You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা (সুনামগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা (সুনামগঞ্জ) মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তর্গত ছিল। তাই এখানকার সমস্ত আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কেন্দ্রিক ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পরপরই সুনামগঞ্জ সদরের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলার সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃবৃন্দও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় সুনামগঞ্জ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ, ওয়ালী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুনামগঞ্জ শহরের দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ (হাছননগর, আওয়ামী লীগ), শওকতুল ইসলাম আজাদ (পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, ওয়ালী ন্যাপ), নজির হোসেন (কমিউনিস্ট পার্টি) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৈাধুরী এমএনএ এবং সদস্য ছিলেন— আব্দুস সামাদ আজাদ এমএনএ, মোহাম্মদ আব্দুল হক এমএনএ প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হলে ছাত্র-জনতা মহকুমা অস্ত্রাগার থেকে ৫০টি রাইফেল ও বেশকিছু গুলি নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার ও মুজাহিদদের মধ্যে বিতরণ করে। তারা ৪ঠা মার্চ সুনামগঞ্জ শহরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। পরে লঞ্চঘাট এলাকার পুলিশ-ফাঁড়িতে পতাকা উত্তোলনের সময় সেখানে অবস্থানরত পুলিশরা বাঁধা দেয়। তা সত্ত্বেও ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে উপজেলার জনগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৪ই মার্চ থেকে সরকারি জুবিলী হাইস্কুল মাঠে প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন বিমানবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য আছদ্দর আলী চৌধুরী (লাল মিয়া), মতিউর রহমান চৌধুরী, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড (পিএনজি)-এর প্রাক্তন অনারারি লেফটেন্যান্ট কাজী বশির উদ্দিন (নানু মিয়া মোক্তার), পিএনজি-র প্রাক্তন সদস্য আশ্রব আলী, নওরোজ আলী (বাবন মিয়া), প্রাক্তন আনসার কমান্ডার নওয়াব আলী প্রমুখ। প্রথম দুজন এতে নেতৃত্ব দেন।
উপজেলায় ক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন Saved দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ, আব্দুস সামাদ আজাদ এমএনএ, মোহাম্মদ আব্দুল হক এমএনএ, শওকতুল ইসলাম আজাদ, নজির হোসেন প্রমুখ। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্য থেকে আব্দুস শহীদ চৌধুরী (ছাত্র ইউনিয়ন), রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু (ঐ), অজিত কুমার নাগ (ঐ), মুজিবুর রহমান চৌধুরী (ছাত্রলীগ), সুজিত চৌধুরী (ঐ), আব্দুল মালেক (ঐ), আব্দুর রব শেলী (ছাত্র ইউনিয়ন-মেনন), সত্যব্রত রায় বুলু (ঐ), স্বপন কুমার দেব (ঐ) প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন নিজাম উদ্দিন লস্কর ও ক্যাপ্টেন মুত্তালিব।
পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ২৪শে মার্চ আনসার এডজুট্যান্ট এম এ মোকাব্বিরকে আনসার- মুজাহিদদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর সুনামগঞ্জ শহরে সর্বদলীয় নেতারা ঐদিন রাতে দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ-র বাড়িতে এক জরুরি সভায় মিলিত হন এবং পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। সে অনুযায়ী বিভিন্ন রাস্তায় মাটি খুঁড়ে ও গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। পাকসেনারা যাতে সহজে সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সাধারণ জনতা আহসানমারা ও ডাবর ফেরি সরিয়ে ফেলে। শহরের ওয়েজখালীতে বাংকার খনন করে নায়েক আনিস, আনসার মালদার আলী, তারা মিয়া, কামাল মিয়া প্রমুখকে সশস্ত্র পাহারায় নিয়োজিত করা হয়। এছাড়া আমবাড়িতে একটি প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হয়।
২৭শে মার্চ পাকসেনারা সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে ২৯শে মার্চ চলে যায়। পুনরায় ১০ই মে প্রবেশ করে জয়কলস ইউনিয়নের রাজাকার আব্দুল ছাত্তার মিয়া (পিতা বারাম উল্লাহ, উজানীগাঁও)-র বাড়ি ও উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের পাগলা বাজার ডাকবাংলোয় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী তাদের সহযোগিতার জন্য স্থানীয় দালালদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করে। রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল আব্দুল ছাত্তার মিয়া। এ বাহিনীর সদস্য ছিল শতাধিক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলো— ইসব আলী (পিতা নছিব উল্লাহ, জামলাবাজ; কমান্ডার), খোয়াজ আলী (উজানীগাঁও), নোয়াজ আলী (উজানীগাঁও), বসির আহমদ (উজানীগাঁও), জবাদ উল্লাহ (আস্তমা), রশিদ আলী (আস্তমা), আব্দুল ওয়াহাব ওরফে ঠাকুর মিয়া (রায়পুর), আনোয়ার বেগ (ইসলামপুর), রহিম উদ্দিন (রায়পুর), আলী মিয়া (ব্রাহ্মণগাঁও), আ. রকিব (ছয়হাড়া), আ. মতিন (ছয়হাড়া), ইছাক আলী (হলদারকান্দি), আ. রহিম ওরফে সুন্দরকারী (সিচনী), জোবেদ আলী (সিচনী), সৈয়দ আমির আলী (দরগাপাশা), ঠাকুরধন মিয়া (দরগাপাশা), ফজর আলী (আক্তাপাড়া), নূর ইসলাম (আক্তাপাড়া), হরমান উল্লাহ (বাঘেরকোনা), ফয়জুর রহমান (নতুন জাহানপুর), আব্দুল জলিল খেলা (নতুন জাহানপুর), জবান আলী (আমদাবাজ), ইউনুছ আলী (গনিগঞ্জ), আ. কাদির (বাবনিয়া), মান্নান (গনিগঞ্জ), কাবুলী (হাসারচর), হারুন রশিদ (পাথারিয়া), হরমুজ আলী (কান্দিগাঁও), আ. কাদির (জামলাবাজ), মনির (জামলাবাজ), বসির উদ্দিন (সুলতানপুর), আব্দুল খালিক (ডুংরিয়া), আব্দুল হাই (ডুংরিয়া), ছুরাব আলী (শিবপুর), আলমাছ (শিবপুর), চেরাগ আলী (সুলতানপুর), হাসিম উল্লাহ (সুলতানপুর), ইন্তাজ (আস্তমা), লতিফ মোবারক (ডুংরিয়া), ছেইছা (জয়কলস), উমর আলী (জয়কলস), আ. ছোবহান (হাঁসকুড়ি), আরব উল্লাহ (হাঁসকুড়ি), মন্তাজ আলী (বীরগাঁও), আ. হান্নান (বীরগাঁও), সুরজ আলী (জয়সিদ্ধি), আ. জাহির (দুর্বাকান্দা), সমুজ আলী (মাহমদপুর), আ. বারি (মুক্তাখাই), আ. ওয়াহাব (জীবদাড়া), আকন্দর আলী (জীবদাঁড়া), তালেব আলী (গনিগঞ্জ), হারুন রশিদ (পাথারিয়া) ও আজব মিয়া চৌধুরী (দরগাপাশা, নোয়াগাঁও)।
শান্তি কমিটির সদস্য ছিল ২০ জনের অধিক। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলো- আসকর আলী (সর্দারপুর), সাজর আলী (কান্দাগাঁও), আ. মজিদ (কান্দাগাঁও), মফিজ আলী (কিদিরপুর), মুকতি মিয়া (কিদিরপুর), আ. সহিদ (মুক্তাখাই), আ. গফুর (গনিগঞ্জ), লাল মিয়া (গনিগঞ্জ), হানিফ মিয়া (গনিগঞ্জ), দিলকুস মিয়া (রাজাকার প্রধান আব্দুল ছাত্তারের ভাই), ক্বারী আ. মতিন (আসারচর), কালা মিয়া (ফতেহপুর), আনোয়ার আলী (জয়কসৈ), আমির উদ্দিন (পার্বতীপুর), সুরুজ মিয়া (হাসামপুর) ও আক্রম আলী (পাগলা)।
স্বাধীনতার পরে দালাল আইনে ১২ জনকে আটক করা হয়েছিল। তারা হলো- সাবান আলী (পিতা ইব্রাহিম আলী, গনিগঞ্জ), নাছির উদ্দিন (পিতা হানিফ উল্লাহ, উজানীগাঁও), আক্কাছ আলী ওরফে আক্কাছ উদ্দিন (পিতা সিদ্দিক, বীরগাঁও), আলাউদ্দিন (পিতা ইদ্রিছ আলী, পাগলা), মোতাই রাজাকার ওরফে আ. রহমান (পিতা আকাই, রায়পুর), মছদ্দর আলী ওরফে কাইজ্জা আলী (পিতা মশরফ আলী, রায়পুর), জলিল উদ্দিন (পিতা ইয়াকুব আলী, রায়পুর), হাজী মো. আনোয়ার (পিতা আসমান আলী, রায়পুর), আসমান আলী (পিতা ইয়াছিন উল্লাহ, রায়পুর), নুরুল আনোয়ার (পিতা আসমান আলী, রায়পুর), আ. আহাদ (পিতা হাসিম উল্লাহ, দামোধরতপী) এবং আনিছ আলী (পিতা নছর আলী মাতমদপুর)।
রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যদের দ্বারা হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারীনির্যাতনসহ নানান অপকর্ম সংঘটিত হয়। তাদের নির্যাতনের শিকার হন বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষ ও সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা। তারা উপজেলায় দুটি গণহত্যা চালায় – তেঘরিয়া গণহত্যা ও ডুংরিয়া গণহত্যা। তেঘরিয়া গণহত্যায় ৬ জন এবং ডুংরিয়া গণহত্যায় ১০ জন নিরীহ লোক শহীদ হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভন্ন স্থানে আরো ৯ জনকে হত্যা করা হয়। তারা হলো— পুলিন কুমার দাস (পিতা বৈকুণ্ঠ দাস, গোবিন্দপুর, দিরাই; পাথারিয়া আখড়ার ম্যানেজার, রাজাকাররা এখানেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে), সুন্দর আলী (হাসনাবাজ, পাকবাহিনী নদীর ঘাটে গুলি করে হত্যা করে), আঞ্জু মড়ল (পিতা আজিম উল্লাহ, ঘরুয়া; নিজবাড়িতে হত্যা করা হয়), নরেন্দ্র দাস (পিতা আরাধন দাস, শিবপুর; ঐ), ইসকন্দর আলী (পিতা রিয়াজ উল্লাহ, শিবপুর; ঐ), লবচান সূত্রধর (পিতা নীরদ সূত্রধর, শত্রুমর্দন; ঐ), আরুন নেছা (পিতা মুক্তিযোদ্ধা কালা মিয়া, বাবলিয়া, ঐ), লিয়াকত আলী (পিতা আইন উল্লাহ, ঘরুয়া) এবং দৌলত মিয়া (পিতা আজই উল্লাহ, শিবপুর)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তেঘরিয়া গ্রামের ৫৪ জন, শিবপুর গ্রামের একজন, বাদুল্লাপুর গ্রামের ৩ জন, তেহকিয়া গ্রামের একজন, বেগলাখাড়া গ্রামের ৩ জন, ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের ২ জন, কান্দিগাঁও গ্রামের ২ জন এবং জয়কলস গ্রামের ৩ জনের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। তেঘরিয়া গ্রামের সকলেই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তাঁরা হলেন- বিচিত্র রঞ্জন দাশ (পিতা মহেশ্বর দাশ, শিবপুর), সুনুর আলী (পিতা আবারক আলী, বাদুল্লাপুর), হুরুধন আলী (পিতা হাছন আলী, ঐ), আরশদ আলী (পিতা রাকিব আলী, ঐ), মনির উদ্দিন (পিতা বাতির আলী, বেগলাখাড়া), আমির আলী (পিতা আব্দুর রহমান, ঐ), আরমান আলী (পিতা আব্বাস আলী, ব্রাহ্মণগাঁও), আব্দুল জব্বার (পিতা মরম আলী, ঐ) এবং আব্দুল মতিন (পিতা মছদ্দর আলী, কান্দিগাঁও)।
উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পাঁচজন নারী ধর্ষিতা হন। তাঁরা হলেন- বেবী চৌধুরী (ব্রাহ্মণগাঁও), লতা দত্ত (রামেশ্বরপুর; ঐ), মালতী কর (রামেশ্বরপুর), সাবিত্রী দত্ত (রামেশ্বরপুর), শুক্লা চৌধুরী (সদরপুর)।
আগস্ট মাসে উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের বাবনীয়া গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলী শহীদ হন। তাঁকে দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে সমাহিত করা হয়। এছাড়া আরো যেসব যুদ্ধ হয়, সেগুলো হলো— আহসানমারা ফেরিঘাট অপারেশন, সদরপুর সেতু অপারেশন, রাজাকার কমান্ডার আব্দুল ছত্তারের ঘাঁটি আক্রমণ, গনিগঞ্জ অপারেশন ও ডাবর ফেরিঘাট ও রাজাকার বাঙ্কার অপারেশন। আহসানমারা ফেরিঘাট অপারেশন পরিচালিত হয় দুবার – আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং ১৬ই আগস্ট। প্রথমবার গৌরাঙ্গচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা এন্টিট্যাংক মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর একটি জিপ উড়ে যায়। দ্বিতীয়বার কমান্ডার নিজাম উদ্দিন লস্করের নেতৃতে পরিচালিত অপারেশনে এখানকার ফেরিটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধা মহরম আলী শহীদ ও কমান্ডার নিজাম উদ্দিন লস্কর আহত হন। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে সদরপুর সেতু অপারেশন পরিচালিত হয়। অপারেশনে সেতুটি উড়ে গেলে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কপথে পাকবাহিনীর যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়। আগস্ট মাসে নিজাম উদ্দিন লস্করের নেতৃত্বে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল ছত্তারের ঘাঁটি আক্রমণ পরিচালিত হয়। এতে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ১১টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, কয়েকশ রাউন্ড গুলি এবং কিছু পরিমাণ পাকিস্তানি টাকা উদ্ধার করেন। অপারেশনের সময় ঘাঁটিতে না থাকায় রাজাকার প্রধান আব্দুল ছত্তার প্রাণে বেঁচে যায়। ৭ই নভেম্বর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের নেতৃত্বে গনিগঞ্জ অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে একজন মিলিশিয়া ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৬ জন রাজাকার অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। ১২ই নভেম্বর লেফটেন্যান্ট রউফের নেতৃত্বে ডাবর ফেরিঘাট ও রাজাকার বাঙ্কার অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে ফেরিঘাট, রাজাকারদের বাঙ্কার ও ছাতক উপজেলার জাউয়া সেতু ধ্বংস হয় ৷ ফেরিঘাটে একজন রাজাকার বন্দি হয় এবং হানাদারদের ৭টি রাইফেল, ৪টি এলএমজি ও ৪৮৯ রাইন্ড গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ৬ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— মহরম আলী (১৬ই আগস্ট আহসানমারা ফেরিঘাট অপারেশনে শহীদ), আরশ আলী (পিতা ইদ্রিছ আলী, আস্তমা; আগস্ট মাসে পাথারিয়া ইউনিয়নের বাবনিয়া যুদ্ধে শহীদ), কৃপেন্দ্র দাশ (পিতা দর্পনারায়ণ দাশ, ব্রাহ্মণগাঁও; হানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জ ছেড়ে যাওয়ার সময় তাদের হাতে আটক হওয়া কয়েকজন সাধারণ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধা কৃপেন্দ্র দাশকে রাজাকার প্রধান আব্দুল ছত্তারের হাতে তুলে দেয় এবং ঐদিনই রাজাকাররা তাঁদের হত্যা করে লাশ আহসানমারা ডহরে ফেলে দেয়) এবং কবীন্দ্র দাশ (পিতা নরেন্দ্র দাশ, নায়নগর)। এছাড়া কৃপেন্দ্র দাশের সঙ্গে দিরাই উপজেলার আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব (পিতা আফছার আলী, হাতিয়া) রাজাকারদের হাতে শহীদ হন এবং তাঁর লাশও আহসানমারা ডহরে ফেলে দেয়া হয়। স্থানীয় লোকজন আবু তালেবের লাশ উজানীগাঁও গ্রামের জয়কলস উজানীগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে এবং কৃপেন্দ্র দাশের লাশ উজানীগাঁও জামে মসজিদের দক্ষিণ পাশে সমাহিত করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেবের স্মৃতি রক্ষার্থে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে আহসানমারায় ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য’ নামে একটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। [মোহাম্মদ ফয়েজুল ইসলাম সোহেল তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড