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা, ঢাকা, ভাস্কর প্রকাশনী ২০০৭; মাসুদ মজুমদার (সম্পাদিত), মেজর জলিল রচনাবলী, ঢাকা ১৯৯৭
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড