You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.14 | ত্রিমোহনী ব্রিজ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

ত্রিমোহনী ব্রিজ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর)

ত্রিমোহনী ব্রিজ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর) সংঘটিত হয় ১৪ই অক্টোবর। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয় এবং তিনজন রাজাকার ধরা পড়ে। পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১০ কিমি পশ্চিমে এবং সুজার কুঠি-কাঁচদহ ঘাট থেকে ১৫ কিমি উত্তর-পূর্বে আখিরা নদীর ওপর ত্রিমোহনী ব্রিজ অবস্থিত। পাকসেনা ও রাজাকাররা ব্রিজটির পাহারায় ছিল। তাদের কাছ থেকে ব্রিজটি মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের আক্রমণ করেন। এটি ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধ। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বড়াহার ক্যাম্প থেকে কমান্ডার আজাহারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা কাঁচদহের নিকটবর্তী সুজার কুঠি গ্রামে অবস্থান নেন।
১৪ই অক্টোবর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ত্রিমোহনী ব্রিজ আক্ৰমণ করেন। খয়ের বাড়ির দক্ষিণে আমগাছের নিচ থেকে এবং ত্রিমোহনী ব্রিজের দক্ষিণের আমবাগান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একশন গুরু হয়। তাঁরা গুলি ছুড়তে- ছুড়তে ব্রিজে আক্রমণ চালান। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার আজাহার আলী। যুদ্ধের নিদের্শনা ও পরিকল্পনায় ছিলেন বড়াহার ক্যাম্প ইনচার্জ ক্যাপ্টেন রণজিৎ সিং।
মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে আক্রমণ চালান। ব্রিজে ডিউটিরত রাজাকার ও পাকসেনাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। উভয় পক্ষ বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করে। এলএমজি, সেভেন সিক্সটি টু, অটোরাইফেল, স্টেনগান, দুই ইঞ্চি মর্টার, হ্যান্ড গ্রেন্ডসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ঘণ্টা খানেক যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পিছু হটে। হঠাৎ আক্রমণের ফলে বেশকিছু পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। তিনজন রাজাকারকে ধরে বড়াহার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ক্যাপ্টেন রণজিৎ সিং ও ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা শরিফুল, ফজলু এবং আজিজুল কবীরের হাতে তুলে দেয়া হয়। ধৃত রাজাকারা হলো সাহেব আলী, মকবুল হোসেন ও মোজাব আলী।
ত্রিমোহনী যুদ্ধের প্রস্তুতি লগ্নে মুক্তিযোদ্ধারা করতোয়া নদীর তীরে কাশবনে বাংকার খনন করে গোলাবারুদ ও রসদাদিসহ অবস্থান নেন এবং পাকবাহিনীর গতি-বিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখেন। তাঁরা কৃষকের ছদ্মবেশে মাঠে-মাঠে ঘুরে তাদের খবর সংগ্রহ করেন। খালাশপীর হাটের পশ্চিমে বুড়ির ঘাটে পাকবাহিনী কিছু একটা পুঁতে রাখার খবর পাওয়ার পর কমান্ডার আজাহার আলীসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে গিয়ে এন্টিট্যাংক মাইনের সন্ধান পান। মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলো তুলে ভেতরের ফিউজ আলাদা করে গরুর গাড়িতে করে খালাশপীর নিয়ে যান।
ত্রিমোহনী যুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- মো. আজাহার আলী কমান্ডার, মো. নজরুল ইসলাম, মো. আফজাল হোসেন, মো. গোলজার হোসেন, মো. আলতাব হোসেন, মো. আ. হক, অধীর চন্দ্র, বীরেন্দ্রনাথ, রমেশ চন্দ্র, শৈলেন কুমার, লুৎফর রহমান প্রমুখ।
ত্রিমোহনী ব্রিজের যুদ্ধ শুধু পীরগঞ্জ নয়, গোটা উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের মধ্যে এক গভীর প্রেরণা তৈরি করেছিল। সেই সঙ্গে কুচক্রী পাকবাহিনীর দোসরদের ভীত-সন্ত্রস্ত করেছিল। এ অঞ্চলের বাসিন্দারা সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা না করলে প্রশিক্ষিত পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে এতবড় যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হতো না। চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বে এমন অনেক খণ্ডযুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা সংগ্রামকে মহাযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। [লুৎফর রহমান সাজু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড