You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম তৌহিদ উল্লাহ - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম তৌহিদ উল্লাহ

তৌহিদ উল্লাহ, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৫) সুবেদার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাঠকরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং মাতার নাম আয়েশা খাতুন।
৬ষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তৌহিদ সেনাবাহিনীতে হাবিলদার পদে পেশোয়ারে কর্মরত ছিলেন। চাকরিকালে তিনি বাঙালি সেনাদের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ লক্ষ্য করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি ছুটিতে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- এবং ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙালিদের ওপর নৃশংস গণহত্যা তাঁকে বিদ্রোহী করে তোলে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরে না গিয়ে ৩০শে মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর অধীনে ক্যাপ্টেন ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বে তৌহিদ উল্লাহ রাজনগর সাব-সেক্টরের অন্তর্গত ফুলগাজী, মুন্সিরহাট, বন্ধুরহাটসহ নোয়াখালী ও কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে সাহসিকতার পরিচয় দেন। এর মধ্যে বেলুনিয়ার যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
ফেনী জেলার অন্তর্গত বেলুনিয়ার অনেক জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। ২১শে জুন পর্যন্ত বেলুনিয়া মুক্ত ছিল। এ-সময় তৌহিদ উল্লাহ ফেনীর দক্ষিণে একটি ডিফেন্সে ছিলেন। ঐদিন হেলিকপ্টারের সাহায্যে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্য নামতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে মনে করেছিলেন হেলিকপ্টারগুলো তাদের পক্ষের। শত্রুসৈন্যদের নামতে দেখে দ্রুত তাঁদের ভুল ভাঙ্গে। তৌহিদ উল্লাহ তাঁর এলএমজি দিয়ে হেলিকপ্টারগুলোর দিকে ব্রাশ ফায়ার করেন। এরপর দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়।
৩১শে অক্টোবর মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে চিতলিয়ার নিকট মুহুরী নদীর ধানীকুণ্ডের দক্ষিণে তৌহিদ উল্লাহসহ ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রেকি করতে যান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও শক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। হঠাৎ তাঁরা হানাদারদের এম্বুশের মধ্যে পড়ে যান। খবর পেয়ে কোম্পানি কমান্ডার ইমাম-উজ-জামান মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল সেখানে প্রেরণ করেন। উভয় পক্ষের পাল্টা আক্রমণে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
৮ই নভেম্বর বেলুনিয়ার চিতলিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। হানাদার বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন একবারে অপ্রস্তুত। তৌহিদ উল্লাহ ছিলেন শত্রুর নাগালের মধ্যে। পজিশন নেয়ার আগেই কয়েকটি গুলি এসে তাঁর পায়ে বিদ্ধ হয়। সহযোদ্ধা আজিজ গুলিতে শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। এমন অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। এ-যুদ্ধে পা হারিয়ে তৌহিদ উল্লাহ পঙ্গুত্ব বরণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তৌহিদ উল্লাহর অসাধারণ সাহস ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল হন। ১৯৭৩ সালে মানসিক ভারসাম্য হারানোর ফলে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন। তাঁর স্ত্রীর নাম মোছা. ফরিদা পারভিন। এ দম্পতি ২ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড